প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে ছুটে চলেছি চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের পথ ধরে। মেছো বিড়াল নিয়ে জনসংযোগ এবং গবেষণার জন্য স্থানীয় সংগঠন পানকৌড়ি কনজারভেশন ক্লাবের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে একটার পর একটা জনপদ আর বিল-বাঁওড় ঘুরছিলাম। বিস্তীর্ণ গ্রামীণ বন আর জলাভূমিবিধৌত এলাকা। এখানে মেছো বিড়াল নিয়ে জনমনে ভয়-আতঙ্ক আছে বটে। তবে মানুষ-মেছো বিড়ালের সংঘাতের কারণগুলো ঠিক সিলেটের জেলাগুলোর মতো নয়। জেলে, খামারি আর গৃহস্থের কাছে মেছো বিড়াল পরিচিত মুখ। এর মধ্যে সঙ্গী বখতিয়ার হামিদ জানালেন, সহজলভ্য এই মেছো বিড়াল বিনা কারণে শুধু মারাই পড়ে না, প্রায়ই অবৈধভাবে তাদের চিড়িয়াখানায় রাখা হয়।
দুপুরের প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে আমাদের বাহন ছুটল মুজিবনগরের মনোরমা পার্ক অ্যান্ড চিড়িয়াখানার দিকে। ছোট এই চিড়িয়াখানায় বন্দী একটি মেছো বিড়াল দেখলাম। বেশ বড় আকারের। না খেতে পেয়ে একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমে হাড়-মাংসে এক হয়ে যাওয়া প্রাণীটি রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। দ্রুত তাকে শিরার মাধ্যমে তরল দিতে না পারলে যেকোনো দিন মারা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে তো বন্য প্রাণীর চিকিৎসাব্যবস্থা ভালো নয়। আশপাশে শত কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টার। শ্রীমঙ্গলে রেসকিউ সেন্টারটিতে বন্য প্রাণীর চাপ বেশি, কাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে—এ নিয়ে আছে প্রতিযোগিতা। আটকানো প্রাণীদের মধ্যে আরও ছিল মুখপোড়া হনুমান, বানর, মেটেমাথা কুড়া ইগল আর ঝুঁটিবিহীন শজারু। সবার অবস্থা তথৈবচ—অনেকেই পড়ে আছে কংক্রিটের মেঝেতে। সব মিলিয়ে প্রাণীদের এই দুরবস্থা আর নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে রোদের তীব্রতা তাই সহনীয়ই লাগছিল।
মেছো বিড়াল মূলত একটি ছোট প্রজাতির বিড়াল। ৫ থেকে ১৬ কেজির প্রাণীটি মূলত দক্ষিণ এশিয়ার জলাভূমি-অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করে। মেছো বিড়াল তার জলজ অভ্যাস ও মাছ ধরার কৌশলের জন্য পরিচিত। খাটো গড়নের মেছো বিড়ালদের লেজও ছোট। শরীরে খড়-হলুদের মধ্যে ছোট ছোট কালো ছোপ। আর সেখানেই যত সমস্যা। দেখা গেলেই মনে করা হয় বাঘ বেরিয়েছে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে দেখামাত্রই মেছো বিড়াল পিটিয়ে মারার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। পানকৌড়ি কনজারভেশন ক্লাবের প্রচেষ্টায় আনা কিছু কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ল। গাংনী উপজেলার এক বিরান বিলে এক খামারির সঙ্গে পরিচয় হলো। যিনি এখন মেছো বিড়াল রক্ষায় নিয়োজিত। দামুড়হুদার রায়সার বিলে নৃশংসভাবে মেছো বিড়াল হত্যার ঘটনায় দ্রুত সরকারি পদক্ষেপের সুফল দেখলাম। পানকৌড়ির লাগানো পোস্টার চোখে পড়ল, মানুষ বেশ সচেতন। বিলটি বিশাল, বাইক্কা বিলের চেয়ে কোনো অংশে কম সমৃদ্ধ নয়। তবে সেভাবে পরিচিত নয় মোটেও।
তবে আশ্চর্য হওয়ার আরও বাকি ছিল। বিকেলের দিকে গেলাম দামুড়হুদার মেহেরুন শিশুপার্ক আর মিনি চিড়িয়াখানায়। সেখানে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, একটি মেছো বিড়াল আর একটি জার্মান শেফার্ড কুকুর লাগোয়া দুই খাঁচায় পাশাপাশি রাখা। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে জিব বের করে দুজনই নিশ্বাস ফেলছে। ঠান্ডার দেশের জন্য উপযুক্ত জার্মান শেফার্ডের পশম কাটা হয় না বহুদিন। পাত্রে নেই কোনো পানি। মেয়ে মেছো বিড়ালটির স্বাস্থ্য মুজিবনগরের আটকে থাকা হতভাগার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো মনে হলো। তবে বেশ দুর্বল। কুকুর আর বিড়াল কেউ কারও দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। দুই খাঁচায়ই দর্শনার্থীদের ছোড়া বোতল, কাঠের টুকরো আর ইট পড়ে আছে। আরেক খাঁচায় এক বানরের বোতলের পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে তা চেটে খাওয়ার দৃশ্য ছিল হৃদয়বিদারক। বখতিয়ার হামিদের চোখে পানি খেয়াল করলাম।
দক্ষিণ-পশ্চিমের এই জেলা দুটিতে যথেষ্ট পরিমাণে মেছো বিড়াল রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর আর আলমডাঙ্গার প্রায় ৩০ জন নিবেদিতপ্রাণ তরুণের পরিচয় হওয়া ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। পানকৌড়ি কনজারভেশন ক্লাবের এই কার্যক্রমে সাম্প্রতিক সময়ে আরণ্যক ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করছে। সরকারি সংস্থা বন বিভাগ আর স্থানীয় তরুণদের একসঙ্গে যুক্ত করতে আরণ্যক ফাউন্ডেশনের এই প্রচেষ্টা চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে এই প্রথম। এক তরুণ বললেন, যদি সারা দেশ থেকেও মেছো বিড়াল হারিয়ে যায়, শেষ মেছো বিড়ালগুলো টিকে থাকবে এ এলাকায়।
আমাদের অনেক কিছু করার আছে। উদ্ধার করা প্রাণীদের চিকিৎসাব্যবস্থা আর পুনর্বাসনকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পশুচিকিৎসকদের বন্য প্রাণীদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। মৌলভীবাজারের মেছো বিড়ালের সংরক্ষণ উদ্যোগের আদলে বাংলাদেশের নানা জায়গায় এই উদ্যোগ নিতে হবে। দ্রুত নেওয়া দিবসভিত্তিক ও মিডিয়াকেন্দ্রিক কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে এসে মেছো বিড়ালদের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। সব উদ্যমী, তরুণ স্বেচ্ছাসেবক আর নাগরিক বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাটাও জরুরি। কারণ, পরিবেশ সংরক্ষণ কোনো প্রতিযোগিতা নয়। দুই দিনে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের পথে-প্রান্তরে ২৫০ কিলোমিটার ঘুরেও তাই মনে হলো, যথেষ্ট হলো কি? মনে ভাসছিল ধুঁকতে থাকা খাঁচায় বন্দী দুই মেছো বিড়ালের কথা।
মুনতাসির আকাশ, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন য প র ণ প রচণ ড র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
বন্দরে মুকুলের উপর সন্ত্রাসী হামলা, আমির হোসেনের নিন্দা
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ও বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আতাউর রহমান মুকুলের উপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে র্তীব্র নিন্দা জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সাবেক সহ সভাপতি ও বন্দর থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি আমির হোসেনসহ যুবদল নেতৃবৃন্দ। সোমবার (৩০ জুন) বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ নিন্দা জ্ঞাপন করেন।
সাবেক যুবদল নেতা আমির হোসেন জানান, মহানগর বিএনপি সাবেক নেতা ও বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আতাউর রহমান মুকুলের উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি অত্যান্ত নেক্কার জনক ঘটনা। এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় আমিসহ যুবদল নেতাকর্মীরা র্তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সে সাথে হামলাকারি ডন বজলুসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দাবি জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, গত রোববার দুপুরে দাবিকৃত ১৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে সোনারগাঁও এলাকার মূর্তিমান আতংক বজলু রহমান ওরফে ডন বজলুর নেতৃত্বে তার সন্ত্রাসী বাহিনী বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আতাউর রহমান মুকুলের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে বিবস্ত্র করে সম্মানহানী করে।