রিকশার সঙ্গে মোটর লাগিয়ে স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি করা ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় রীতিমতো বিপর্যয়রূপে দেখা দিয়েছে। এ-জাতীয় রিকশা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আগে থেকেই নাজুক অবস্থায় থাকা রাজধানীর ট্রাফিকব্যবস্থা পুরোপুরি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি হওয়া এ রিকশা দুর্ঘটনারও বড় কারণ। সড়কের শৃঙ্খলা, দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও জীবিকা—এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে সরকারকে ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাপারে কঠোর ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিকল্প নেই।

প্রায় দুই কোটি মানুষের রাজধানী শহর ঢাকা এমনিতেই বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর। বিগত কোনো সরকারই নাগরিকদের সেবার কথা চিন্তা করে ঢাকায় একটি সুশৃঙ্খল ও নাগরিকবান্ধব গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলেনি। বরং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের হাতে পরিবহনের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে কতিপয় পরিবহন নেতার কাছে নাগরিকেরা জিম্মি হয়ে পড়েন।

একটি আধুনিক নগরে জনসংখ্যার তুলনায় যে পরিমাণ সড়ক থাকা দরকার, সেটা নেই। এরপর আবার এসব সড়কে দ্রুত, মাঝারি, ধীরগতির মিলিয়ে প্রায় ১৮ ধরনের যানবাহন চলাচল করে। নতুন করে ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীর সড়কের নৈরাজ্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মফস্‌সল শহর ও গ্রামাঞ্চলে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান জীবিকার একটা বড় অবলম্বন হয়ে উঠেছে। সে তুলনায় ঢাকার শহরে এ-জাতীয় রিকশার দেখা মিলত না বললেই চলে। কিন্তু শুরুতেই কঠোর অবস্থান না নেওয়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বাড়তে থাকে। গত বছরের মে মাসে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর চালকেরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তখনকার সরকার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে। এরপর ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় যে শিথিলতা আসে, তার সুযোগে পুরো ঢাকার সড়ক ছেয়ে যেতে থাকে ব্যাটারিচালিত রিকশায়। পরিস্থিতি এখন এমন যে উড়ালসড়কেও রিকশা নিয়ে উঠে পড়ছেন চালকেরা।

ঢাকার সড়কে ঠিক কতসংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে, তার হিসাব কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। কম পরিশ্রমে অপেক্ষাকৃত বেশি উপার্জন করা যায় বলে অনেকেই এ পেশায় ঝুঁকছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যেভাবে কলকারখানা বন্ধ হয়েছে এবং নির্মাণশিল্পসহ অন্য অনেক খাতে কাজের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় অনেকে ঢাকায় এসে জীবিকা হিসেবে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে বেছে নিয়েছেন।

ব্যাটারিচালিত রিকশার মূল সমস্যা এর নিয়ন্ত্রণহীন গতি। ব্রেকিং সিস্টেম-কাঠামো দুর্বল হওয়ায় এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরই) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে সারা দেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৮২টিই ছিল মারাত্মক। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য জানাচ্ছে, এবারের ঈদুল ফিতরের ছুটির সময় মোট যে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, তার সাড়ে ১৪ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে হয়েছে।

বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় হুট করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা কঠিন। কিন্তু সড়কের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারের আপস করার কোনো সুযোগ নেই। গুলশান-বনানীর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করতে গেলে গত সোমবার চালকেরা শুধু বিক্ষোভই করেননি, পথচারীদের মারধরও করেছেন, প্যাডেলচালিত রিকশা লেকে ফেলে দিয়েছেন। এ ধরনের নৈরাজ্যকে সরকারকে অবশ্যই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

জীবিকার প্রশ্নটি মাথায় রেখেই এ-জাতীয় রিকশার ব্যাপারে সরকারকে একটা পরিষ্কার সিদ্ধান্তে আসতে হবে। পর্যায়ক্রমে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ হিসেবে মূল সড়কে যাতে এ-জাতীয় অবৈজ্ঞানিক বাহন কোনোভাবে চলতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তা ছাড়া প্যাডেলচালিত হোক আর ব্যাটারিচালিত হোক—কোন শহরে কত রিকশা চলবে, তা নির্ধারণ করে সব রিকশাকে নিবন্ধনের আওতায় আনাতে হবে। অলিগলিতে যেসব ব্যাটারিচালিত রিকশা চলবে, সেগুলো যাতে ধাপে ধাপে নিরাপদ করা যায়, তার জন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার নকশা করতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ দ র ঘটন র সড়ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাণিজ্যবিরোধ: ভারত কেন ট্রাম্পের নিশানায়

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের বাণিজ্যনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় পণ্যের ওপর হোয়াইট হাউসের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তুতি নেওয়ার পর থেকেই এ আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে।  

ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর প্রশাসন আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করছে এবং এর পাশাপাশি অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্রাম্প যখন বিশ্বের বহু দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছিলেন, তখনই ভারতকে উদ্দেশ করে তাঁর এমন কঠোর অবস্থান সামনে উঠে আসে।

হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

‘ভারতের শুল্ক বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ’, গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্য করেন ট্রাম্প। জবাবে ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা ট্রাম্পের বক্তব্য ‘লক্ষ্য করেছে’ এবং এর ‘প্রভাব মূল্যায়ন’ করবে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্যবিরোধ: পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে

আজ থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ট্রাম্পের ধার্য করা ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক গত ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে ঘোষিত সম্ভাব্য শুল্ক থেকে মাত্র ১ শতাংশ কম।

এ হার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ শুল্কের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে  চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশ শুল্কের চেয়ে কিছুটা কম।

হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এ শুল্ক ভারতের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা আরও জটিল করে তুলতে পারে। একাধিক দফা আলোচনার মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ১২তম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়া অনেক কোম্পানির নতুন গন্তব্য হয়েছে দেশটি। মে মাসে অ্যাপলের সিইও টিম কুক জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির জন্য আইফোন এখন ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে; যাতে উচ্চ শুল্ক এড়ানো যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের (ওটিআর) তথ্যমতে, গত বছর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৯ বিলিয়ন (১২ হাজার ৯০০ কোটি) ডলার। ভারতের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক, রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি ও কৃষিপণ্য।

ট্রাম্প কেন ভারতকে নিশানা করছেন

সম্প্রতি ট্রাম্প একাধিকবার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভারতের ‘অতি উচ্চ’ শুল্ক আরোপের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যও রয়েছে।

বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, ‘বছরের পর বছর আমরা ভারতের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, তাদের শুল্ক অত্যন্ত বেশি।’

এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা।ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট

দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে ভারত কিছু পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করেছে।

ওটিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে পণ্যবাণিজ্যে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের ঘাটতি দেখেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। তুলনামূলকভাবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন (২৯ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের বাণিজ্যঘাটতিতে ছিল।

আরও পড়ুনভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা, ইরানের পণ্যের বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ ৩১ জুলাই ২০২৫

ট্রাম্প আরও ক্ষুব্ধ যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে।

‘এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা’, বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন ট্রাম্প।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত সরকার ট্রাম্পের ওই বক্তব্যে তুলনামূলকভাবে মৃদু, তবে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

ভারতের ওপর ধার্য করা শুল্কহার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কম।

বুধবার দেওয়া এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কয়েক মাস ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিকভাবে লাভজনক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’

আগস্টের শেষ দিকে দুই দেশের মধ্যে আরেক দফা বাণিজ্য আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

আরও পড়ুনভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য আলাদা ‘দণ্ড’৩০ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্কে ভারতের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কী বলছেন অর্থনীতিবিদেরা১৪ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ