ঢাকার নবাবদের ‘দরিয়া-ই-নূর’ কি সোনালী ব্যাংকের ভল্টে আছে
Published: 12th, May 2025 GMT
১১৭ বছর ধরে অন্ধকার কুঠুরিতে পড়ে আছে ঢাকার নবাব পরিবারের ১০৯ ধরনের রত্ন। ব্রিটিশ ভারতে যার মূল্য ধরা হয়েছিল ১০ লাখ ৯ হাজার ৮৩৫ টাকা। ভূমি সংস্কার বোর্ডের করা তালিকা বলছে, এসব রত্নের মধ্যে সবচেয়ে দামি বস্তুটি হলো ২৬ ক্যারেটের টেবিল কাটের একটি হিরা। ইতিহাস যাকে দরিয়া-ই-নূর নামে চেনে। ভারতের মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং যুক্তরাজ্য ঘুরে শেষমেশ ঢাকার নবাব পরিবারের মাধ্যমে বাংলায় আসে এই হিরা।
তবে ১৯০৮ সালের পর থেকে ‘কোহিনূর হিরার আত্মীয়’ হিসেবে খ্যাত দরিয়া-ই-নূর হিরার ইতিহাস এক রহস্যের জালে বন্দী। টেবিল কাটের এই হিরার বৈশিষ্ট্য হলো এর ওপরের দিকটি টেবিলের মতো সমতল ও অষ্টভুজাকৃতির।
সরকারি নথি অনুযায়ী, দরিয়া-ই-নূরের বর্তমান অবস্থান হওয়ার কথা সোনালী ব্যাংকের ভল্ট। তবে বাস্তবে এর অস্তিত্ব নিয়ে আছে ঘোর অনিশ্চয়তা। ভল্টে হিরা আছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। হিরা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ডও।
পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের গেজেট এবং সম্পাদিত ইনডেঞ্চারের শর্তে ১৯০৮ সাল থেকে ঢাকার নবাব এস্টেট বোর্ড অব রেভিনিউয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর সরকারি তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনায় চলে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বোর্ড অব রেভিনিউ বিলুপ্ত হয়। পরে ১৯৮৯ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভূমি সংস্কার বোর্ড গঠিত হয়। তখন থেকে ঢাকার নবাব এস্টেটের দেখভালের দায়িত্ব ভূমি সংস্কার বোর্ডের কাছে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দরিয়া-ই-নূরের মতো এমন হিরা বিশ্বে দুর্লভ। এর মূল্য কেবল অর্থে নয়, আছে ঐতিহাসিক মূল্যও। দরিয়া-ই-নূরের বিষয়ে খতিয়ে দেখতে চায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ব্যাংকের ভল্ট থেকে হিরার প্যাকেট বের করে তা যাচাইয়ের জন্য রত্ন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
রাজদরবার থেকে কাল কুঠুরিতে
২০১২ সালে ভারতের ‘দ্য ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক শ্যাম ভাটিয়ার লেখা এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কোহিনূর হিরার মতোই, দরিয়া-ই-নূরও অন্ধ্র প্রদেশের গোলকুন্ডা খনি থেকে পাওয়া গিয়েছিল। দরিয়া-ই-নূর অর্থ আলোর নদী।
ডিজিটাল আরকাইভ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অন রেকর্ডের তথ্য বলছে, দরিয়া-ই-নূর হিরা দীপ্তি ও স্বচ্ছতায় অতুলনীয়। এটি মিনা করা সোনার ওপর বসানো প্রথম শ্রেণির বিশুদ্ধ একটি টেবিল কাটের হিরা। এর চারপাশে ১০টি মুক্তাও বসানো আছে। এই তথ্যের সত্যতা মেলে ১৮৫১ সালের ৩১ মে ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’–এ প্রকাশিত দরিয়া-ই-নূরের একটি ছবি থেকে।
ঢাকার নবাব পরিবার নিয়ে গবেষণা করেছেন আহসান মঞ্জিলের সাবেক কিউরেটর মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি বলেন, ২৬ ক্যারেটের হিরাটি দীর্ঘদিন মারাঠা রাজাদের কাছে ছিল। পরে হায়দরাবাদের নবাব সিরাজুল মুলকের পূর্বপুরুষেরা ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় হিরাটি কিনে নেন। এরপর পারস্যের সম্রাটদের হাতে এই হিরা চলে যায়। সেখান থেকে পাঞ্জাবের রাজা রণজিৎ সিং হিরাটি দখল করে নেন। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন পাঞ্জাবের রাজা দিলীপ সিংয়ের কোষাগার থেকে কোহিনূর ও দরিয়া-ই-নূরসহ অনেক মূল্যবান জিনিস দখল করে নেয়।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘দখল’ করে নেওয়ার পর দিলীপ সিংয়ের কোষাগারে থাকা রত্নালংকারের বিবরণ পাওয়া যায় ভারতের ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত ওই নিবন্ধ থেকে। নিবন্ধে বলা হয়, ১৮৪০ সালের কিছু নথি বিশ্লেষণ তাঁরা দেখেছেন। এই তালিকা করেন জন লগিন। লগিন রণজিৎ সিংয়ের ছেলে ও উত্তরাধিকারী মহারাজা দিলীপ সিংয়ের অভিভাবক ছিলেন।
জন লগিনের ওই তালিকার শীর্ষে ছিল বিখ্যাত হিরা কোহিনূর। তালিকায় নাম ছিল দরিয়া-ই-নূরেরও। লগিন সে সময় দরিয়া-ই-নূরের মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন ৬৩ হাজার রুপি। হিরাটিকে লন্ডনে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ রাজপরিবার এতে আগ্রহ না দেখালে দুই বছর পর তা ভারতে ফেরত পাঠানো হয়।
১৮৫১ সালের ১৭ মে ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’–এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ১৮৫০ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার সম্মানে আয়োজিত হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত মহা প্রদর্শনীতে কোহিনূরের সঙ্গে দরিয়া-ই-নূরসহ উল্লেখযোগ্য গয়না প্রদর্শনের জন্য লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল। পরে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতার হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি ১৮৫২ সালের নভেম্বরে হিরাটির নিলাম করে। সে সময় ঢাকার জমিদার নবাব খাজা আলীমুল্লাহ ৭৫ হাজার টাকায় দরিয়া-ই-নূর কিনে নেন। এরপর থেকে ঢাকার নবাব পরিবারের কাছে ছিল দরিয়া-ই-নূর।
ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিপত্র বলছে, ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ আর্থিক সংকটে পড়লে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের কাছ থেকে ১৪ লাখ রুপি ঋণ নেন। বার্ষিক শতকরা ৩ টাকা সুদে ৩০ বছরে এই ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। সম্পাদিত বন্ধকি চুক্তি অনুসারে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে হীরকখণ্ড দরিয়া-ই-নূর এবং আরও রত্ন ঋণদাতার কাছে বন্ধক থাকে। সে সময় এই হিরার মূল্য ধরা হয় ৫ লাখ রুপি। নবারের ঋণ নেওয়া সেই ১৪ লাখ রুপির সুদাসল এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী দরিয়া-ই-নূরসহ নবাব পরিবারের ব্যবহৃত ১০৯ ধরনের বন্ধকি রত্ন দেশভাগের আগে ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, মুক্তিযুদ্ধের আগে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের ভল্টে রাখা হয়। সেই থেকে মূলত অন্ধকার কুঠুরিতেই পড়ে আছে বাংলার হিরা দরিয়া-ই-নূর।
দরিয়া-ই-নূর আছে নাকি নেই
নথিপত্রে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে নবাব পরিবারের ১০৯ ধরনের রত্ন থাকার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও সেগুলোর মধ্যে দরিয়া-ই-নূর আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এত বছরেও সেই সন্দেহের অবসান হয়নি।
জাতীয় জাদুঘরের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে একবার ব্যাংকে থাকা নবাব পরিবারের অংলকারগুলো খুলে দেখার বিষয়ে আলোচনা হয় ভূমি মন্ত্রণালয় ও জাতীয় জাদুঘরের মধ্যে। তবে ভল্টে থাকা প্যাকেটে হিরা না পাওয়া গেলে সেই দায় কে নেবে—এমন প্রশ্নের মুখে শেষ পর্যন্ত ওই উদ্যোগ নাকচ করে দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়।
দরিয়া-ই-নূর আসলেই ব্যাংকের ভল্টে আছে কিনা—জানতে গত ৫ মে যোগাযোগ করা হয় সোনালী ব্যাংকের সদরঘাট করপোরেট শাখায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার একজন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে দরিয়া-ই-নূর লেখা একটি প্যাকেট মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল স্থানীয় কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ৬ মে প্রথম আলোকে বলেন, ভল্টে সোনালী ব্যাংক সদরঘাট শাখার সেফ ডিপোজিটের সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটি সিলগালা করা প্যাকেট আছে। তবে প্যাকেটে হিরা আছে কিনা, তা তাঁরা জানেন না।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্প্রতি দরিয়া-ই-নূরের বিষয়ে জানতে ভূমি সংস্কার বোর্ডের কর্মকর্তারা সরেজমিনে সোনালী ব্যাকের স্থানীয় কার্যালয়ে যান। তবে অনুমোদন না থাকায় তাঁদের ভল্টে থাকা প্যাকেট দেখানো হয়নি।
৭ মে ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিপত্র থেকে জানা গেছে, ঢাকা নওয়াব এস্টেটের একটি সেফ ডিপোজিট ছিল সদরঘাট শাখায়। যেখানে দরিয়া-ই-নূর লেখা সিলগালা করা একটি প্যাকেট ছিল। নিরাপত্তা শঙ্কায় ২০১১ সালের জুলাই মাসে সেফ ডিপোজিট থেকে ওই প্যাকেট মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ভূমি সংস্কার বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা কখনো এই হিরা দেখেননি। হিরা আসলে আছে কিনা তাও তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাঁদের তথ্য বলছে, ১৯০৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দরিয়া-ই-নূর পরিদর্শন হয়নি। আবার ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৮৩ ও ১৯৮৫ সালে মোট আটবার দরিয়া-ই-নূর পরিদর্শন করা হলেও এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন তাঁদের কাছে নেই।
ইরানে তাহলে কোন দরিয়া-ই-নূর?
পারস্যের শাসক নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে ভারত আক্রমণ করে মুঘলদের কাছ থেকে কোহিনূরের সঙ্গে দরিয়া-ই-নূর হিরাও দখল করে নেন। বিভিন্ন হাত ঘুরে হিরাটি পারস্যের রাজমুকুটে জায়গা করে নেয়। বর্তমানে তা সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইরানে সংরক্ষিত আছে।
ব্রিটানিকা ও ইরান প্যারাডাইস ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তেহরানের ইমাম খোমেনি স্কয়ারে সেন্ট্রাল ব্যাংকের ন্যাশনাল জুয়েলারি মিউজিয়ামে দরিয়া-ই-নূর হিরা সংরক্ষিত আছে। গোলাপি এই হিরাও টেবিল কাটের এবং অন্ধ্র প্রদেশের গোলকুন্ডা খনি থেকে পাওয়া গিয়েছিল।
ঢাকার নবাবদের হিরা দরিয়া-ই-নূরও টেবিল কাট এবং অন্ধ্র প্রদেশের গোলকুন্ডা খনি থেকে পাওয়া। সেদিক থেকে মিল থাকলেও বলা হচ্ছে ইরানের দরিয়া-ই-নূর বিশ্বের অন্যতম বড় হীরকখণ্ড। যার ওজন প্রায় ১৮২ ক্যারেট। আর ঢাকার নবাবদের হিরাটি ২৬ ক্যারেটের।
হিরার খোঁজে সরকার
ভূমি সংস্কার বোর্ড বলছে, দরিয়া-ই-নূরের রহস্য সমাধানে আগ্রহী বর্তমান সরকার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বোর্ডের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের আগ্রহে দরিয়া-ই-নূরের রহস্য উন্মোচনের জন্য একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে ওই কমিটি প্যাকেট খুলে দেখবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ৭ মে প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৪৭-এ দেশ ভাগ এরপর ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এত বছরেও ভল্টে থাকা ওই প্যাকেট খুলে দেখা হয়নি। এর জন্য রত্ন বিশারদসহ আরও বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। সবকিছু সমন্বয় করে আমরা এটা খুলে দেখার ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই হিরার বিষয়ে আমাদের উৎসাহ আছে।’
দরিয়া-ই-নূর প্রদর্শনীর দাবি
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোহিনুর হিরা ছিল ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার বিশেষ সম্পত্তি। এই হিরা সর্বপ্রথম জনসমক্ষে দেখা যায় ২০০২ সালে, কুইন মাদারের মৃত্যুর পর তাঁর কফিনের ওপরে। আর স্মিথসোনিয়ান সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোহিনুর হিরা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের মালিকানাধীন। এটি টাওয়ার অব লন্ডনের জুয়েল হাউসে অন্যান্য ব্রিটিশ ক্রাউন জুয়েলের সঙ্গে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
দরিয়া-ই-নূর হিরার সত্য উন্মোচন হলে একইভাবে তা জাদুঘরে প্রদর্শনের দাবি জানিয়েছেন ইতিহাস গবেষকেরা। সরকারের সাবেক সচিব ও জাতীয় জাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরিয়া ই নূরের ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এটাকে অবশ্যই প্রকাশ্যে আনা উচিত।’
হিরার সঙ্গে থাকা নবাব পরিবারের বাকি রত্নগুলোও প্রকাশ্যে আনার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় জাদুঘরের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, যেকোনো জিনিস যার ঐতিহাসিক মূল্য আছে, জাদুঘর সেটা কাস্টডিয়ান হিসেবে রাখতে পারে। জাদুঘরের উচিত এটা উদ্ধার করে তাদের হেফাজতে নেওয়া এবং সেটা যথাযথভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা।
আরও পড়ুন'দরিয়া-এ নূর' ও নবাব সলিমুল্লাহর দেনার দায়২৯ জানুয়ারি ২০১৮.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ত য় জ দ ঘর র প রথম আল ক কর মকর ত সরক র র এই হ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
জাতির স্বার্থে খোলামেলা আলোচনায় বসার আহ্বান জামায়াতের
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারসহ সব পক্ষ আন্তরিক হলে আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন শফিকুর রহমান।
জাতীয় নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা সময়মতো ঘোষণা করা হবে বলে বলেও জানান তিনি। এছাড়া, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি।
বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, জামায়াতের তালিকা কবে ঘোষণা করা হবে জানতে চাইলে দলের আমির বলেন, “তারাও (বিএনপি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমি দেখেছি ২৩৭ টা আসনে তারা তালিকা প্রকাশ করেছেন, আবার এটিও চূড়ান্ত নয়। এরমধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।”
“আমরা কিন্তু এক বছর আগেই এই তালিকা আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো আমরা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরো অনেককে আমরা ধারণ করব, দেশ এবং জাতির স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রার্থী ঘোষণা করব।”
আসন্ন নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে জামায়াতের আমির বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, আমরা আপনারা দেশবাসী সবাই দেখতে চাই।”
মতানৈক্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: রাজনীতিতে মতানৈক্য কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে দোয়া করেন মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”
“আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। তবে আমরা নিজেরা যে মতটা প্রকাশ করি আমরা চেষ্টা করি চিন্তাভাবনা করে জাতির স্বার্থেই সে মতগুলা প্রকাশ করা হয়। অতএব, মতানৈক্য এটা ডেমোক্রেসির সৌন্দর্য। এটার জন্য এখানে বিরোধ লেগে গেছে অথবা দেশ একেবারে অস্থির হয়ে গেছে আমরা এইটুকু চিন্তা করতে রাজি নই” বলেন তিনি।
খোলামেলা আলোচনার আহ্বান:
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি ও গণভোটের বিষয়ে শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি দিয়ে দিয়েছি।”
সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, উনারা সময় বেঁধে দেই নাই; আমি শুনেছি ভাল করে। উনারা অনুরোধ করেছেন যে, এক সপ্তাহ সময়ের ভেতরে রাজনৈতিক দলগুলা বসে যদি একটা কনসেনসাসে পৌঁছাতে পারে, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবে। সরকার ভালো কথাই বলেছে।”
তিনি বলেন, “আমরাই সবার আগে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে জাতির স্বার্থে একটা সমাধানে পৌঁছি। আমরা আশা করি, অন্যরা আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন।”
এর আগে গতকাল সোমবার জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি:
আবারো দলের আমির নির্বাচত হওয়া প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন, “আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি। আমার সহকর্মীরা আমার ওপর একটা দায়িত্বের ভার অর্পণ করেছেন, এই দায়িত্বটা বড় ভারী। আপনারা দোয়া করবেন, দেশ এবং দ্বীনের জন্য এই দায়িত্ব পালনে আল্লাহ যেন আমাকে সাহায্য করেন। আর পাশাপাশি আমি আপনাদেরও সহযোগিতা চাই।”
সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাবার আগে আরেকবার আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করব। আসলে আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জাতির বিবেক আর আপনাদের হাউসগুলো দর্পণ। আমরা সমাজের এই দর্পণ এবং জাতির বিবেকের কাছে দেশ গড়ার অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করছে যা দেশ এবং জাতির কল্যাণে আমরা এই সবগুলোতে আপনাদেরও কাছে চাই। কারণ আপনারা এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। আপনারা শুধু সাংবাদিক নন, আপনারা এই দেশের নাগরিকও বটে। অতএব, আমরা যারা নাগরিক অধিকারটা নিশ্চিত করে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য, আমরা সেটা প্রত্যাশা রাখি। কারণ সাংবাদিকরা যখন জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেন, জাতি তখন কল্যাণের পথ খুঁজে পায়।”
বিদেশ সফরের কথা তুলে ধরে শফিকুর রহমান বলেন, “আপনারা হয়ত জানেন গত মাসের ১৯ তারিখ আমি ওমরা করার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম। তিন দিনে ওমরা সম্পন্ন করার পর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় আমেরিকার জেএফকে এয়ারপোর্টে আমি আল্লাহর মেহেরবাণীতে সেখানে পৌঁছাই এবং সেখানে ৮ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি শহরে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখা করার সুযোগ হয়েছে।”
“সেখান গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা দুটি মেসেজ তাদেরকে দিয়েছি। একটা হচ্ছে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং নিষ্পেশন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই সংগ্রামে দেশবাসীর সাথে প্রবাসে যারা ছিলেন, তারাও সমানতালে লড়াই করেছেন। তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই অবদানের জন্য তাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আর আমরা বলেছি, প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় অধিকার ভোটাধিকার এত দিন ছিল না। এ দাবি সবার আগে আমরা তুলেছিলাম। আমরা এ দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় প্রবাসীদের হয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই; এই প্রথমবারের মত ব্যাপক ভিত্তিক আমাদের প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে।”
ভোটার হওয়ার জন্য অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এ জন্য যে সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে তা প্রোপারলি ফাংশন করে নাই, যার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভোটার হতে পারেননি। আমাদের দাবি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন এই সময় বর্ধিত করা হোক এবং যে জটিলতাগুলো রয়েছে- এগুলো সহজ করে তাদেরকে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আরও কিছু সমস্যা আছে; কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড যথেষ্ট। পাশাপাশি তার যদি একটা ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকে-তাহলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এর বাইরে যে সব শর্ত তা যেন শিথিল করে দেয়।”
তুরস্ক সফর সফল হয়েছে জানিয়ে দলটির আমির বলেন, “তুরস্কে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি যারা আছেন তাদের সঙ্গে আমার বসা হয়েছে, তাদের কথাও শোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলে নিজের কোনো প্রয়োজনে দেশ থেকে বের হইনি। আমি বের হয়েছিলাম দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনে। যেখানেই গিয়েছে জনগণের স্বার্থকে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখেই কথা বলার চেষ্টা করেছি।”
তিনি বলেন, “দুনিয়ার সকলের সাথেই আমরা সম্মানজনক সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্কটা হবে মিউচুয়াল রেসপেক্ট এবং ইকিউয়িটির ভিত্তিতে।”
সৌদি আরবে পবিত্র ওমরা পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক সফর শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার ভোরে ঢাকায় ফেরেন।
এ সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দলের সিনিয়র নেতারা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।
দলের নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম ও এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলালসহ কেন্দ্রীয় আরো অনেক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা