আমাদের সংস্কৃতি বদলায়নি, বদলেছে সংহতি
Published: 17th, May 2025 GMT
‘সহমত ভাইয়ের’ সংস্কৃতি আমাদের বদলায়নি। শুধু বদলেছে সংহতির ধরন। দুই দিন আগে যে কাজকে অপরাধ মনে হতো, এখন সেটি অপরাধ নয়, স্বাদে পরিণত হয়েছে। কারণ, আগে যারা অনাচার করত, তারা অন্য মতের মানুষ ছিল। আর এখন যারা করে, তারা একই কাতারের।
কথায় কথায় সড়ক অবরোধ, আস্ত শহরটা স্থবির করে দেওয়া, মোড়ে মোড়ে-পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি, চাঁদাবাজি, উৎকোচ তোলা—কী পাল্টেছে? ২৪-এর আগস্টের দিন তিনেক ‘এসব হয়নি’, কর্তা নির্বাচনের শূন্যতায়। এখন তথৈবচ অবস্থা।
খোলনলচে, অর্থাৎ পরিবর্তন কি হয়নি? হয়েছে। তবে নাসিক্যের ইন্দ্রিয় চেতনও পাল্টেছে। মাকালের গন্ধেও এখন গোলাপের ঘ্রাণ লাগে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতার চরিত্র, প্রতাপ ও নৈতিক কাঠামো অপরিবর্তিত থেকেছে। ভাষা, মূল্যবোধ ও অনুভবের জগতে সংস্কৃতি রূপান্তরিত হয়েছে শাসকের অনুকূলে।
ইতালীয় বিপ্লবী আন্তনিও গ্রামসির মতে, ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগে টেকে না, তাকে টিকিয়ে রাখে সমাজের সাংস্কৃতিক সম্মতি, যার মাধ্যমে শাসকের মূল্যবোধই সাধারণ বোধ বা কমনসেন্স হয়ে ওঠে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আকাশে যে লাল ললিত উদিত হয়েছিল, গত কয়েক দিনে কেন যেন মনে হচ্ছে, তা ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে।
চলমান বিভাজনের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটা বলা যায় যে ক্ষমতা হাতবদল হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতার ভাষা, যুক্তি, নৈতিকতা বদলায়নি। আগে সোনা মিয়া ছিল, এখন দিন দু–এক ছদ্মবেশে থেকে লাল মিয়া এসেছে। সমাজের ‘সাধারণ বোধ’ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে মানুষ নিজেরাই বোঝে না, তারা যে মূল্যবোধ ধারণ করছে, সেটি তাদের নয়—শাসক বা ক্রীড়নকদের স্বার্থেই গঠিত। কে যে কাকে খেলাচ্ছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে বল যে মাঠের বাইরে থেকেই খেলানো হচ্ছে, তা স্পষ্টত। জন্মের শুরু থেকে এটাই বাংলাদেশের ভাগ্যের নির্মমতা।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ‘পাওয়ার অ্যান্ড ডিসকোর্স’ তত্ত্বে বলেছেন, ক্ষমতা কেবল চোখে দেখা যায় না, এটা ভাষা ও জ্ঞান দিয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়। সমাজে কোন আচরণ ‘সত্য’ বা ‘নৈতিক’ বলে মানা হবে, তা নির্ধারিত হয় ভাষা ও ব্যাখ্যা যার ক্ষমতায় থাকে, তার দ্বারা। ক্ষমতার মোহে অনাচার অপরাধ নয়, রস-স্বাদে রূপান্তরিত হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী জার্মান-মার্কিন দার্শনিক হারবার্ট মারকুজ মনে করেন, আধুনিক শিল্পসমাজে মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যাতে সে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
পুঁজিবাদ ও প্রযুক্তির যৌথ প্রভাবে ব্যক্তি হয়ে ওঠে একমাত্রিক—সে যা দেখে, তা-ই বিশ্বাস করে; নতুন কিছু কল্পনা করতে পারে না। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের নাগরিকেরা যে নতুনের কল্পনা করেছিল, তা বাংলাদেশের জন্য ছিল টেকসই উন্নয়ন ও টিকে থাকার লক্ষণ। কিন্তু হালের অনৈক্য আবার আকাশে কালো মেঘের পূর্বাভাস দিচ্ছে।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দোর ভাবনা দিয়ে আলোচনা শেষ করা যায়। বুর্দোর মতে, প্রতিটি মানুষ ‘হ্যাবিটাস’ দিয়ে পরিচালিত হয়। হ্যাবিটাস হলো, সমাজের ভেতরে বেড়ে ওঠার ফলে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা অবচেতন অভ্যাস ও মানসিকতা।
চীন বিপ্লবের দলিল এডগার স্নোর বই ‘রেড স্টার ওভার চায়না’তে মাও সে–তুংকে নিয়ে আলোচনায় এই হ্যাবিটাস ওঠে এসেছে ‘আর্লি ইমপ্যাক্ট অব সোশ্যালাইজেশন’ তথা ব্যক্তির জীবনে তাঁর বেড়ে ওঠার প্রভাব হিসেবে। অর্থাৎ ব্যক্তি যত বড়ই হোক না কেন, চিন্তাচেতনায় তাঁর কিশোরকাল প্রভাব রাখবেই।
সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক—দুই ভাবেই হতে পারে। মাওয়ের জীবনে কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের প্রতি তাঁর জোতদার বাবার আচরণ উল্টো ভাবনা, তথা কৃষকদের অনুকূলে খোরাক জুগিয়েছিল। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, হ্যাবিটাসের মাধ্যমে মানুষ জগৎ বোঝে, সিদ্ধান্ত নেয়, ক্ষমতা গ্রহণ করে। আমাদের নয়া রাষ্ট্রীয় কর্তাদের হ্যাবিটাস কী, তার ওপর নির্ভর করবে আগামীর বাংলাদেশ।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, মানুষ জন্মঘর দিয়ে নয়, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিয়ে পরিচালিত হয় বেশি। সেই পরিবেশ হতে পারে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক বলয়, ধর্মীয় অনুশাসন, সমাজ ব্যবস্থাপনা, বন্ধু–জগৎ, বইপড়া ইত্যাদি।
সুতরাং আমাদের রাষ্ট্রীয় নয়া অভিভাবকদের পড়ালেখা, শিল্পসাহিত্যচর্চার ধরনই ঠিক করবে আগামীর বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। তবে ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তাঁর গণ্ডি পরিবর্তন করতে পারেন। আমাদের প্রত্যাশা, ‘ক্রেডিটবাজি’ বাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে আমাদের নয়া অভিভাবকেরা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে সুখী-সমৃদ্ধ ও স্বাতন্ত্র্য হিসেবে গড়ে তুলবেন।
মো.                
      
				
                    
    
				 ছানাউল্লাহ সহসম্পাদক, প্রথম আলো
[email protected]
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগান পছন্দ হয়নি স্যামির
চট্টগ্রামের সাগরিকায় উপস্থিত থাকা দর্শকরা গতকাল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সাপোর্ট করেছে এমন কথা শুনলে অবাক হবেন নিশ্চিয়ই? অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যিই এমন কিছুই হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে।
 ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ বাংলাদেশ দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দর্শকরা আপাতদৃষ্টিতে এমনটাই মনে হয়েছে। লাল-সবুজের পতাকা গ্যালারিতে উড়তে দেখা যায়নি তেমনটা নয়। কিন্তু ম্যাচ যত গড়িয়েছে সেই পতাকা উড়ানোও তত কমেছে। টিকিটের মূল্য একেবারে হাতের নাগালে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তবুও ভরেনি গ্যালারি। 
লিটন, জাকের, তাসকিন, শরিফুল, সাইফদের পারফরম্যান্স এমন গড়পড়তা যে সমর্থকরা প্রতিপক্ষের ব্যাটিং-বোলিং দেখেই বেশি আনন্দিত হচ্ছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যে নিবেদন, যে চাহিদা তা রোস্টন চেজ, আকিম আগাস্তের ব্যাটে পাওয়া গেলে সমর্থকদের দোষ কোথায়? তাদের চার-ছক্কায় গ্যালারিতে তালির ঝড় উঠে। উল্লাস, উদ্দীপনায় মাততে দেখা যায়।
 আর স্বাগতিক দলের জন্য উড়ে আসে দুয়ো ধ্বনি। ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগান চললো পুরো ম্যাচ জুড়েই। বিশেষ করে সীমানায় থাকা ক্রিকেটাররা দর্শকদের রোষানলে পড়লেন বেশি। শুধু তা-ই নয়, স্টেডিয়ামের যাওয়া-আসার পথেও সেই সমর্থকরাই ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগানে এলোমেলা করে দেন ক্রিকেটারদের। 
বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে এসব স্লোগান একেবারেই পছন্দ হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ ড্যারেন স্যামির। ক্যারিয়ারে নানা সময় বাংলাদেশে আসায় কিছুটা বাংলা শব্দ তারও জানা। তবে ভুয়া অর্থটা জেনেছেন এবারই। তাইতো তার হৃদয়ে কিছুটা দহনও হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য, “তারা (দর্শকরা) ক্রিকেটারদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করেছে, সেটা আমার ভালো লাগেনি। আমি শুনেছি তারা ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলছে। এর অর্থও আমি জেনেছি। কিন্তু আমি মনে করি না, হোম টিমের দর্শক হিসেবে এমন করা উচিত। কারণ আপনারা তখন সমর্থক। প্রত্যেক ক্রিকেটারই মাঠে আসে তাদের সেরাটা দেওয়ার জন্য। তাই আপনাদের উচিত, তাদের সমর্থন করা।”
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুইবার বিশ্বকাপ জেতানো স্যামি কঠিন সময়ে ক্রিকেটারদের পাশে থাকার কথা বললেন, ‘‘তবুও তারা (দর্শকরা) ভালো। তারা নিজেদের দলকে পারফর্ম করতে দেখতে চায়। তবে যত বেশি সমর্থন ও উৎসাহ দেবেন, তারা তত দূর যেতে পারবে। ক্রিকেটারদের অযথা চাপে ফেলবেন না। ফ্যানদের বলব, তাদের (ক্রিকেটারদের) সঙ্গে সুন্দর আচরণ করুন।”
চট্টগ্রাম/ইয়াসিন