ভাটাগুলো অবৈধ। এর পরও চলছে ইট প্রস্তুতকরণের সব আয়োজন। শ্রমিকদের কেউ মাটি ভাঙছে, কেউ ইট তৈরি করছে। আবার কেউ ব্যস্ত চুল্লির আগুন জ্বালাতে। এ চিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের সাথী ও খান ব্রিকসে। দেখে বোঝার উপায় নেই; সাত দিন আগেই এই ইটভাটায় অভিযান চালিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

১৬ এপ্রিল নাচোলে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় ৩টি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। বায়ুদূষণ করার অপরাধে সাথী ব্রিকসকে ৩ লাখ টাকা, খান ভাটাকে ২ লাখ, আলিম ব্রিকসের মালিককে ২ লাখ টাকা জরিমানাসহ ভাটার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। অভিযানের দু’দিন পরই সাথী ও খান ব্রিকস চালু করা হয়েছে। 

ভাটা দুটির শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রশাসন কৌশলী অভিযান চালিয়েছে। অভিযানের সময় দুটি ভাটার মূল অংশ অক্ষত রাখা হয়। শুধু চিমনির পাশের সারি সারি সাজানো ইটগুলো ক্রেন দিয়ে এলোমেলো করা হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়। প্রশাসনের এ সহায়তায় মালিকরা আবারও ভাটা সচল করতে পারছেন বলে জানা গেছে। 

সাথী ব্রিকসের ম্যানেজার জানান, অভিযানের সময় কোনো রকমে চিমনিগুলো রক্ষা করতে পেরেছি। চুল্লিতে আগুন দিয়ে মজুত রাখা ইট পোড়ানো হচ্ছে। এগুলো শেষ হলেই ভাটা বন্ধ রাখা হবে। একই কথা বলেন খান ভাটার মালিক। 

এ উপজেলার কাজলা গ্রামের মতিউর রহমান ও একরামুল বলেন, ৩টি ইটভাটায় ম্যাজিস্ট্রেট ও র‍্যাবের সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালায়। তারা যাওয়ার পরদিনই সাথী ও খান ব্রিকস চালু হয়েছে। অবৈধ ভাটাগুলো আমাদের ফসল ও আমবাগানের ক্ষতি করছে। কাঠ পোড়ানোর ধোঁয়া ও ছাইয়ের কারণে বাড়িতে ভাত পর্যন্ত খেতে পারি না। 

কৌশলী অভিযানের এ চিত্র শুধু নাচোলে নয়; চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, ভোলাহাট ও শিবগঞ্জ উপজেলারও। নাচোলে ৮টি ইটভাটা রয়েছে। কোনোটিরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। শিবগঞ্জে ৩০টির বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। গত ছয় মাসে সদর উপজেলায় ৬টি, শিবগঞ্জে ৪টি; ১৭ এপ্রিল ভোলাহাটে ৫টি ও নাচোলে ৩টি ভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানার পর বন্ধের নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হয় মালিকপক্ষকে। কিছুদিন পরই শিবগঞ্জে ৩টি, সদরে ৪টি এবং নাচোলে ২টি ইটভাটা ফের সচল হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে– সম্পূর্ণ ধ্বংসের পর কীভাবে এত অল্প সময়ে ভাটাগুলো সচল হয়।

কাগজ-কলমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১১৩টি ভাটার মধ্যে ৯৩টিই অবৈধ। গত ৮ মাসে অভিযান চালানো হয়েছে মাত্র ১৮টিতে। কাগজ-কলমের বাইরেও ২০টির বেশি ইটভাটা রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে এসব ভাটা চালু করা হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে বলে দাবি করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসব ভাটা থেকে জরিমানা আদায় হয়েছে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। অভিযানের পর এসব ভাটা তদারকিতে দেখা যায়নি প্রশাসনের লোকজনকে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর উপজেলার এক ভাটার মালিক জানান, তাদের এলাকার ৪টি ভাটায় এক দিনেই অভিযান চালায়। জরিমানা করা হয় ২ লাখ টাকা। পরে প্রশাসনের পাঠানো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রত্যেক মালিক আরও ২ লাখ টাকা দেওয়া পর ভাটা চালুতে মৌন সম্মতি মেলে। অনেক মালিক অভিযানের ভয়ে আগেই ওই ব্যক্তিকে টাকা দিয়েছেন। তবে কোন অফিসের লোক এসে টাকা নিয়ে গেছে– জানতে চাইলে জবাব দেননি। 

অভিযোগ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, অভিযানে কোনো কৌশল অবলম্বন করা হয়নি। ১৭টি ভাটাই সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আবার কার্যক্রম চলছে, শুনলাম। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হবে। প্রশাসনের কেউ টাকা নিয়ে ভাটা চালুতে সহায়তা করেছে, এমন অভিযোগও সত্য নয়।

শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর রোড বাজার গ্রামের শাহিন আলি জানান, ঘটা করে দাদনচক এলাকার ২টি ভাটায় অভিযান চালানোর এক সপ্তাহ পর ভাটাগুলো আবার সচল হয়েছে। বিকল্পভাবে ইট পোড়ানো হচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের শিবগঞ্জ শাখার যুগ্ম সম্পাদক মামুন অর রশিদ জানান, জেলার সিংহভাগ ভাটা অবৈধভাবে চলছে। অভিযানও চলছে। অভিযানের ক’দিনের মাথায় আবার চালু হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, শুষ্ক মৌসুমে ভাটাগুলো কাঠ পুড়িয়ে ইট প্রস্তুত করল দেদার। বর্ষা মৌসুমে এমনিতেই ভাটাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে লোক দেখানো এসব অভিযানের মানে কী?

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ প ইনব বগঞ জ প ইনব বগঞ জ ইটভ ট য় শ বগঞ জ উপজ ল র

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে প্রথমবারের মতো ২৫টি ‘বেশি বিপদজনক’ বালাইনাশক চিহ্নিত

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষিতে হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগ ও পোকা। আবার এসব রোগ ও পোকা দমনে বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত বালাইনাশকের ব্যবহার। মাত্রাতিরিক্ত এসব বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার সরাসরি প্রভাব ফেলছে কৃষক, ভোক্তা ও পরিবেশের ওপর। ক্যান্সারসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকরা।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরিপ (২০১৫–১৭) অনুযায়ী, তাদের হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ তথ্যই প্রমাণ করছে—বিষ কীভাবে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষ ও পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে।

এ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে গবেষণা করে দেশে প্রথমবারের মতো বেশি বিপদজনক বালাইনাশক চিহ্নিত করেছেন একদল গবেষক। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত আটটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে দেশে নিবন্ধিত ৩৪৩টি সক্রিয় উপাদান বিশ্লেষণ করে মোট ২৫টি বেশি বিপদজনক বালাইনাশক চিহ্নিত করেন তারা। এই ২৫টি বালাইনাশকের মধ্যে ১১টি কীটনাশক, সাতটি ছত্রাকনাশক, পাঁচটি আগাছানাশক এবং দুইটি ইঁদুরনাশক। প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক পণ্যে এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়।

বুধবার (৩০ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকায় অবস্থিত তুলা ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে অধিক বিপদজনক বালাইনাশক ও রাসায়নিকের উন্নত ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক কর্মশালায় গবেষণায় প্রাপ্ত এসব তথ্য তুলে ধরেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. গোপাল দাস।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নয়টি বেশি বিপদজনক বালাইনাশক হলো- এবামেকটিন, ক্লোরপাইরিফস, প্যারাকুয়াট, গ্লাইফোসেট, গ্লুফোসিনেট অ্যামোনিয়াম, কার্বেন্ডাজিম, প্রোপিকোনাজোল, জিঙ্ক ফসফাইড ও ব্রোমাডিওলন। এছাড়া আরও কিছু বালাইনাশকের মধ্যম বা সীমিত ব্যবহার দেখা গেছে।

অন্যদিকে, সাইফ্লুথ্রিন, বিটা-সাইফ্লুথ্রিন, ট্রায়াজোফস, এডিফেনফস, ফ্লুলসিলাজোল নামক বালাইনাশকের তেমন কোনো মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার পাওয়া যায়নি, যা এখনই নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মত দেন গবেষকগণ।

এসব বালাইনাশকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ড. গোপাল বলেন, “এগুলো মানবদেহে ক্যান্সার, কিডনি বিকলতা, হৃদরোগ, ফুসফুসের জটিলতা এমনকি প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীকূল এবং পরিবেশেও দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া তৈরি করে। এসব বালাইনাশকের একটি বড় অংশ স্থায়ী জৈব দূষক হিসেবে পরিবেশে জমে থাকে বছরের পর বছর।”

গবেষণা শেষে ড. গোপাল দাসের নেতৃত্বে দেশব্যাপী ১৪টি অঞ্চলে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ, র‌্যালি, মাঠ প্রদর্শনী ও ১০টি আঞ্চলিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কৃষক, বালাইনাশক ডিলার ও কৃষি কর্মকর্তাদের সচেতন করতে নেওয়া হয় কার্যকর উদ্যোগ।

এ নিয়ে গবেষক ড. গোপাল দাস বলেন, “সরকারের উচিত, বেশি বিপদজনক বালাইনাশকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল বা নবায়ন বন্ধ করতে হবে এবং বিকল্প নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডিলারদের লাইসেন্স কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাঠপর্যায়ে বর্তমান আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে এই ক্ষতির হাত থেকে দেশের কৃষক ও কৃষি খাতকে রক্ষা করা সম্ভব।”

বেশি বিপদজনক বালাইনাশকের এই চিহ্নিতকরণ ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে টেকসই কৃষি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদী বাকৃবির এই গবেষক।

বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম। 

সম্মানিত অতিথি ছিলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ অঞ্চলের জ্যোষ্ঠ কারিগরি ও নীতি উপদেষ্টা মারটিজিন ভন দে গ্রোয়েপ। বিশেষ অতিথি ছিলেন, ডিএই এর প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম, বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) পরিচালক অধ্যাপক ড. এম. হাম্মাদুর রহমান।

কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষকদলের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন।

এ সময় দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞানীগণ, ডিএই কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কৃষক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. সাইফুল আলম বলেন, “আমরা বর্তমান প্রচলিত বালাইনাশক আইনের সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছি, যাতে জনগণকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি। তবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা আমরা অকপটে স্বীকার করি। এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “ক্ষতিকর কীটনাশকের অতি ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। এগুলো ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এসব বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা ২০২৫ সালে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। আমরা অবশ্যই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাই। তবে তা যেন পরিবেশের ক্ষতি করে না হয়, সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য জৈব কীটনাশক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছি।”

ঢাকা/লিখন/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ