অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ সুফিউর রহমানকে ‘আওয়ামী লীগের প্রোডাক্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।

এ ছাড়াও, প্রধান উপদেষ্টার ডানে-বাঁয়ে এমন আরও সরকারি কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা পরিষদের কিছু সদস্য রয়েছেন, যাঁরা তাঁকে সঠিক পথে চলতে দেবেন না উল্লেখ করে তাঁদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে বলেছেন বিএনপির এই নেতা।

আজ বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে মির্জা আব্বাস এসব কথা বলেন। ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র, সংস্কার ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এ সভার আয়োজন করে গণতন্ত্র ফোরাম।

মির্জা আব্বাস বলেন, ‘ড.

ইউনূসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, কয়েকদিন আগে যে লোককে নিয়োগ করা হয়েছে, সুফিউর না কী নাম, এ তো আওয়ামী লীগের প্রোডাক্ট। আরও আওয়ামী লীগের প্রোডাক্ট আপনার ডানে–বাঁয়ে আছে। দয়া করে এদের কাছ থেকে সাবধানে থাইকেন। এরা পাঁচজন (কয়েকজন সচিব) এবং আপনার উপদেষ্টা পরিষদের কিছু লোক আপনাকে সঠিক রাস্তায় চলতে দেবে না। আপনার সারা জীবনের অর্জন, আপনি নোবেল লরিয়েট...এরা শেষ করে দেবে।’

মির্জা আব্বাস আরও বলেন, ‘জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নির্বাচন দেবেন। ড. ইউনূস বলেছেন ডিসেম্বরে না হোক, জুনে হবে। এ কথাটাই আমাদের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একবার বললেন ডিসেম্বর, আবার বললেন জুন...আপনি ডিসেম্বরে বলার পরপরই অন্য আরেকজন বলে দিল জুনে। পরে আপনি এটাকে এনডোরস (অনুমোদন করা) করলেন। এ বিষয়ে সন্দেহ করার মতো যথেষ্ট যুক্তি আছে নির্বাচনটা যেন না হয়।’

বিদেশে কিছু সরকারি সাংবাদিক আছে, ওদের সরকারে না নিয়ে এই গভর্নমেন্ট ভুল করে ফেলছে আর কী-মন্তব্য করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘উচিত ছিল, তাঁদের সরকারে নেওয়া। তাঁরা আবার খুব ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আমার বক্তব্যগুলো কাটপিস করে এমনভাবে জনগণের সামনে হাজির করা হয়, যাতে জনগণ আমার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়। এ জন্য এখন বক্তব্য দিতে খুব হিসাব করে দিতে হয়।’

‘আমি বিশ্বাস করছি না, আশা করছি। সম্ভবত নির্বাচন খুব তাড়াতাড়ি তাঁরা করবেন না। আমি তার কোনো লক্ষণ দেখি না। কয়েকটা দল যা শুরু করেছে, এটা না হলে নির্বাচন হবে না, ওইটা না হলে নির্বাচন হবে না। যদি এগুলো হইতে থাকে, তাহলে নির্বাচন কেমন হবে? কেউ কেউ বলেই ফেলেছেন, নির্বাচনে যাব না। কয়েকদিন আগে হইলেন, নির্বাচনে গেলেই কী আর না গেলেই কী’, বলেন মির্জা আব্বাস।

নির্বাচন আর সংস্কার বিষয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আজ একটা অবস্থা এসেছে, দেশের নির্বাচন না সংস্কার। নির্বাচন না সংস্কার যদি আলাপ করি, অনেক লম্বা আলাপ হবে। ছোট একটা কথা কি জানেন? নির্বাচনের বিকল্প শুধু নির্বাচনই হতে পারে। অন্য কিছু হতে পারে না। এখন আমি বুঝি না, আমি কথা বললেই বলবে, মির্জা আব্বাস সংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলে। সংস্কার চায় না। আরে ভাই না। আমাদের জন্য, নির্বাচনের জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যে সংস্কারটুকু প্রয়োজন আমরা সেই সংস্কারটুকু চাই।’

‘আমরা সংস্কার চাই, নির্বাচনও চাই’ উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘কোন সংস্কার চাই? যেটা দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় সংস্কার যেটা আরও বিপদ ডেকে আনবে, এমন সংস্কার আমাদের প্রয়োজন নাই।’

বিদেশে কিছু সরকারি সাংবাদিক আছে, ওদের সরকারে না নিয়ে এই গভর্নমেন্ট ভুল করে ফেলছে আর কী—মন্তব্য করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘উচিত ছিল, তাঁদের সরকারে নেওয়া। তাঁরা আবার খুব ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আমার বক্তব্যগুলো কাটপিস করে এমনভাবে জনগণের সামনে হাজির করা হয়, যাতে জনগণ আমার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়। এ জন্য এখন বক্তব্য দিতে খুব হিসাব করে দিতে হয়।’

‘আজকে যখন এখানে বসেছি, কথা বলছি, দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমরা ১৭ বছর রাজপথে আন্দোলন করেছি। এই ১৭ বছরে বিএনপির প্রায় ৫ হাজার কর্মী নিহত হয়েছেন, ৫ হাজারের বেশি কর্মী গুম-খুন হয়েছেন, আমাদের জেল খাটতে হয়েছে বছরের পর বছর, মাসের পর মাস’, বলেন মির্জা আব্বাস।

মির্জা আব্বাস বলেন, ‘কিন্তু আমি একবার বলেছিলাম, আপনারা যে সংস্কার চাচ্ছেন, সব সংস্কার তো মানা যাবে না। এই কথা টুইস্ট করে আমাদের কয়েকজন বিদেশে অবস্থানরত তথাকথিত সাংবাদিক টুইস্ট করে এমনভাবে বললেন, বিএনপি সংস্কার চায় না, মির্জা আব্বাস সংস্কার চায় না। এমনকি, সালমান রহমানের টাকা খেয়ে যাঁর স্বাস্থ্য চেহারা মোটা হয়েছে, এমন লোকটা প্রায়ই আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে আসেন। উনি প্রায়ই বলেন, ‘‘কেন মানবেন না? আপনাদের কী স্টেক আছে, কেন মির্জা আব্বাস এটা মানবেন না?’’ তোমার যেমন বিদেশে পালায় থেকে কথা বলার অধিকার আছে, আমার কি দেশে থেকে কথা বলার অধিকার নাই? আপনারা তো পালায় গিয়ে লম্বা লম্বা কথা বলতেছেন, কোনোদিন দেশে আসবেন না।’

আরও পড়ুনওদের হাতের কোনো সংস্কার আমরা সহজে মেনে নেব না: মির্জা আব্বাস১৬ মার্চ ২০২৫

মির্জা আব্বাস বলেন, ‘যাঁরা দেশের বাইরে ইউটিউবার আছেন, সম্মান রেখেই বলতে চাই, আমরা রাজনীতি ছেড়ে দেব। আপনারা দেশে আসেন। আপনাদের অনেক জ্ঞান, অনেক বুদ্ধি। আপনাদের জ্ঞান–বুদ্ধি অনেক প্রয়োজন। দয়া করে দেশে আসেন, বুদ্ধি দেন, কথা বলেন, কাজ করেন, মেনে নেব। আমরা রাজনীতি করব না, ছেড়ে দেব। দেশে আসবেন না, আবার টিটকারি মেরে কথা বলবেন, সমালোচনা করবেন, জাত-গুষ্টি উদ্ধার করবেন, এটা কেমন কথা? মিথ্যা কথা বলবেন, অপপপ্রচার করবেন, আ-কথা, কু-কথা বলবেন, একটা মানুষের চরিত্র হনন করবেন, এগুলা কী? যাঁরা ফেসবুক চালান, তাঁরা এগুলোর জবাব দিয়ে দেবেন। সোজা হয়ে যাবে।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘খেয়াল করলাম, এনসিপির (নতুন আত্মপ্রকাশ করা দল) এক ছেলে বলে ফেলল, এখন নির্বাচন করা সম্ভব না। কারণ, প্রশাসনের সব জায়গায় বিএনপির লোক বসা আছে। ১৭ বছর আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করল, বিএনপির লোক কই পাইলেন, আমি তো বুঝলাম না। ১৭ বছরে বিএনপির লোক মইরা ভূত হয়ে গেছে। একটাও নাই। আপনারা বলেন সব বিএনপির লোক প্রশাসনে বসে আছে। এসব কথা নেহায়াতই বাচ্চাদের মতো করে বলছেন। দেশটাকে আরেকবার মুক্ত করেন না। প্রশাসনে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, সচিবালয়ের ভেতর দেশের যে শত্রুগুলো বসে আছে, আওয়ামী লীগের দালাল বসে আছে, তাদের কেন আপনারা বের করেন না? যদি বলি তাদের কাছ থেকে আপনারা অবৈধ সুবিধা পাচ্ছেন।’

অনেকে বলেন, আগে বিচার করতে হবে, পরে নির্বাচন। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আপনারা তো আমাদের চাইতে বেশি অত্যাচারিত না। ৫ আগস্টের কথা যদি বলেন...৪ আগস্ট আমাদের মনে আছে না? আমি তো নিজে রাজপথে ছিলাম। নিজে কাকরাইল মোড়ে ছিলাম, টিয়ারশেলের মুখে। আমাদের ৪৬২ জন ছেলে মারা গেল, ৩০ হাজারের মতো আহত হলো। আমাদের কোনো অবদান নাই? অনেকে বলে, আপনারা সারেন্ডার করে ঘরে ঢুকে গেছিলেন। যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা, ইসলামী ছাত্রশিবির কিংবা বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল না বের হতো তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াতো। কৃতিত্বের দাবিদার একা হওয়ার চেষ্টা করবেন না। ক্ষতি হবে দলের ও দেশের। দেশটা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। দেশকে বিভক্ত করা গেলে আবার এ দেশকে ভারতীয় আধিপত্যের হাতে চলে যেতে হবে।’

আরও পড়ুন‘দেশটা কারও বাপের না’ বললে আমার গায়ে লাগে: মির্জা আব্বাস২৪ মার্চ ২০২৫

নির্বাচন নিয়ে কোনোরকম ধোঁয়াশা সৃষ্টি না করার অনুরোধ জানান মির্জা আব্বাস। বলেন, ‘এখন কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। আমার দিক থেকে বলতে পারি, আমার যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, এটা আমার কথা, দলের না। যা অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, বলেছিলাম, সব কথা তো মানা যাবে না। সবাই কী সব কথা মানছে। যে আলোচনা এতদিন হচ্ছে, কেউ ১০টা মানছে, কেউ পাঁচটা মানছে, কেউ ১৫টা মানছে এবং কারেকশন হচ্ছে। আমি তো এ কথাটা একমাস, দুইমাস আগে বলেছি।’

আলোচনা সভায় গণতন্ত্র ফোরামের সভাপতি ভি পি ইব্রাহিমের সভাপতিত্বে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ বক্তব্য রাখেন। সভা সঞ্চালনা করেন গণতন্ত্র ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান।

আরও পড়ুনসেকেন্ড রিপাবলিক কী, এখনো বুঝি নাই: মির্জা আব্বাস০২ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ল ক ক ষ প ত হয় দ র সরক র গণতন ত র ম হ ম মদ উপদ ষ ট ১৭ বছর র জন য আম দ র সদস য আওয় ম করব ন ইউন স অবস থ আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়

নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই কিছু পরিচিত দৃশ্য আবার চোখে পড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ অবস্থানকে একমাত্র ন্যায়সংগত দাবি হিসেবে তুলে ধরা, ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থতা এবং একে অপরের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা। রাজনৈতিক অচলাবস্থা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধুই অচলাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এটি বরং রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্বের প্রকাশ এবং রাজনীতি জনগণের চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার একটি সংকেত। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রশ্ন, যা আমরা এখনো করিনি: রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী?

২.

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের জাতীয়তাবাদের অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে—কখনো ‘বাংলাদেশি’ বনাম ‘বাঙালি’, কখনো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বনাম ‘ইসলামপন্থা’ পরিচয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই শব্দগুলো বাস্তবে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; একদিকে জাতিসত্তার বৈচিত্র্যকে একরৈখিক করে তুলেছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘু এবং নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।

এই জাতিগত ও আদর্শগত পরিচয়ের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও। রাজনৈতিক দলগুলো জনসেবার বাহন না হয়ে পরিণত হয়েছে আত্মরক্ষামূলক ক্ষমতার বাহনে। পুরোনো দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, গরিবের পক্ষে কথা বলার দাবি করা বিভিন্ন বামপন্থী দল, এমনকি নাগরিকদের সক্রিয়তা নিয়ে কথা বলা নতুন দল এনসিপিও একই ছকে চলছে; প্রকাশ্যে জনগণের নামে বৈধতা চাওয়া আর ভেতরে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে দল চালানো।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল আনুগত্যের বিনিময়ে সুযোগের এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। দলগুলো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে, পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ করে এবং অনুগত একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে। স্থানীয় সরকার, যেখানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকার কথা, তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্রের স্বল্প ইতিহাস বলে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রায়ই জনগণের পক্ষে কথা বলা প্রতিনিধি নন, বরং তারা মধ্যস্থতাকারী মাত্র। এই ব্যবস্থায় নেতৃত্ব নয়, আনুগত্যই পুরস্কৃত হয়।

৩.

প্রায় সব রাজনৈতিক দলই অভ্যন্তরীণ দলীয় কার্যক্রমের দিক থেকে গণতান্ত্রিক নয়। নেতৃত্ব প্রায়ই বংশগত বা দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়াভাবে ধরে রাখা হয়। দলের মধ্যে ভিন্নমত দিলে শাস্তি হয়। কর্মীরা মিছিল-মিটিং বা গ্রেপ্তারে সামনে থাকলেও, নীতিনির্ধারণে তাঁদের কোনো অংশ থাকে না। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের এই অভাব বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। দলগুলো এখন প্রায় শূন্য খোলসে পরিণত হয়েছে।

সংসদেও এর প্রতিফলন স্পষ্ট। অনেক সংসদ সদস্যই তাঁদের নির্বাচিত এলাকার বাসিন্দা নন। তাঁরা সেসব এলাকায় বড় হননি, সেখানকার মানুষের সঙ্গে বসবাসও করেন না—সম্পর্ক থাকে কেবল প্রতীকী; বরং প্রাক্তন মন্ত্রী, নেতা কিংবা দলের উচ্চপদস্থ সদস্যদের সন্তান-স্বজনদেরই একপ্রকার উত্তরাধিকারসূত্রে সেখানে পাঠানো হয়। স্থানীয় নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রায়ই একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। রাজনীতির প্রতিটি স্তরে—থানা ইউনিট থেকে জাতীয় মনোনয়ন পর্যন্ত—ক্ষমতার প্রবেশাধিকার নির্ধারিত হয় বংশানুক্রম, আনুগত্য এবং আঞ্চলিকতার এক অঘোষিত নিয়মে; যেখানে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পত্তির মতো গণ্য হয়।

নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয়বহুল এবং মনোনয়ন একটি লেনদেনভিত্তিক প্রক্রিয়া—সম্পদ, সম্পর্ক এবং আনুগত্যই এখানে মুখ্য। নির্বাচন মানে পোস্টার, মাইকিং আর আগেভাগে অর্থ ব্যয় করে মিছিল-মিটিংয়ের মৌসুম। সাধারণ নাগরিকের জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব—যতক্ষণ না তিনি একই স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করেন। এমনকি যাঁরা সাম্প্রতিক সময়ে বিপ্লবী ভাষায় কথা বলছিলেন, তাঁরাও দ্রুত এই একই ছকে ঢুকে পড়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলো যখন তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন অন্যরা সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে। সুশীল সমাজ নিজেদের গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষক মনে করতে শুরু করে। আমলারা ও বিচারপতিরা নিজেদের সাংবিধানিক সীমার বাইরে গিয়ে হস্তক্ষেপ করেন। সেনাবাহিনী নিজেদের একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু এটি গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক বিকৃতি ও শাসনক্ষমতার দায়িত্বহীন পুনর্দখল।

৪.

এমন পরিস্থিতিতে মানুষের প্রকৃত চাহিদাগুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। ত্রাণ বিতরণ হয় দলের পতাকা লাগিয়ে, ছবি তোলা হয় এবং বিনিময়ে ভোট চাওয়া হয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ভোটার, যাঁদের বেশির ভাগই গ্রামীণ ও দরিদ্র, তাঁদের দয়া নয়, অধিকার প্রয়োজন। তাঁরা একটি বৈষম্যমূলক ও বিকৃত ব্যবস্থার শিকার—যেখানে সুবিধা, সম্পদ ও সুযোগ বণ্টিত হয় ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেমতো। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই এমন কোনো কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলে না, যা এই বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কারণ, এমন সংস্কার বাস্তবায়ন করলে যে ব্যবস্থা থেকে তাঁরা লাভবান হচ্ছেন, সেটাই বদলে দিতে হবে।

কেউ ভূমি সংস্কার, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা পুলিশের নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে চায় না। যেখানে সংস্কার থেমে যায়, সেখানে ক্ষমতা শুরু হয়। কাঠামোগত সংস্কার কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা কৌশল নয়। স্পষ্ট করে বললে, এ ধরনের পরিবর্তন নির্বাচনের আগে সমীচীন নয় আর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এর বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। এমন সংস্কার সফল হতে হলে একটি এমন সরকার প্রয়োজন, যারা সংবিধানকে শুধু ভাষণে নয়, বরং বাজেট, প্রাতিষ্ঠানিক নকশা এবং নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।

বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত আদর্শগত মতপার্থক্য নয়—এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই। অতীতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে এবং ভিন্নমত দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি নাগরিক সমাজের আন্দোলনগুলোকেও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বা অভিজাত গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। জনতার আন্দোলন প্রচার পায়; কিন্তু পরে তা দমন করা হয় অথবা নিস্তেজ হয়ে যায়। এনজিওগুলোর গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে আশার কথা শোনা যায়, কিন্তু সেখান থেকে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায় না।

৫.

এ রকম প্রেক্ষাপটে অনেকেই শুদু সংবিধানকেই দোষারোপ করছে, যেন এর দায় শুধু কাগজের শব্দগুলোর, যারা বছরের পর বছর সংবিধান উপেক্ষা করেছে, তাদের নয়। বাংলাদেশের সংবিধান ছিল একটি প্রতিশ্রুতি—কেবল সার্বভৌমত্বের নয়, বরং ন্যায়বিচারের। এই সংবিধান রাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সমতা, বৈষম্যহীনতা, মর্যাদা, ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের। এটি এমন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতিসত্তার ছবি এঁকেছিল, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মর্যাদা স্বীকৃত।

সংবিধানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিণতি বাস্তব এবং গভীর। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, পুলিশি নির্যাতন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি—এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একটি কাঠামোগত চিত্রের অংশ, যা বারবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এই চক্রে কোনো একক দল বা সরকার সম্পূর্ণভাবে দায়ী নয়। ঠিক এই কারণেই প্রয়োজন একটি সামগ্রিক জবাবদিহি, কেবল একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি।

যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি না থাকে, আর যদি নির্বাচন কেবল ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তবে এটি শুধু শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়—এটি একটি প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ১৯৯১ সালের পর যারা বড় হয়েছে, তাদেরকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা পেয়েছে ক্ষমতাবানদের মধ্যে বোঝাপড়া, যেখানে জনতার কণ্ঠ নেই; বিপ্লবের বুলি আছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন নেই।

এর ফলে আবারও সেই প্রশ্ন ফিরে আসে—রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী? তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? তাদের কাজ কি শাসন, দখল নাকি জনগণের সেবা? যদি রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সেবা না করে, তাহলে সেটা করবে কে?

ড. সিনথিয়া ফরিদ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, শিক্ষক ও গবেষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরানের শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান সাবেক শাহের পুত্রের
  • আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা ইশরাকের
  • রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়
  • বাজেটের ত্রুটি সংশোধনের আহ্বান
  • ড. ইউনূসকে দেশের কাজে যুক্ত রাখতে চায় বিএনপি
  • জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট
  • সহসাই রাজনীতির কালো মেঘ কেটে যাবে: ডা. জাহিদ  
  • ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানবে না জনগণ’