‘সহমত ভাইয়ের’ সংস্কৃতি আমাদের বদলায়নি। শুধু বদলেছে সংহতির ধরন। দুই দিন আগে যে কাজকে অপরাধ মনে হতো, এখন সেটি অপরাধ নয়, স্বাদে পরিণত হয়েছে। কারণ, আগে যারা অনাচার করত, তারা অন্য মতের মানুষ ছিল। আর এখন যারা করে, তারা একই কাতারের।

কথায় কথায় সড়ক অবরোধ, আস্ত শহরটা স্থবির করে দেওয়া, মোড়ে মোড়ে-পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি, চাঁদাবাজি, উৎকোচ তোলা—কী পাল্টেছে? ২৪-এর আগস্টের দিন তিনেক ‘এসব হয়নি’, কর্তা নির্বাচনের শূন্যতায়। এখন তথৈবচ অবস্থা।

খোলনলচে, অর্থাৎ পরিবর্তন কি হয়নি? হয়েছে। তবে নাসিক্যের ইন্দ্রিয় চেতনও পাল্টেছে। মাকালের গন্ধেও এখন গোলাপের ঘ্রাণ লাগে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতার চরিত্র, প্রতাপ ও নৈতিক কাঠামো অপরিবর্তিত থেকেছে। ভাষা, মূল্যবোধ ও অনুভবের জগতে সংস্কৃতি রূপান্তরিত হয়েছে শাসকের অনুকূলে।

ইতালীয় বিপ্লবী আন্তনিও গ্রামসির মতে, ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগে টেকে না, তাকে টিকিয়ে রাখে সমাজের সাংস্কৃতিক সম্মতি, যার মাধ্যমে শাসকের মূল্যবোধই সাধারণ বোধ বা কমনসেন্স হয়ে ওঠে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আকাশে যে লাল ললিত উদিত হয়েছিল, গত কয়েক দিনে কেন যেন মনে হচ্ছে, তা ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে।

চলমান বিভাজনের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটা বলা যায় যে ক্ষমতা হাতবদল হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতার ভাষা, যুক্তি, নৈতিকতা বদলায়নি। আগে সোনা মিয়া ছিল, এখন দিন দু–এক ছদ্মবেশে থেকে লাল মিয়া এসেছে। সমাজের ‘সাধারণ বোধ’ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে মানুষ নিজেরাই বোঝে না, তারা যে মূল্যবোধ ধারণ করছে, সেটি তাদের নয়—শাসক বা ক্রীড়নকদের স্বার্থেই গঠিত। কে যে কাকে খেলাচ্ছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে বল যে মাঠের বাইরে থেকেই খেলানো হচ্ছে, তা স্পষ্টত। জন্মের শুরু থেকে এটাই বাংলাদেশের ভাগ্যের নির্মমতা।

ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ‘পাওয়ার অ্যান্ড ডিসকোর্স’ তত্ত্বে বলেছেন, ক্ষমতা কেবল চোখে দেখা যায় না, এটা ভাষা ও জ্ঞান দিয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়। সমাজে কোন আচরণ ‘সত্য’ বা ‘নৈতিক’ বলে মানা হবে, তা নির্ধারিত হয় ভাষা ও ব্যাখ্যা যার ক্ষমতায় থাকে, তার দ্বারা। ক্ষমতার মোহে অনাচার অপরাধ নয়, রস-স্বাদে রূপান্তরিত হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী জার্মান-মার্কিন দার্শনিক হারবার্ট মারকুজ মনে করেন, আধুনিক শিল্পসমাজে মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যাতে সে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

পুঁজিবাদ ও প্রযুক্তির যৌথ প্রভাবে ব্যক্তি হয়ে ওঠে একমাত্রিক—সে যা দেখে, তা-ই বিশ্বাস করে; নতুন কিছু কল্পনা করতে পারে না। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের নাগরিকেরা যে নতুনের কল্পনা করেছিল, তা বাংলাদেশের জন্য ছিল টেকসই উন্নয়ন ও টিকে থাকার লক্ষণ। কিন্তু হালের অনৈক্য আবার আকাশে কালো মেঘের পূর্বাভাস দিচ্ছে।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দোর ভাবনা দিয়ে আলোচনা শেষ করা যায়। বুর্দোর মতে, প্রতিটি মানুষ ‘হ্যাবিটাস’ দিয়ে পরিচালিত হয়। হ্যাবিটাস হলো, সমাজের ভেতরে বেড়ে ওঠার ফলে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা অবচেতন অভ্যাস ও মানসিকতা।

চীন বিপ্লবের দলিল এডগার স্নোর বই ‘রেড স্টার ওভার চায়না’তে মাও সে–তুংকে নিয়ে আলোচনায় এই হ্যাবিটাস ওঠে এসেছে ‘আর্লি ইমপ্যাক্ট অব সোশ্যালাইজেশন’ তথা ব্যক্তির জীবনে তাঁর বেড়ে ওঠার প্রভাব হিসেবে। অর্থাৎ ব্যক্তি যত বড়ই হোক না কেন, চিন্তাচেতনায় তাঁর কিশোরকাল প্রভাব রাখবেই।

সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক—দুই ভাবেই হতে পারে। মাওয়ের জীবনে কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের প্রতি তাঁর জোতদার বাবার আচরণ উল্টো ভাবনা, তথা কৃষকদের অনুকূলে খোরাক জুগিয়েছিল। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, হ্যাবিটাসের মাধ্যমে মানুষ জগৎ বোঝে, সিদ্ধান্ত নেয়, ক্ষমতা গ্রহণ করে। আমাদের নয়া রাষ্ট্রীয় কর্তাদের হ্যাবিটাস কী, তার ওপর নির্ভর করবে আগামীর বাংলাদেশ।

তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, মানুষ জন্মঘর দিয়ে নয়, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিয়ে পরিচালিত হয় বেশি। সেই পরিবেশ হতে পারে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক বলয়, ধর্মীয় অনুশাসন, সমাজ ব্যবস্থাপনা, বন্ধু–জগৎ, বইপড়া ইত্যাদি।

সুতরাং আমাদের রাষ্ট্রীয় নয়া অভিভাবকদের পড়ালেখা, শিল্পসাহিত্যচর্চার ধরনই ঠিক করবে আগামীর বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। তবে ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তাঁর গণ্ডি পরিবর্তন করতে পারেন। আমাদের প্রত্যাশা, ‘ক্রেডিটবাজি’ বাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে আমাদের নয়া অভিভাবকেরা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে সুখী-সমৃদ্ধ ও স্বাতন্ত্র্য হিসেবে গড়ে তুলবেন।

মো.

ছানাউল্লাহ সহসম্পাদক, প্রথম আলো

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ষমত র আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় যাত্রীকে তুলতে অস্বীকৃতি উবার চালকের

চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবারের একটি গাড়ি ডেকেছিলেন মাইকেল। গাড়িটি আসার পর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যেতেই বাধল বিপত্তি। ‘অতিরিক্ত মোটা’ হওয়ায় চালক তাঁকে গাড়িতে তুলতে অস্বীকৃতি জানান। যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

গেমিং প্ল্যাটফর্ম টুইচের জনপ্রিয় স্ট্রিমার মাইকেল। ওই প্ল্যাটফর্মে তাঁর ৬০ হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। তিনি তাঁর কল অব ডিউটি গেমপ্লের জন্য পরিচিত।

মাইকেল সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। ভিডিওর শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘আমি মজা করছি না। আমার উবার চালক বলেছেন, আমি নাকি অনেক বেশি মোটা। তাই তাঁর গাড়িতে আমাকে নেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি তিনি আমার দিকে বন্দুক তাক করার হুমকিও দিয়েছেন।’ মাইকেলের ওই ভিডিও পাঁচ কোটিবারের বেশি দেখা হয়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, মাইকেল উবারের গাড়িচালককে বলছেন, ‘আপনি এইমাত্র বললেন, আমি নাকি অনেক বেশি মোটা। আমি কিন্তু আপনার ভিডিও করছি।’ উত্তরে উবার চালক নারী বলেন, ‘এটা যুক্তি আর বাস্তবতার ব্যাপার। আর আমি এটা বলার অধিকার রাখি।’ কিন্তু বাক্যটি শেষ করার আগেই মাইকেল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘না, আপনি এটা বলতে পারেন না।’ তখন ওই নারী হাত উঁচিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি পারি। এটা আমার গাড়ি। আপনি এখান থেকে চলে যান।’

বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে ওই উবার চালক বলেন, ‘আপনি কি চান, আমি আমার বন্দুকটা বের করি?’ এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাইকেল গাড়ির দরজা বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যান। এক্সে দেওয়া অন্য একটি পোস্টে মাইকেল বলেন, এ ঘটনার কারণে তিনি সেদিন চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেননি।

উবারের নীতি অনুযায়ী, চালকেরা বৈধ কারণ ছাড়া কোনো যাত্রীকে গাড়িতে তুলতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না। ওজন, লিঙ্গ, বর্ণ কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো যাত্রীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

এই ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর উবার চালকের আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন অনেকে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিফাক শব্দের অর্থ কী এবং মুনাফিকের লক্ষণগুলো কী
  • বৈষম্যের খাঁচা আদৌ কি আমরা ভাঙতে চাই
  • হবিগঞ্জে কনসার্টে বিশৃঙ্খলার পর নারীদের হেনস্তা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ
  • পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা ভিনগ্রহের বস্তু নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ইলন মাস্ক
  • অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় যাত্রীকে তুলতে অস্বীকৃতি উবার চালকের