কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এই হামলায় পাকিস্তানের মদদ আছে অভিযোগ তুলে গত বুধবার প্রতিবেশী দেশটির নাগরিকদের ভিসা বাতিলসহ পাঁচটি পদক্ষেপ নেয় ভারত। এর জবাবে গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের নাগরিকদের ভিসা বাতিল, দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত, ভারতের উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তান। আগের দিন ভারত যেসব পদক্ষেপ নেয়, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা। এর জবাবে পাকিস্তান গতকাল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ওই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান যে পানি পাবে, তার প্রবাহ থামানো বা অন্যদিকে নেওয়ার যেকোনো চেষ্টা যুদ্ধের শামিল বলে বিবেচনা করা হবে। এই পানির প্রবাহ রক্ষায় পূর্ণ শক্তি প্রয়োগেরও ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।

এদিকে কাশ্মীরে হামলাকারী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারে এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, যারা এই হামলা চালিয়েছে এবং যারা এই নীলনকশা সাজিয়েছিল, তাদের কল্পনাতীত পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ নরেন্দ্র মোদি বলেন, এই সন্ত্রাসীদের যত সামান্য ভূমিই থাকুক না কেন, এখনই সময় এসেছে তা ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার। ১৪০ কোটি ভারতীয়র ইচ্ছাশক্তি এই সন্ত্রাসীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে

গত মঙ্গলবার বিকেলে কাশ্মীরের পেহেলগামের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বৈসারণ উপত্যকায় বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের একজন ছাড়া সবাই ভারতীয়। নিহত একমাত্র বিদেশি পর্যটক নেপালের নাগরিক।

এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামে স্বল্প পরিচিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ২০১৯ সালে কাশ্মীর অঞ্চলে আত্মপ্রকাশ করা এই সংগঠন পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়েবার সঙ্গে যুক্ত বলে ভারতের দাবি। ভারতের পুলিশ বলছে, পর্যটকদের ওপর হামলাকারীদের দুজন পাকিস্তানের নাগরিক।

ওই হামলার পরদিন গত বুধবার ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির সভায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতসহ পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী, আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ, দিল্লিতে পাকিস্তানের হাইকমিশনে নিযুক্ত সব সামরিক উপদেষ্টাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, হাইকমিশনে কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ জনে আনা এবং সব পাকিস্তানির ভিসা বাতিল করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশত্যাগ করতে বলা হয়।

‘যুদ্ধের শামিল’

ভারতের ওই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠক হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক বিবৃতিতে সিদ্ধান্তগুলো জানানো হয়।

সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ভারতের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান বলেছে, এই চুক্তি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হওয়া একটি বাধ্যবাধকতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, এককভাবে এই চুক্তি স্থগিতের কোনো বিধান নেই। পানি পাকিস্তানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়, যা দেশের ২৪ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে। যেকোনো মূল্যে এই পানি পাওয়ার বিষয়টি রক্ষা করা হবে।

হুঁশিয়ারি দিয়ে ইসলামাবাদ বলেছে, সিন্ধু চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান যে পানি পাবে, তার প্রবাহ বন্ধ বা অন্যদিকে নেওয়ার যেকোনো চেষ্টা এবং ভাটি অঞ্চলের মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা যুদ্ধের শামিল বলে বিবেচনা করা হবে। জাতীয় সক্ষমতার পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে এর জবাব দেওয়া হবে।

১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সই করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। এ চুক্তির আওতায় সিন্ধু, চন্দ্রভাগা, শতদ্রু, ঝিলাম, ইরাবতী ও বিপাশা নদীর পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়।

ভারতের পদক্ষেপকে বেপরোয়া ও দায়িত্বহীন আখ্যায়িত করে পাকিস্তান বলেছে, এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। এ অবস্থায় পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিতের অধিকার প্রয়োগ করবে এবং তা শুধু সিমলা চুক্তি স্থগিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইসলামাবাদ বলেছে, ভারত পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসবাদ উসকে দেওয়া ও আন্তসীমান্ত হত্যা বন্ধ না করা পর্যন্ত এবং আন্তর্জাতিক আইন ও কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবসমূহ মেনে না চলা পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সব চুক্তি স্থগিত থাকবে।

পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া সব সার্ক ভিসা বাতিল করেছে পাকিস্তান। এই ভিসার আওতায় পাকিস্তানে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য শিখ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হচ্ছে না।

পাকিস্তান গতকালই ওয়াগা সীমান্তচৌকি বন্ধ করে দিয়েছে। বলেছে, যাঁরা বৈধভাবে এই পথ দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা ফেরত যেতে পারবেন। তবে ৩০ এপ্রিলের পর এই সুযোগ দেওয়া হবে না।

এ ছাড়া ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত দেশটির প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। অবিলম্বে তাঁদের দেশটি ছাড়তে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মকর্তা ৩০ জনে নামিয়ে আনতে বলেছে পাকিস্তান। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বলা হয়েছে।

ভারতের মালিকানাধীন বা ভারত থেকে পরিচালিত সব উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পাশাপাশি পাকিস্তান হয়ে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিতেরও ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব এবং দেশটির জনগণের নিরাপত্তার প্রতি যেকোনো ধরনের হুমকি সব ধরনের দৃঢ় পাল্টা পদক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবিলা করা হবে।

এ ছাড়া গতকাল ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ‘ভারত আমাদের বিরুদ্ধে একধরনের ছোটখাটো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যদি তারা এর তীব্রতা বৃদ্ধি করে, আমরাও প্রস্তুত।’

হামলাকারীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে শুরু করেছে ভারত। গতকাল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিরাপত্তাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের নাগরিকদের কাছে থাকা সব ভারতীয় ভিসা আগামী রোববার বাতিল হয়ে যাবে। পাকিস্তানি নাগরিকদের মেডিকেল ভিসার মেয়াদ থাকবে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত।

নয়াদিল্লি বলেছে, পাকিস্তানের যেসব নাগরিক বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের অবশ্যই দেশটি ছাড়তে হবে। এ ছাড়া ভারতের যেসব নাগরিক পাকিস্তানে অবস্থান করছেন, তাঁদের অতি দ্রুত ভারতে ফিরে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এদিকে পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধের ঘোষণার পর ভারত এবং উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে চলাচল করা ফ্লাইটগুলো বিকল্প পথ ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে কাশ্মীরে বড় ধরনের গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গতকাল কাশ্মীরের বসন্তগড় এলাকায় অভিযান চলাকালে বন্দুকধারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গোলাগুলি হয়েছে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।

জম্মু-কাশ্মীর পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী আজ শুক্রবার শ্রীনগরে যাচ্ছেন। সেখানে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যালোচনা করবেন।

এদিকে কাশ্মীরে হামলার পর ভারত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়ে গতকাল দেশটিতে নিযুক্ত ২০টি দেশের কূটনীতিকদের অবহিত করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানির রাষ্ট্রদূতেরা উপস্থিত ছিলেন।

কাশ্মীরে হামলা ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল নয়াদিল্লিতে একটি সর্বদলীয় বৈঠক হয়েছে। সন্ধ্যায় ওই বৈঠকে যাওয়ার আগে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করেন। সর্বদলীয় বৈঠকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ও সংসদীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে বৈঠকে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি ও রাজ্যসভায় বিরোধীদলীয় নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে, লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীসহ অন্যান্য দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানা’ গুঁড়িয়ে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে ভারত সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। গতকাল নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসের কাছে বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় বিক্ষোভকারীদের বিভিন্ন স্লোগান দিতে এবং ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করতে দেখা যায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি নতুন সংকট শুরুর বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তাঁকে উদ্ধৃত করে পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে দুই দেশের মধ্যে যে স্বল্পকালীন সামরিক সংঘাত দেখা দিয়েছিল, তার পর থেকে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।

২০১৯ সালে কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলায় ভারতের ৪১ জন সেনা নিহত হন। ওই হামলার পর পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ষ ট রমন ত র পদক ষ প ন য় পরর ষ ট র ইসল ম ব দ কর মকর ত প রব হ মন ত র ল র পর ধরন র অবস থ গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

মবকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে একে উসকে দেওয়া হয়েছে

আমাদের সমাজে মব সহিংসতা (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) কেন ঘটছে? অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের ইতিহাসে আগেও মব সহিংসতার ঘটনাগুলো ছিল। তবে এখন এটা চরম আকার ধারণ করেছে। নানা আকারে হচ্ছে। কারণগুলো বিস্তৃত। সাধারণভাবে আপনি-আমিও কোনো অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে পারি। কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত দেখলে সোচ্চার হতে পারি। ওই ব্যক্তিদের পুলিশের হাতে আমরা তুলে দিতে পারি। অপরাধ প্রমাণিত হলে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করবে, পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাধারণ জনগণ হিসেবে পুলিশে সোপর্দ করার দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। তার মানে এই নয় যে যাকে অপরাধী মনে করা হচ্ছে, তাকে গণপিটুনি দেওয়া যাবে, হেনস্তা করা যাবে, নির্যাতন করা যাবে। অথচ এই জিনিসটাই করতে দেখা যাচ্ছে। আপনি একটা মানুষকে গণপিটুনি দিতে পারেন না। আর এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন আইনি অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে অপরাধী বা আসামিও বলা যাবে না। আমাদের সংবিধান, ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধি—কোনো আইনে আপনাকে মব সৃষ্টি করে কারও বিচার করার অধিকার দেওয়া নেই। মবের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বরং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়, বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। যতগুলো মব সৃষ্টি করা হয়েছে, ততবার বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এটা কোনো নাগরিকের কাম্য নয়। এটা একধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ির সামনে বসে মব তৈরি করতে দেখা গেছে। বাসার ভেতরে গিয়ে মব তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন অফিসে হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে দেখেছি। সবার আগে স্কুল-কলেজে শুরু হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক বা জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বা প্রভাবশালী কাউকে হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছিল, এটা মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা মনে করেছেন, এটা মব না, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এভাবে মবের ঘটনাকে অস্বীকার করে মবকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। মবের মাধ্যমে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। মানুষ ভাবছে, বিচারব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আমি ছেড়ে দিলে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ওই ব্যক্তি (যাকে অপরাধী ভাবা হচ্ছে) বের হয়ে যাবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, শাস্তি হবে না। যেটা করার আমাদেরই করতে হবে। আমাদেরই বিচার করতে হবে। মানুষ মনে করছে, বৈষম্য হচ্ছে। মানসিক হতাশা থেকে মানুষ রাস্তায় নামছে। মবের ঘটনার মধ্য দিয়ে তার অবস্থান ও মানসিক হতাশা প্রকাশ করতে চায়। মবের কোনো ঘটনার বিচার হতে দেখা যাচ্ছে না। কোনোটার বিচার দৃশ্যমান না। সে জন্য আরও বেশি ঘটনা ঘটছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও ভঙ্গুর দশায়।

মব সহিংসতার কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেকগুলো রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত। সেগুলোকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাসায় ঢুকে ডাকাতি করা হয়েছে। দোকান লুটপাট করা হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ছিল নিষ্ক্রিয় পর্যায়ে। পুলিশ নিজেও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দু–একটা ঘটনায় পুলিশ নিজেও মবের শিকার হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, ৪৭৭ জন পুলিশ মবের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক দলে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার মব সহিংসতার বিরুদ্ধে। অনেক সময় কোনো অপরাধের অভিযোগে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে এলে মব সৃষ্টি করা হয়েছে ওই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। কেউ যখন দেখেন অপরাধ করলেও তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়া হবে, তখন ওই ব্যক্তি অপরাধ করতে আর ভয় পান না। শাস্তির ভয় থাকে না বলে অপরাধ করতে থাকেন।

আরও পড়ুন‘পানিও দিতে দেয় নাই’, মব তৈরি করে হত্যায় আসামি গ্রেপ্তার মাত্র ১.২৭%১১ ঘণ্টা আগে

মব সহিংসতা বন্ধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিকদের উদ্যোগ নিতে হবে। মব সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারকে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। মব সহিংসতার ঘটনাগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মবের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে সরকার নির্দেশনা দিলে এবং সেই নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রচারের ব্যবস্থা নিলে মব সহিংসতা কমবে।

রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের কর্মকাণ্ড মানুষ দেখছে। সামনে নির্বাচন। সব দলকে সাধারণ মানুষ পর্যবেক্ষণ করছে। কে কী ধরনের আচরণ করছেন, তা দেখা হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের মব সহিংসতার মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়ানো উচিত নয়। কোনো বড় রাজনৈতিক দল যদি ঘোষণা দেয় যে আজ থেকে তারা মবের সঙ্গে থাকবে না। তাহলে তৃণমূলের একজন কর্মী তাঁর পদ হারানোর ভয়ে ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মব সহিংসতায় জড়ানোর আগে দুবার চিন্তা করবেন।

আরও পড়ুনগাইবান্ধায় চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা০২ নভেম্বর ২০২৫

বিচারপ্রক্রিয়ার ত্রুটি দূর করতে হবে। থিওরি (তত্ত্ব) বলে, মানুষ যখন দেখে সে কোনোভাবে সমাজে তার ক্ষমতার চর্চা করতে পারছে না। পাশাপাশি দেখে যে একজন অপরাধী দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো সাজার সম্মুখীন হচ্ছে না। তখন মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। বিচারে গলদ থেকে গেলে মব সহিংসতা ঠেকানো যাবে না।

গণমাধ্যম মব সহিংসতার বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম মব সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব সহজভাবে বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝাতে পারে। বিষয়গুলোকে আলোচনায় আনতে হবে। সহজভাবে বোঝালে মানুষ তা গ্রহণ করবে।

আরও পড়ুনরূপলাল-প্রদীপকে হত্যায় অংশ নেয় যারা, কী বলছে পরিবার১৯ আগস্ট ২০২৫

আমি নারী হিসেবে বলব, ধর্ষক আমার কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধী। তারপরও বলব, ভুক্তভোগীর মতো ধর্ষকেরও আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। জনগণকে মব সহিংসতাবিরোধী অবস্থানে আসতে হবে। যেকোনো কিছু হলে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যেন মব সহিংসতা করা না হয়। সব বিষয়ে জেনে–বুঝে সুনাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সমাজে মব সহিংসতা ঘটবে না।

শাহারিয়া আফরিন,
সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনপুরান ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড: নিরাপত্তাহীনতায় লাল চাঁদের পরিবার, বাড়িতে মাতম১২ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ