‘১৫-২০ বছর ধইরা (ধরে), ই-খলায় (ধান মাড়াই ও শুকানোর স্থান) কাজ করি আমরা। আমরারে ৫০০ টেকা (টাকা) রোজ দেইন (দেন), আর বেটাইনতে (পুরুষরা) পাইন ৭০০ থেকে ৮০০ টেকা, দুপুরে আমরারে চিড়া-গুড় দেওয়া অয় (হয়) হেরার (পুরুষদের) লাগি ভাতের ব্যবস্থা করা অয়।’ 

কথাগুলো বলছিলেন তাহিরপুরের শনির হাওরপারের কালীবাড়ির সামনে একটি খলায় ধান শুকানো, ঝাড়াই ও বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকা দুই নারীশ্রমিক গীতা বর্মণ ও লক্ষ্মী রানী বর্মণ।

কেবল তাহিরপুরের ধানের খলায় নয়। হাওর এলাকাজুড়েই ধানের খলায় কাজ করা নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিতে বৈষম্য রয়েছে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদরের নতুনপাড়ার বারীক মিয়ার খলায় কাজ করছিলেন, পাশের লক্ষ্মীপুর গ্রামের মধ্যবয়সী নারীশ্রমিক প্রেমলতা বিশ্বাস। কখন কাজে এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, সকাল ৮টায়। কয়টায় ছাড়বেন কাজ, বললেন বিকাল ৫টায়। মজুরি কত জানতে চাইলে বললেন, দিনে ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিকরা কত পায় প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ৭০০ টাকা। আপনাকে কম দেওয়া হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রেমলতা বলেন, ‘ই-দেশও নিয়মওই এইটা, বেটাইনতে (পুরুষরা) বেশি পায়।’
মধ্যনগরের বংশিকুন্ডা গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা বেগম জানান, ধান মাড়াই, শুকানো ও গোলায় তোলার কাজ করেন তিনি। প্রতিদিনই সকালে আগে কাজে লাগেন এবং কাজ শেষে সবার পরে ফেরেন তিনি। কিন্তু মজুরি দেবার সময় তাঁকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিককে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকাও দেওয়া হয়।

দিরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বড় গৃহস্থ সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছত্তার মিয়ার ভাষ্য, রাজাপুরে নারী কৃষিশ্রমিক কমে গেছে। পাশের ইসলামপুরে এখনও বেশির ভাগ কাজ করেন নারীরা। ওখানে নারী ও পুরুষ শ্রমিক অর্ধেক-অর্ধেক। এবার পুরুষ ও মহিলা শ্রমিককে কত টাকা চুক্তিতে গ্রামের বড় কৃষকরা কাজে লাগিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, পুরুষ ২০ দিনে ১৬ মণ ধান এবং নারী শ্রমিকদের ৮ মণে করানো হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কথাও তুলেছি, কিন্তু অন্যরা তাতে বিরক্ত হন, তারা বলেন, চেয়ারম্যান সাবে রেইট বাড়িয়ে সবাইকে বেকায়দায় ফেলতে চান।’ 

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের ফসল উৎপাদনে সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় কৃষি শ্রমিকের চাইতে এক সময় বেশি ছিল নারী শ্রমিক। মজুরি বৈষম্যের কারণে এদের অনেকে এলাকার কাজ ছেড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে চলে গেছে। 

সুনামগঞ্জ জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরী ভট্টাচার্য্য বললেন, কৃষিতে মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে গ্রামীণ এলাকা ছেড়ে উপজেলা, জেলা ও রাজধানীর গার্মেন্টসমুখী হয়েছে হাজার হাজার নারীশ্রমিক।  কৃষি ছাড়াও অন্যান্য পেশায়ও মজুরি বৈষম্য থাকায় নারীর উপস্থিতির সংখ্যা কমছে।

গৌরী ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত পুরুষদের পেশা কৃষক লিখলেও নারীর ক্ষেত্রে হয় না। নারীর প্রতি এমন বৈষম্য বন্ধ করতে হবে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ ক জ কর বলল ন উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

সাদপন্থীদের ইজতেমা আয়োজন করতে না দেওয়ার দাবি

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মাওলানা সাদ কান্ধলভী অনুসারীদের (সাদপন্থী) ইজতেমা আয়োজন করতে না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাবলিগ জামাতের শুরায়ে নেজাম (জুবায়েরপন্থী) অনুসারীরা। পাশাপাশি তাঁরা সরকারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আগামী বছরের মার্চ মাসে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা করার কথাও বলেছেন। গত আয়োজনে ইজতেমা মাঠে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও সাজা নিশ্চিতের দাবিও জানান তাঁরা।

আজ সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়। ‘হযরত ওলামায়ে কেরাম ও দাওয়াত ও তাবলিগের সাথীবৃন্দের’ উদ্যোগে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

এর আগে গত রোববার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের পর বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তাবলিগের শুরায়ে নেজামের সাথী মুফতি আমানুল হক বলেন, ‘কোরআন ও হাদিসের কথা যারা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে, তাদের ইসলামি দাওয়াতের এই ময়দানে জায়গা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাসুল (সা.)-এর তরিকা, সুন্নাহ ও হাদিসের অনুসরণে যারা তাবলিগি কার্যক্রম পরিচালনা করে, কেবল তারাই ইজতেমা করার অধিকার রাখে।’

মুফতি আমানুল হক আরও বলেন, ‘সরকারের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জারি করা প্রজ্ঞাপনে সাদপন্থীরা শেষবারের মতো টঙ্গী ময়দানে ইজতেমা করার অনুমতি পেয়েছিল। সেই প্রজ্ঞাপনে তাদের স্বাক্ষরও রয়েছে। সরকার তখনই বুঝেছিল—একই মাঠে দুই পক্ষের ইজতেমা আয়োজন দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।’

২০২৪ সালের ডিসেম্বরের ইজতেমা মাঠে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে মুফতি আমানুল হক বলেন, ‘গত বছরের ১৮ ডিসেম্বরের রাতে সাদপন্থীদের অনুসারীরা অতর্কিত হামলা চালায়। তাদের বাংলাদেশি নেতা ওয়াসিফ সাহেবের চিঠিতে উল্লেখ ছিল, “যুগটা ব্যতিক্রমী, সবাই প্রস্তুতি নিয়ে আসবে”—এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই তারা হামলার পরিকল্পনা করেছিল। ঘুমন্ত মুসল্লিদের ওপর টর্চলাইট নিয়ে হামলা চালানো হয়, যা একতরফা সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছিল।’ তিনি দাবি করেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও প্রমাণিত হয়েছে, ‘এ হামলা একতরফাভাবে সাদপন্থীদের পক্ষ থেকেই হয়েছিল।’

মুফতি কেফায়েত উল্লাহ আজহারী তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, কিছু স্বার্থান্বেষী ও ইসলামবিরোধী মহলের প্ররোচনায় তাবলিগ জামাতে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের মাওলানা সাদ সাহেবের অনুসারীরা বেআইনি পথে টঙ্গী ইজতেমা মাঠ ও কাকরাইল মসজিদে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এমনকি তাঁরা সরকারকে বিব্রত করতে ‘যমুনা ভবন ঘেরাও’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর বিশৃঙ্খলাকারীদের কাকরাইল মসজিদে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং শুরায়ে নেজামপন্থীদের কাকরাইলে দাওয়াত কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয় বলে জানান মুফতি কেফায়েত উল্লাহ আজহারী। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির ৬৩ নম্বর স্মারকে বলা হয়, সাদপন্থীরা শেষবারের মতো ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গীতে ইজতেমা করতে পারবে, এরপর আর নয়। তারা স্বাক্ষর দিয়ে সেই শর্ত মেনে নিয়েছিল।

শুরায়ে নেজামপন্থীরা বলেন, ‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করছি। আগামী বছরের মার্চে ইজতেমা আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করা হবে।’

সংবাদ সম্মেলন থেকে সরকারের কাছে ৪ দফা দাবি পেশ করেন তাবলিগ জামাতের শুরায়ে নেজাম (জুবায়েরপন্থী) অনুসারীরা। তাঁদের দাবিগুলো হলো ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ইজতেমার তারিখ ঘোষণা, টঙ্গী ইজতেমা মাঠকে অস্থায়ীভাবে ‘কেপিআই’ হিসেবে ঘোষণা, বিদেশি মেহমানদের ভিসা সহজীকরণের পরিপত্র নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রকাশ ও গত বছরের ইজতেমা মাঠে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা শাহরিয়ার মাহমুদ, মতিন উদ্দিন আনোয়ার, রুহুল আমিন এবং তাবলিগ জামাত বাংলাদেশের (শুরায়ে নেজাম) মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ