দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ১১৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল রোববার রাত থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি রয়েছেন।

ঢাকা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনুসহ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। 

গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন– ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হল শাখার নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক দীপম সাহা, ছাত্রলীগ নেতা কাজী ইসমাইল হোসেন, মো.

বাপ্পি, ছাত্রলীগকর্মী মুহতাসিন ফুয়াদ ওরফে পিয়াল, আওয়ামী লীগ নেতা মহিবুর রহমান, বাবু আহাম্মেদ ও আব্দুল খালেক, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা কবির হোসেন ও কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের নেতা আবুল কালাম আজাদ। 

সোমবার দুপুরে গুলশান থেকে মনিরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিদের রবি ও সোমবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, কাজী মনিরুলের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় সাতটি হত্যা মামলাসহ ১২টি মামলা রয়েছে। তাঁকে আজ মঙ্গলবার আদালতে তুলে রিমান্ড আবেদন করা হবে।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার অন্যরা বিভিন্ন থানায় হওয়া মামলার এজাহারনামীয় আসামি। তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানাভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছিল।

ফরিদপুর সদরে মিছিলের প্রস্তুতিকালে রোববার রাতে আওয়ামী লীগের আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জ সদরে শিবু মার্কেট এলাকায় সোমবার ভোরে মিছিলের প্রস্তুতিকালে আওয়ামী লীগের সাত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফতুল্লা থানার ওসি শরীফুল ইসলাম জানান, তাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হত্যাচেষ্টার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

সাভারে পৃথক অভিযানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার মামলায় কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কিশোরগঞ্জে রোববার সকালে আওয়ামী লীগের ব্যানারে ঝটিকা মিছিলের পর রাতে মো. রবিন নামে যুবলীগের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

খুলনায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলকে কেন্দ্র করে পৃথক তিনটি মামলা করেছে পুলিশ। রোববার রাতে নগরীর হরিণটানা, আড়ংঘাটা ও খালিশপুর থানায় মামলাগুলো করা হয়। এসব মামলায় ১১৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১৩০ জনকে আসামি করা হয়।

খুলনা মহানগর পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার জানান, তিন মামলায় সোমবার দুপুর পর্যন্ত ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলে অংশ নেওয়ায় সোমবার খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) লাইসেন্স অফিসার রবিউল আলম রবিকে গ্রেপ্তার করেছে সদর থানা পুলিশ। ডুমুরিয়ায় খুলনা জেলা ছাত্রদল সহসভাপতি মনিমুর রহমান নয়নের নির্বাচনী প্রচারে বাধা ও হামলার ঘটনায় করা মামলায় কাজী আলমগীর হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। 

কুড়িগ্রামে আওয়ামী লীগের ৩১ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাশকতাবিরোধী মামলা থাকায় রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া রোববার রাতে ছাত্রলীগের রংপুরের পীরগঞ্জ পৌর কমিটির সভাপতি মাহমুদুল হক সাগর এবং ভেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

দিনাজপুরের হাকিমপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় রোববার রাতে অনিক সরকার নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি হাকিমপুর পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ফুলবাড়ী উপজেলায় বিএনপির মিছিলে ককটেল হামলার মামলায় রোববার রাতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও তাঁতী লীগের তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

কুমিল্লায় মধ্যরাতে মিছিলের পর বিভিন্ন স্থান অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগের আট নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কোতোয়ালি থানার ওসি মাহিনুল ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ লাইনে এবং আলেখারচর এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি ও সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় মশাল মিছিল করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি রোববার গভীর বা ভোর রাতের কোনো এক সময় হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের।

(তথ্য দিয়েছেন সমকাল প্রতিবেদক, সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যুরো, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতা)

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আওয় ম ল গ গ র প ত র কর ছ ন ত কর ম ক র রহম ন স মব র উপজ ল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর সমন্বয় ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কার টেকসই হবে না

নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কার টেকসই হবে না। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নিয়মিত সভা করে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জোগান ও ব্যাংকের মূলধন কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। মূলধন জোগান দেওয়া ছাড়া শুধু সংকটে পড়া ব্যাংক নয়, ভালো ব্যাংকগুলোকেও ভুগতে হতে পারে।

‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থা পুনরুদ্ধার: মূলধন এখন কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এমন অভিমত উঠে আসে। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ আজ সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, ব্যাংকার, পুঁজিবাজারের অংশীজনেরা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ।

বক্তারা বলেন, ব্যাংকে পর্যাপ্ত মূলধন হলো আর্থিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি, যা আমানতকারীদের সুরক্ষা দেয়, তারল্য বজায় রাখে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা টিকিয়ে রাখে।

এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের জাতীয় বিনিয়োগ কৌশল নেই। ফলে বিনিয়োগ বাড়াতে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলোর সমাধান হচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়াতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোও বিভিন্ন বাধা তৈরি করে রেখেছে। এসব দূর করা জরুরি। ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বন্ধ করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তুলতে হবে। ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য মূলধন বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল পরিচালন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি বেড়ে গেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে। আগে যে ভুল হয়েছে, তা শোধরাতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় খুবই জরুরি। তবে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান ও. রশিদ বলেন, ব্যাংকের শেয়ারধারণে ২ শতাংশ কোনো ইস্যু নয়। সমস্যা হলো সুশাসন ছিল না। একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে একজনের বেশি পরিচালক না দিলেই হয়। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা দরকার। ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে আর বন্ড নয়, শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে এক টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।

আল–আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে যে শীতল যুদ্ধ চলে, তার অবসান হওয়া দরকার। এনআই অ্যাক্টে মামলা হলে শুনানির তারিখ পেতে এক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ আদায়ে সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকের মূলধনে বাড়াতে দেশের পাশাপাশি বিদেশি তহবিলের দিকেও নজর দিতে হবে। বিদেশ থেকে এখনো কম খরচে তহবিল পাওয়া সম্ভব। এ জন্য সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে।

সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে অনেক ভালো নিয়মকানুন ছিল। আমরা ধীরে ধীরে তা থেকে সরে এসেছি। সুদের হারে ৬/৯–এর মতো তত্ত্ব চালু করে আমরা সারা বিশ্বকে শিখিয়েছি। এর প্রতিদান এখন আমরা পাচ্ছি। এ জন্য আন্তর্জাতিক চর্চা মেনে চলতে হবে। যেসব ব্যাংকে মূলধন জোগান দিয়েও ঠিক করা যাবে না, সেগুলোতে টাকা ঢালা ঠিক হবে না। যেসব ব্যাংক ঠিক হওয়া সম্ভব সেগুলোর এবং ভালো ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়াতে হবে।’ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধার কারণ দেশে নতুন আর্থিক পণ্য চালু করা যায় না বলে জানান তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, মূলধন বাড়াতে সরকারের গ্যারান্টি–নির্ভর বন্ড চালু করতে হবে। তবে দেশের মানুষের বন্ডে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা ভালো না। ১৯৯৫ সালে চালু হওয়া বন্ডের টাকা এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি। ব্যাংকগুলোর বন্ড এখন ক্লাব নির্ভর হয়ে গেছে। এক ব্যাংকের বন্ড অন্য ব্যাংক কিনছে। বন্ডে বিনিয়োগে ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তাদের কিনতে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার এ এফ নেছারউদ্দিন বলেন, ব্যাংক খাতে এই দুরবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক একীভূতকরণই যথেষ্ট নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হওয়াটা নিশ্চিত করতে সময়োপযোগী সংস্কার, স্বচ্ছ প্রতিবেদন প্রকাশ, স্বতন্ত্র মূল্যায়ন এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য মূলধন পুনর্গঠন কাঠামো দরকার।

সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার সৈয়দ আফজাল হাসান উদ্দিন বলেন, ধীর আইনি প্রক্রিয়া বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার এবং বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় বিনিয়োগকারীদের শক্তিশালী আস্থা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরী বাণিজ্যিক আদালত দরকার। যারা অর্থ তছরুপ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও খেলাপির মামলা দিয়ে শেয়ার বাজেয়াপ্ত করলে কিছুটা ফলাফল পাওয়া যেত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ