আমাদের পুরোনো সু বা কুখ্যাতি– ‘হুজুগে বাঙালি’। যেমন এই মুহূর্তে হুজুগ চলছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী সভাপতি চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন ওরফে আশিক চৌধুরীকে নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের আহ্বানে তিনি বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন; প্রথমে বিডা, পরে বেজার দায়িত্ব এবং সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়েছেন।

আশিক চৌধুরী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পেশাগত জীবনের বেশির ভাগই কেটেছে বিদেশে। সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের কারণ সাম্প্রতিক কিছু ‘অর্জন’। যেমন পাঁচটি বিশালাকার মালবাহী জাহাজ ক্রয়; রিভার ম্যানেজমেন্টের প্ল্যান তৈরি করে বিনিয়োগ আনার চেষ্টা; বিদেশি বিনিয়োগে চারটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরির চেষ্টা; ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ইলেকট্রনিক অথবা বুলেট ট্রেন চালুর জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা; ১০টি বৃহত্তর ইকোনমিক জোন তৈরির উদ্যোগ; স্টারলিংক আনা; নাসার সঙ্গে চুক্তি (আর্টেমিস অ্যাকর্ড) এবং বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার চুক্তি। 

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এগুলোর অর্থনৈতিক তাৎপর্য কী এবং সুবিধাভোগী কারা হবে? প্রথমত, এটি প্রথাগত অর্থনৈতিক ‘উন্নয়ন’ ধারণার অনুসারী, যা শিল্পায়ন ও ‘প্রবৃদ্ধি’ অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেয় এবং নিষ্কাশনবাদী পন্থায় তা অর্জনের চেষ্টা করে। কিন্তু বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং এ ক্ষেত্রে নিষ্কাশনবাদী পুঁজিবাদী কর্মকাণ্ডের ভূমিকার কারণে সমসাময়িক অর্থনীতিবিদদের ক্রমবর্ধমান অংশ নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলছে, যা পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। এই অর্থনীতি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে এমনভাবে ব্যবহার করবে যেন তা দূষিত, ধ্বংস না হয় ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অটুট থাকে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে বলি দিয়ে নয়, রক্ষা করে অর্জিত হবে মুনাফা। পাশাপাশি এতে সামাজিক দায়িত্ববোধ, সম্পদের সুষম বণ্টন, ভোগবাদিতা পরিহার, ন্যায্যতায়ও জোর দেওয়া হয়।  

বিশ্ব যখন পরিবেশবান্ধব বা টেকসই উন্নয়ন ও নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে যেতে চাইছে, তখনও আমরা শিল্পায়ন ও প্রবৃদ্ধিনির্ভর বাতিল অর্থনীতি নিয়ে পড়ে আছি, পরিবেশগত ও সামাজিক কুপ্রভাব সত্ত্বেও। বর্তমান ব্যবস্থায় যে অর্থনৈতিক লাভ হয়, তার চেয়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হয় বহু গুণ। এতে মুনাফা পুঞ্জীভূত হয় মুষ্টিমেয় লোকের হাতে। তারা টাকার কুমির হয়, বাকিরা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর। সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এর কুফল ভোগ করে খেটে খাওয়া মানুষ। পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট– এ ব্যবস্থা ব্যর্থ ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। 

বিদেশি বিনিয়োগে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ইলেকট্রনিক ট্রেন অথবা বুলেট ট্রেন মুষ্টিমেয় শহুরে বিত্তবান আর হাতেগোনা দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী ছাড়া (কিছু কর্মচারী ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান বাদে) কীভাবে দেশের বেশির ভাগ নাগরিকের জীবনে বৃহত্তর পরিবর্তন আনবে, তা বোধগম্য নয়। 

বিদেশি বিনিয়োগ আসা মানেই জাতীয় উন্নয়নের নিশ্চয়তা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবেশ দূষণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়া আর কোনো সুফল বয়ে আনে না। গোটা বিশ্বেই খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে সেই সম্পদ উত্তোলন করে বিদেশি বিনিয়োগকারী মুনাফা করে। জনগণ দরিদ্রই থেকে যায়। শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও তাই। শিল্পোন্নত দেশগুলো দেশীয় কোম্পানি দিয়ে শিল্পায়ন করেছে; বিদেশি কোম্পানি দিয়ে নয়। 

বাংলাদেশের মতো নদী অববাহিকার দেশে বিদেশি বিনিয়োগে নদী ব্যবস্থাপনা আত্মহত্যার নামান্তর। এ অঞ্চলের নদী খুবই সক্রিয়, ক্রমাগত গতিপথ পরিবর্তন করে, আর প্রবল শক্তিও নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। এ দেশে মানুষের জীবন-জীবিকা, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য নদীনির্ভর; নদীপ্রবাহের মৌসুমি বাড়া-কমা, জোয়ার-ভাটার তালে এখানকার জীবন যুগলবন্দি। এর সঙ্গে জড়িত সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা, আবেগ-অনুভূতি কেবল কারিগরি বিষয় নয়। এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করতে হলে দরকার ব্যাপক গবেষণা, সময়; সর্বোপরি দরদ, যা বিদেশি বিনিয়োগে কখনোই সম্ভব নয়। 

জনকল্যাণে আমাদের অনেক বেশি দরকার সবার জন্য উঁচুমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো, নিজস্ব গবেষণা সক্ষমতা। এতে তৈরি হবে স্বাস্থ্যবান, দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি। তারা শুধু অন্যের হয়ে কাজ করবে না, বরং নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করবে। সর্বোপরি দরকার পরিবেশবান্ধব, টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা পরিবেশগত ও সামাজিক কুফল থেকে বাঁচাবে, সম্পদের সুষম বণ্টন ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে।

এসব নিয়ে চিন্তাভাবনার বদলে বিনিয়োগ নিয়ে হঠাৎ উচ্ছ্বাস-বাহবা সাধারণত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে ও রাজনৈতিক কারণে হয়ে থাকে। হতে পারে ব্যক্তি-বন্দনার মাধ্যমে ব্যক্তির নেওয়া উদ্যোগগুলো যাতে সমালোচনার মুখে না পড়ে বা সহজেই মুনাফা করা যায়। অথবা আরও বড় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। অথবা দুটোই একসঙ্গে।

আবু আলা মাহমুদুল হাসান: গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস থ পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

তামাবিল সীমান্তে যৌথ জরিপের সময় বিএসএফের সঙ্গে স্থানীয়দের উত্তেজনা 

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তামাবিল সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সীমান্ত জরিপ চলার সময় বিএসএফ সদস্যদের বাংলাদেশি ভূখণ্ডে প্রবেশে বাধা দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিএসএফ দখল করে নিচ্ছে- এমন অভিযোগে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে মাঠে হাজির হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে সীমান্ত পিলার ১২৭৮ ও ১২৭৯ এর মধ্যবর্তী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়ে সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল হক সমকালকে বলেন, কিছুদিন ধরে যৌথ জরিপ চলছে। গোয়াইনঘাট উপজেলার নলজুরি খাসি হাওর ১২৭৮-১২৭৯ পিলারের মধ্যে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার মাঠে আজ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জরিপ কাজ শুরু হয়। জরিপ চলার সময় বাংলাদেশি কিছু লোক আবেগপ্রবণ হয়ে ভিড় করেন। বিএসএফের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। পরবর্তীতে কবে জরিপ হবে তা এখন বলা যাচ্ছে না।

জানা গেছে, তামাবিল সীমান্তে বাংলাদেশের জায়গা (খেলার মাঠ এলাকা) অপদখলীয় ভূমি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির আলোকে সীমান্ত এলাকায় সম্প্রতি জরিপ কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ও ভারত। বৃহস্পতিবার ধারাবাহিক জরিপের অংশ হিসেবে জরিপ শুরু হলে সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। 

জরিপ শুরু হলে বিএসএফের কয়েকজন সদস্যের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে খাসি হাওর এলাকায় প্রবেশ করা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিবাদ জানান। ওই সময় স্থানীয় লোকজন হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেন। বিএসএফ সদস্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করতেও দেখা যায়। এক বিএসএফ সদস্যকে হিন্দিতে বলতে শোনা যায়, ‘এ হামারা মুল্লুক হ্যা। সমস্যা কিয়া হ্যায় তুম লোগকো।’  

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী বলেন, যতটা জানতে পেরেছি সীমান্তে যৌথ সমীক্ষা চলছিল। তবে কে বা কারা সমীক্ষা চালিয়েছে তা আমরা জানি না। 

 

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ