কাশ্মীরের পেহেলগামে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার প্রভাবে ভারত-পাকিস্তান এখন মুখোমুখি। এ ধরনের হামলা অতীতেও হয়েছে। তবে এবার অঘটন এমন সময়ে ঘটেছে যখন মোদি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ ‘স্ট্যাটাস’ বাতিল করে সেখানে বিনিয়োগ করছিল। বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিল, সেখানে তেমন কিছু হবে না। কারণ নরেন্দ্র মোদি পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দিয়ে ফেলেছেন। সবকিছুই যেন ঠিক চলছিল। কিন্তু যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায়, তারা এমন সুযোগেরই অপেক্ষায় থাকে। তবে ভারত যে অপ্রস্তুত ছিল; তাদের গোয়েন্দা বাহিনী যে বড় আকারে ব্যর্থ– সেটা স্পষ্ট। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে আমরা দেখলাম ভারত-পাকিস্তান পুরোনো সেই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে। পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে ভারত। একইভাবে ভারতকে পাল্টা দোষারোপ করছে পাকিস্তান। 

বেলুচিস্তানে যখন একই ধরনের হামলা বা ঘটনা ঘটে, তখনও ভারতকে দায়ী করে পাকিস্তান। এই পাল্টাপাল্টি দোষারোপের ফলে প্রকৃত অপরাধীরা অনেক সময় আড়াল হয়ে যায়। কারণ এ ধরনের ঘটনা কারা করেছে; তাদের নিয়ে গবেষণা ও তদন্ত করার যে বিষয় থাকে; সেখানে জোর না দেওয়ার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। যে কারণে এসব সন্ত্রাসী হামলা হয়, সেই সমস্যা রয়েই যায়। তো এবার আমরা দেখছি, দুই দেশ দোষারোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তারা পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে অনেক সময় যুদ্ধ লেগে যাওয়ার ভয় থাকে। যদিও আমার মনে হয় না, সরাসরি বড় আকারে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ছোটখাটো কিছু সংঘাতের আশঙ্কা অবশ্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ দুই দেশেরই এখন উত্তেজনার পারদ অনেক উঁচুতে। দুই দেশের মানুষের ইমোশন কাজে লাগানোর শঙ্কা আছে। তবে আন্তর্জাতিক ‘অ্যাক্টর’ যারা, তারা চাইবে দেশ দুটি যেন বড় আকারের যুদ্ধের দিকে ধাবিত না হয়।

ভারত সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। খেয়াল করতে হবে, এখানে স্থগিত করা হয়েছে; চুক্তি বাতিল করেনি। তার মানে, একটা পরিসর তারা রেখে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আবার যখন আলোচনা হবে তখন এটি চালু হতে পারে। এই চুক্তি বাতিল না করার কারণ হলো, এক সময় উভয় দেশই রাজি হয়ে চুক্তিটি করেছিল। আমরা দেখেছি, ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ ও কূটনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও সিন্ধু পানিচুক্তি টিকে ছিল। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অনেক কিছু অনিশ্চিত হলেও, পানি ছিল একমাত্র নিশ্চিত বিষয়। এবার সেই চুক্তি স্থগিত করা হলো। আন্তর্জাতিভাবে তথা জাতিসংঘের মাধ্যমেও এসবের সমাধান হতে পারে। সে জন্যই স্থগিতের সিদ্ধান্ত। সেটা নাগরিকদের উত্তেজনার কারণেও হতে পারে। তবে বড় ধরনের যুদ্ধ না হলেও ভারত এবং পাকিস্তানের এ ধরনের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে আশঙ্কার কারণ। এই পরিস্থিতি একটা স্বাভাবিক পর্যায়ে না নিয়ে গেলে সংঘাত বেধে যেতেও পারে।

কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের যে দ্বন্দ্ব, এর সমাধান দুই দেশের জনগণই করতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকরা যতদিন বড় আকারে এর সমাধান না চাইবে, ততদিন সমাধানের পথ ক্ষীণ। ভারতের বিজেপির যে রাজনীতি, সেখানে  নাগরিকদের একটা বড় অংশের সমর্থন আছে– তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নাগরিকদের প্রত্যাশা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। এর একটা চূড়ান্ত সমাধান দ্রুতই হওয়া দরকার। এতে যত বিলম্ব ঘটবে ততই এ ধরনের অঘটন ঘটার আশঙ্কা থাকবে। সে জন্য নাগরিকদের ভালোভাবেই বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। কাশ্মীর মূল ভারত থেকে কিছুটা দূরে বলে দেশটির যে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন আছে, সেখানে বড় আকারে প্রভাব ফেলে না এসব ঘটনা। যে কারণে মানুষও হয়তো জোরালোভাবে এর সমাধান অনুভব করছে না। 

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান অবশ্যই করতে হবে। কারণ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এমন অচলাবস্থা তো চলতে পারে না। এই ট্র্যাজেডি হয়তো নতুন কোনো মোড় নিতে পারে। তবে কাশ্মীরে আপাতত যে সমস্যা হয়েছে; সেখানকার পর্যটনে বড় প্রভাব পড়তে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে হামলাস্থল পেহেলগামসহ কাশ্মীরের বিভিন্ন পর্যটন স্পট অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। এমনকি বাংলাদেশের পর্যটকরাও সেখানে পর্যটন শুরু করেছে। এই অঘটনে কাশ্মীরের সেই পর্যটনে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে। সেখানে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসার পরও পর্যটনে ভারতের এক ধরনের বিধিনিষেধ নিশ্চয় দেখা যাবে। সুতরাং তাৎক্ষণিক প্রভাবটা পর্যটনেই পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। 

কাশ্মীরে এমন বড় হামলা এবং এর জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও পদক্ষেপের প্রভাব প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশেও পড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের উচিত হবে এর মধ্যে না জড়ানো। ইতোমধ্যে ভারতের কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.

মুহাম্মদ ইউনূস। হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় তিনি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এই নিন্দা জানানো পর্যন্ত আপাতত ঠিক আছে। তবে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার সমাধানে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ যে ভূমিকা রাখতে পারত, তা সে রাখতে পারছে না। কারণ দেশে যারাই ক্ষমতায় যায়, হয় তারা কিছুটা ভারতমুখী হয়ে পড়ে অথবা পাকিস্তানের দিকে হেলে পড়ে। তারা যদি শুধু বাংলাদেশপন্থিই হতো, তবে হয়তো দুই দেশের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারত। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিকরা ক্ষমতায় থাকার জন্য একদিকে ঝুঁকে পড়েন; তারা সেই নিরপেক্ষতা কিংবা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন না। এ কারণে আমাদের সেই পেশাদারিত্ব তৈরি হয় না। কাশ্মীরের ঘটনায় আমরা ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’ দেখছি। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়ই নন-স্টেট অ্যাক্টরের সমালোচনা রয়েছে। সেই জায়গায় আলোচনা হতে পারে। 

কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের এই বিবাদের মধ্যে বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। আগামী রোববার তাঁর ঢাকায় আসার কথা ছিল। পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে বাতিল হলো এ সফর। তবে এ সংকটে বাংলাদেশের উচিত হবে সরকারের পেশাদারিত্ব বাড়ানো। সরকারের বাইরে অন্যেরা হয়তো কথা বলতে পারে। সরকারকে এর মধ্যে না জড়ানোই ভালো। এ অঞ্চলে বড় ধরনের যুদ্ধ যেন না হয়, সেটাই আমরা দেখতে চাইব।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রাক্তন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হত য ক ণ ড পর স থ ত এ ধরন র সরক র র ঘটন আশঙ ক

এছাড়াও পড়ুন:

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বংশে তিনি প্রথম, তাই এত আয়োজন

চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া দেশটির যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য দারুণ সম্মানের। এ বছর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন লি গুওইয়াও।

লির বাড়ি জেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনজউ শহরে। এর আগে তাঁর বংশে শত বছরের ইতিহাসে কেউ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। এত বড় সম্মানের উপলক্ষ উদ্‌যাপন করতে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি লির পরিবার ও গ্রামের বাসিন্দারা। রীতিমতো লালগালিচা বিছিয়ে, মোটর শোভাযাত্রা করে, ব্যান্ড বাজিয়ে পরিবার ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা লিকে সংবর্ধনা দেন তাঁরা, সঙ্গে ছিল ভূরিভোজের ব্যবস্থা। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে এই সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়।

চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেটি ‘গাওকাও’ নামে পরিচিত। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই পরীক্ষা বেশ কঠিন। পরীক্ষায় মোট ৭৫০ নম্বরের মধ্যে লি পেয়েছেন ৬৯১।

লির গ্রামের এক প্রতিবেশী জানান, লির বাবা নির্মাণশ্রমিক। লির মা মাত্র ২ হাজার ৮০০ ইউয়ান বেতনে একটি সুপারশপে কাজ করেন। সত্যি বলতে, ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে এটা অর্জন করেছেন।

প্রতিবেশী আরেক গ্রামবাসী বলেন, লি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি পুরোনো মুঠোফোন দিয়ে প্রশ্নোত্তর অনুশীলন করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় গ্রামের গ্রন্থাগারে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে লিখে তারপর সেগুলো অনুশীলন করতেন। মাধ্যমিকে তিনি কখনো কোনো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়েননি।

লিকে সংবর্ধনা দিতে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙে তাঁদের গ্রামের পূর্বপুরুষদের মন্দিরের প্রধান ফটক খোলা হয়, যা একটি বিশেষ সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

লিকে সংবর্ধনা দেওয়ার ছবি ও ভিডিও চীনজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অনলাইনে একজন লেখেন, ‘পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৬৯১ নম্বর! এটা অবিশ্বাস্য। সত্যিই পুরো পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে!’

তবে কেউ কেউ এই জমকালো উদ্‌যাপন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তাঁরা বলেছেন, এটা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? উৎসবটা খুবই জাঁকজমকপূর্ণ, এতে ছেলেটার ওপর অকারণ চাপ তৈরি হতে পারে। স্নাতক হওয়ার পর কি পরিবার তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করবে না?

সম্পর্কিত নিবন্ধ