ক. এক শাসকের পতনের পথরেখা

জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের যাত্রাপথ

জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের যাত্রা যে পথে শুরু হয়েছিল, শেখ হাসিনার অচিন্তনীয় এক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত রূপ নেয়। তাঁর শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণ–আন্দোলন মোকাবিলায় তিনি ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। শিশুসহ সাধারণ নাগরিক এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গুলি করতে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে তিনি রাজনৈতিক ও নৈতিকতার দিক থেকে অমার্জনীয় এক কাজ করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে পুলিশ, র‍্যাব ও বর্ডার গার্ডের পথে না হেঁটে সেনাবাহিনী নির্দেশটি মানতে অস্বীকৃতি জানায়। তা না হলে একটি গণহত্যা ঘটে যেতে পারত।

মানুষের ওপর গুলি চালানোর জন্য সেনাবাহিনীকে সর্বশক্তি প্রয়োগের যে নির্দেশ শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী সেটি না মানায় পুরো ঘটনার মোড় বদলে গিয়েছিল। এর পরিণতিতে ৫ আগস্ট ৪৫ মিনিটের নোটিশে তাঁকে গণভবন ছাড়তে হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালাতে রাজি না হওয়ার কারণে সরকার পরিবর্তনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়।

১৯৯০ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন সেনাপ্রধান নুরুদ্দিন খান তাঁর সর্বাধিনায়কের (রাষ্ট্রপতি) সমর্থনে সেনা মোতায়েন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে রক্ষায় সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব খারিজ করে দেন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। এর মধ্য দিয়ে তিনি সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সহায়তা করতে উদ্যোগী হন। তাঁকেও বেছে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর ভাই মেজর সাঈদ এস্কান্দার আর মইন ইউ আহমেদ ছিলেন একই ব্যাচের।

এসব ঘটনা থেকে মনে হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ রয়েছে, যা ব্যক্তিগত আনুগত্যের ঊর্ধ্বে। ঐতিহাসিকভাবে যখন কোনো অজনপ্রিয় সরকারের সুরক্ষার জন্য বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তখন তা প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা দেখিয়েছে সেনাবাহিনী। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ধরনের নজির কেমন আছে, আমি জানি না।

যেটি ঘটেছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী তা হলো, শেখ হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ। অধ্যাপক ইউনূসের অনুরোধে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের ঘটনা অনুসন্ধান করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। জাতিসংঘ পাঁচ শতাধিক পাতার তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে জুলাই ও আগস্টের ঘটনাগুলো নিয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসেবে কাজ করবে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত নিজেদের বার্ষিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছে ওএইচসিএইচআর। দেশের নাগরিকদের হত্যার নির্দেশ দেওয়ার জন্য ঢাকায় শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের যে বিচার হতে যাচ্ছে, সেখানেও সাক্ষ্য হিসেবে কাজ করবে এই প্রতিবেদন। তবে ওএইচসিএইচআরের সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর সুনির্দিষ্ট কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে, যাতে বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও বাইরের তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা যায়।

শেখ হাসিনার শাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা ২০২৪ সালের জুলাই মাসে হ্রাস পেতে শুরু করেনি। বিরোধীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার, নাগরিকদের গুম, নির্যাতন, গণমাধ্যমের ওপর দমন–পীড়নের মাধ্যমে মানবাধিকারের লঙ্ঘনও শেখ হাসিনার ১৬ বছরের অগণতান্ত্রিক শাসনকে কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূলে যে অপশাসন ছিল, ইউনূসের গঠন করা বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও একটি টাস্কফোর্সের তৈরি শ্বেতপত্রে অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে অনেক অপকর্ম চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো পর্দার অন্তরালে থাকা অন্ধকারকে সামনে এনেছে। এসব অপকর্মের মাত্রা হতবাক করে দেওয়ার মতো। তা অর্থনীতির ওপর, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। তিনটি ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা নাগরিকদের চোখে শেখ হাসিনাকে আরও অবৈধ করে তুলেছিল।

সীমান্তের ওপারের বিচ্যূত দৃষ্টিভঙ্গি

বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার অন্তরঙ্গ পুঁজিপতি চক্রের লাগামহীন দুর্নীতি তাঁর এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করেছে এবং তা নিজেই আমাদের পরিস্থিতি মূল্যায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার–সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ড, নির্বাচন–জালিয়াতি, মানবাধিকারের পদ্ধতিগত লঙ্ঘন এবং শিল্পপর্যায়ের দুর্নীতি ভারত সরকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে বলে মনে হচ্ছে। ভারতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন গণমাধ্যমে ইউনূস–সরকারকে নিয়ে খেয়ালখুশিমতো কথা বলে যাচ্ছেন, শেখ হাসিনার পতন নিয়ে পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক বয়ান প্রচার করছেন। সৌভাগ্যবশত ভারতের সব বিশ্লেষক এই মিথ্যা বয়ানে বিশ্বাস করেন না। যদিও বাংলাদেশের ভারতীয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা এই অভ্যুত্থানের অন্ধকার প্রেক্ষাপট এবং এর পরিণতি সম্পর্কে কম কথা বলছেন বা কিছুই বলছেন না। বর্তমান ঘটনাবলি নিয়ে তাঁদের মন্তব্য যতই ভালো হোক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁরা এসব ঘটনা সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা নিচ্ছেন, ততক্ষণ অবধি গল্পটা অসম্পূর্ণ ও ব্যাখ্যাহীন থেকে যাচ্ছে। আর তা বাংলাদেশিদের চোখে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব তীব্রতর করে তুলছে।

সরকারি পর্যায়ে যেকোনো অর্থবহ আলোচনায় অংশ নিতে ভারত সরকার যে অনীহা দেখিয়ে যাচ্ছে এবং অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আলাপ শুরু করতে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রথম দিকে যে অনিচ্ছা দেখিয়েছেন, তা বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের পরিবেশকে আরও খারাপ করে তুলেছে। ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থানের কারণে এ সম্পর্ক এরই মধ্যে আবিল হয়ে উঠেছে। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশিকে ভিসা দেওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের অনীহাও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতিবাচক অবস্থান সামনে এসেছে, যা আমাদের দুই দেশেরই স্বার্থের বিরুদ্ধে। বর্তমানে ভারতে পর্যটকদের সবচেয়ে বড় উৎস সম্ভবত বাংলাদেশ। কলকাতায় তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে স্থানীয় ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে।

বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শক্তিশালী ও ভারসাম্যপূর্ণ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গুরুত্ব নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার এই প্রয়াস অবশেষে অগ্রগতি পায় সম্প্রতি ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের বৈঠকের মধ্য দিয়ে। বহুল প্রতীক্ষিত ওই বৈঠকে দুই পক্ষের অভিন্ন উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সাক্ষাতের সময় মোদিকে একটি ছবি উপহার দিয়েছিলেন ইউনূস। ২০১৫ সালের ওই ছবিতে তাঁকে একটি বিশেষ সম্মাননা দিতে দেখা যায় মোদিকে। ভারতজুড়ে ইউনূসকে যে কতটা শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়, ওই ছবির মাধ্যমে সেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ব্যাংককের সাক্ষাৎ হয়তো উভয় পক্ষের সাদৃশ্যপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। তবে তা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, আরও নিয়মিত ও অর্থবহ সংলাপ আবার শুরু করা যেতে পারে। আগাম কোনো নোটিশ ছাড়াই ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে কার্গোতে করে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুযোগ (ট্রান্সশিপমেন্ট) স্থগিত করার ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না।

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে গেলে ছাত্র–জনতার দখলে চলে যায় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা। ৫ আগস্ট.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউন স র র ওপর সরক র আগস ট ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ