ঢাকার শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স এখন ৫০০০ পয়েন্টের নিচে। গতকাল বৃহস্পতিবারের প্রায় ৫০ পয়েন্টসহ টানা ৯ দিনের দর পতনে ২৩২ পয়েন্ট হারিয়ে সূচকটি নেমেছে ৪৯৭২ পয়েন্টে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর বা প্রায় ছয় মাস পর ফের এ সূচক বিনিয়োগকারীদের ‘মনস্তাত্ত্বিক বাঁধ-সীমা’ ৫০০০ পয়েন্ট পেরিয়ে নিচে নামল। 
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসসহ শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, সূচকের এমন পতনের কারণ বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছেন। শেয়ারবাজারে কী হচ্ছে বা আগামীতে কী হতে যাচ্ছে– এ বিষয়ে কোনো ধারণা পাচ্ছেন না তারা।

বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, শেয়ারবাজার বর্তমান পতনের বড় কারণ ‘নেতৃত্ব সংকট’। শেয়ারবাজারকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের সততা নিয়ে হয়তো কোনো প্রশ্ন নেই, তবে সংবেদনশীল এ বাজারকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
জানতে চাইলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, গত আগস্টে দুর্নীতিগ্রস্ত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আট মাস কেটে গেছে। এখন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম চলছে। বিনিয়োগকারীরা এখন জানতে চান– শেয়ারবাজারে কী ধরনের সংস্কার হবে, ওই সংস্কার বিনিয়োগকারীবান্ধব হবে কিনা, এ জন্য কতটা সময় লাগবে, অতীতের দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার জন্য শেয়ারবাজারের বিদ্যমান ব্যবস্থায় বড় কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা? বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন অনেক মৌলিক প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন সবাই। কিন্তু উত্তর নেই। এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দেওয়ার কথা। কর্মকর্তারা জানান, সংস্থাটির নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের নানাভাবে বলা হলেও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। সংস্কারের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নে সাত মাস আগে টাস্কফোর্স গঠন হলেও শেয়ারবাজারে সুশাসন ফেরানো এবং যোগ্য নেতৃত্ব সংকট দূর করার বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব করতে পারেনি। ভবিষ্যতে এমন প্রস্তাব দিলেও তা বাস্তবায়নে কতদিন লাগবে, তা নিয়ে সন্দিহান সবাই। এর প্রভাব রয়েছে শেয়ারবাজারে।

দর পতনের স্বরূপ
গত ৯ দিনের দর পতনে ৮৮ শতাংশ শেয়ারই দর হারিয়েছে। গতকালের লেনদেনেও তালিকাভুক্ত তিন-চতুর্থাংশ শেয়ার দর হারাতে দেখা যায়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ৯ কর্মদিবসে তালিকাভুক্ত ৩৬০ কোম্পানির শেয়ার ও ৩৭ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৪৯টির দর হারিয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে ১৩০ শেয়ার, যেখানে মাত্র ৭টির দর ১০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এক সময়ের হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমেছে তিনশ কোটির ঘরে।
দেশের শেয়ারবাজারে এর আগে টানা ৯ দিন দর পতন হয়েছিল গত বছরের ১৩ থেকে ২৬ মে পর্যন্ত। তখন সূচকটি হারিয়েছিল প্রায় ৪৪৬ পয়েন্ট। অবশ্য গত বছরের টানা ৯ দিনের দর পতনের প্রেক্ষাপট আর এবারের দর পতনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা।

গত বছরের মে মাসের দর পতন ছিল স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার পতনের মাত্র তিন মাস আগের ঘটনা। পতিত ওই সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে অর্থনীতি ভেতর থেকে যে ভেঙে পড়ার দশায় উপনীত হয়েছিল, তার স্বরূপ প্রকাশ হচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তীব্র হয়ে উঠেছিল, যার কারণে আমদানি-রপ্তানি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। অনেক আমদানি এলসির বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে রপ্তানি বাণিজ্য তো বটেই, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বড় সংকটে পড়ে। ওই অবস্থায় শেয়ারবাজারের দর পতন ছিল অবসম্ভাবী ঘটনা। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সে অবস্থার অনেকটাই বদল হয়েছে। দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও ড.

ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গত আট মাসে অর্থনীতি খারাপ দশা কাটিয়ে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ার খবর নেই। উল্টো আগের বকেয়া বিলের সিংহভাগ পরিশোধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে অর্থ পাচার। ফলে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। এমন আশাবাদী ধারার কোনো প্রভাব শেয়ারবাজারে নেই।

সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য
জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন সমকালকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা অস্থিরতা থাকলেও অর্থনীতিতে বড় সংকট নেই। নতুন করে বিনিয়োগ না হলেও অর্থনীতি ক্রমে রুগ্‌ণ দশা কাটিয়ে উঠছে– এর স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। অথচ এর প্রতিফলন শেয়ারবাজারে নেই। শেয়ারবাজারের একটা লোকসানি কোম্পানি যখন একটা প্রান্তিকে মুনাফা করেছে বলে খবর দেয়, তখনই ওই শেয়ারের দর বেড়ে যায়। অথচ একটা দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার থেকে বেঁচে গেছে, এর কোনো প্রভাব ওই দেশের শেয়ারবাজারে নেই, এটা কল্পনাতীত বিষয়। বিনিয়োগকারীরা কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পরিবেশ না পেলে বিনিয়োগ করেন না। বিনিয়োগ না এলে পতন অবসম্ভাবী। এখনকার বাজারে এটাই হচ্ছে।
বিনিয়োগকারীরা কী ধরনের বিনিয়োগ পরিবেশ প্রত্যাশা করেন– এমন প্রশ্নে ডিবিএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ সাইফুজ্জামান বলেন, শেয়ারবাজারে তথ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তথ্যপ্রবাহে ঘাটতি থাকলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। দেশের বড় ধরনের পরিবর্তনের এ সময়ে মানুষ সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলো বিষয়ে ধারণা পেতে চান। তারা নিশ্চিত হতে চান, এখন বিনিয়োগ করলে ভবিষ্যতের কোনো পরিবর্তন তাঁর বিনিয়োগ নষ্ট হবে না। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র শ য় রব জ র র র দর পতন কর মকর ত গত বছর র পতন র প র পতন র সরক র র দর হ র ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

‘আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব’

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ২০ মিনিট। মাথার ওপর প্রখর রোদের উত্তাপ। প্রচণ্ড গরমে ত্রাহি অবস্থায় একটু বিশ্রাম নিতে গাছের ছায়ার খোঁজে ক্লান্ত পথিক। এমন সময় ঘর্মাক্ত শরীরে একটি ভবন নির্মাণের কাজ করতে দেখা গেল কয়েকজন শ্রমিককে। তাদের একজন তোঁতা মিয়া, অপরজন হাবিবুল।

হাবিবুল পাথর ভরেই যাচ্ছেন, তোঁতা মিয়া সেগুলো মাথায় করে একের পর এক টুড়ি ছাদ ঢালাইয়ের জন্য পৌঁছে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট স্থানে। সেখানেও বালু-পাথরের মিশ্রণ করছেন আরও কয়েকজন। তাদের কর্মযজ্ঞের এক ফাঁকে কথা হয় তোঁতা মিয়ার সঙ্গে।

আলাপকালে তোঁতা মিয়া বলেন, ‘সারাদিন কাম (কাজ) কইরা ৫০০ ট্যাহা (টাকা) হাজিরা পাই। এইডি দিয়া কোনোমতে বউ-পুলাপান নিয়া দিন পার করতাছি। মে দিবস-টিবস কী কইতারতাম না। আমরার মতো গরিব মানুষ কাম না করলে পেডে ভাত জুটতো না এইডাই কইতারবাম।’

গতকাল বুধবার ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকাজ করার সময় এসব কথা বলেন তোঁতা মিয়া (৪৫)। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া এলাকায়। এ সময় কথা হয় আরেক নির্মাণ শ্রমিক একাদুল মিয়ার সঙ্গে। একাদুলও জানেন না মে দিবস কী। তিনি বলেন, ‘এই কাম কইরা খাইয়া-না খাইয়া বউ-পুলাপান লইয়া কোনোরহমে দিন পার করতাছি। বর্তমান বাজারো জিনিসপাতির দাম বাড়লেও আমরার মজুরি বাড়ে না। পাঁচ বছর আগেও যা পাইতাম, অহনও তাই পাই।’ তিনি বলেন, ‘কয়েক ট্যাহা সঞ্চয় করবাম এই বাও (উপায়) নাই। অসুখ অইয়া চার দিন ঘরে পইড়া থাকলে না খাইয়া থাহন লাগব। আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব?’

আজ বৃহস্পতিবার মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এই দিনটি সারাবিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয় নানা আয়োজনে। কিন্তু যাদের অধিকার আদায়ের জন্য এ দিনটি পালন করা হয়– তারাই জানেন না দিবসটি সম্পর্কে। তাদের আরেকজন দিনমজুর রাজন মিয়া। রাজন জানান, এসব দিবসে তাদের মতো গরিব মানুষের কোনো লাভ-লোকসান নেই। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ