প্রেস সচিবের বক্তব্যের প্রতিবাদ বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার
Published: 18th, May 2025 GMT
‘বামদের দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড হলে বাংলাদেশে জব হবে না, বাংলাদেশকে উনারা বনসাই বানিয়ে রাখতে চান’—প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের এমন বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা। একই সঙ্গে তারা এ বক্তব্যের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেছে।
সম্প্রতি প্রেস সচিব শফিকুল আলম একটি বেসরকারি টেলিভিশনে আলোচনায় অংশ নিয়ে বামধারার রাজনীতিবিদদের নিয়ে এমন মন্তব্য করেন। আজ রোববার এক যৌথ বিবৃতিতে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার নেতারা বলেন, ‘শফিকুল আলমের এই বক্তব্য একদেশদর্শী, পক্ষপাতদুষ্ট ও বিদ্বেষপ্রসূত। তাঁর এই বক্তব্যের ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই।’
বিবৃতিতে বলা হয়, বহু দেশবিরোধী চুক্তির বিরোধিতা করে আন্দোলন করেছে বাম গণতান্ত্রিক শক্তি। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগসহ যারাই দেশের জনগণের স্বার্থ বিদেশিদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে, দেশের স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে, বিদেশি কোম্পানির কমিশনভোগী, তারাই বামপন্থী শক্তিকে উন্নয়নবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল ইজারা দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে—প্রেস সচিবের এমন বক্তব্যেরও কড়া সমালোচনা করা হয়েছে বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, এই সরকারের বিচার, সংস্কার, নির্বাচন আর রুটিন কাজ করার এখতিয়ার আছে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই কেবল সংস্কার করতে পারবে। অথচ বন্দর, মানবিক করিডরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিবৃতিতে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার নেতারা বলেন, ‘আমরা প্রেস সচিবের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। একই সঙ্গে প্রেস সচিবের এসব বক্তব্য নিয়ে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করছি।’
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, সিপিবির সভাপতি শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও গণমুক্তি ইউনিয়নের সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন আহম্মদ নাসু, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের আহ্বায়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক হারুনার রশিদ ভূঁইয়া প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হজযাত্রার আদিকথা
চট্টগ্রাম বন্দর ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল ও ব্রিটিশ রাজত্বের সময় থেকে হজযাত্রীদের জেদ্দায় যাতায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। যদিও এই যাত্রার লিখিত ইতিহাস সীমিত, তবু চট্টগ্রামের হজযাত্রার ঐতিহ্য এবং এর সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ঐতিহাসিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লেখযোগ্য।
মোগল ও ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম বন্দর
মোগল ও ব্রিটিশ রাজত্বের সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হজযাত্রীরা সমুদ্রপথে জেদ্দায় যাতায়াত করতেন। তবে এই যাত্রার বিস্তারিত লিখিত নথি পাওয়া কঠিন। ব্রিটিশ আমল থেকে আরব উপদ্বীপের মোয়াল্লেমরা (হজযাত্রীদের থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যবস্থাপক) হজের কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামে এসে স্থানীয় ব্যক্তিদের বাড়িতে অবস্থান করতেন। তাঁরা জেদ্দা, মক্কা, মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফা ও মদিনায় হজযাত্রীদের জন্য ব্যবস্থাপনার তথ্য প্রচার করতেন, যা ছিল তাঁদের জীবিকার প্রধান উৎস। মোয়াল্লেমরা হজ কাফেলা গঠন করতেন এবং স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করতেন। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হজযাত্রীরা চট্টগ্রামে এসে যাত্রার প্রস্তুতি নিতেন। এই ব্যবস্থা প্রায় ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
যদিও ব্রিটিশ প্রশাসন ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বোম্বে (মুম্বাই) থেকে হজযাত্রার ব্যবস্থাপনা করত, চট্টগ্রামে মোয়াল্লেমদের ব্যবস্থাপনা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতো।
পাকিস্তান আমলে হজযাত্রা
ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের পর পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে হজ ক্যাম্প স্থাপন করে। এটি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের হজযাত্রীদের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। সে সময়ে বিমান পরিবহন থাকলেও জাহাজে যাতায়াত ছিল তুলনামূলক সাশ্রয়ী, ফলে বেশির ভাগ হজযাত্রী সমুদ্রপথ বেছে নিতেন। ‘শাফিনা-ই-আরব’ ও ‘সারধানা’ নামের দুটি জাহাজ প্রতিটি দুই ট্রিপে হজযাত্রীদের জেদ্দায় নিয়ে যেত। প্রথম ট্রিপ ঈদুল ফিতরের এক সপ্তাহ পর শুরু হতো এবং অনেক হজযাত্রী ঈদের পরপরই পাহাড়তলীর হজ ক্যাম্পে এসে জড়ো হতেন।
প্রতি জাহাজে প্রায় ৬৫০ জন হজযাত্রী পরিবহন করা হতো, ফলে দুটি জাহাজের প্রথম ট্রিপে মোট ১ হাজার ৩০০ জন জেদ্দায় যেতেন। ১৯৪৮ সালে, সরকারি ব্যবস্থাপনার প্রথম বছরে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩ হাজার ৮৯৫ জন হজযাত্রী জেদ্দায় গিয়েছিলেন। দূরদূরান্ত থেকে হজযাত্রীদের সুবিধার জন্য রেল ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের টিকিটে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। হজ মৌসুমে চট্টগ্রাম হজযাত্রী, তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের ভিড়ে উৎসবমুখর হয়ে উঠত।
আরও পড়ুনবিরে রুমা: মদিনার পানির সংকট দূর করেছে যে কুয়া০৩ মে ২০২৫জাহাজ ও পরিবহনব্যবস্থা
প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ মালিকানাধীন ‘এম্পায়ার অরওয়েল’, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘সারধানা’ এবং বোম্বেভিত্তিক মোগল শিপিং লাইনসের ‘ইসলামি’ ও ‘মুহাম্মদি’ জাহাজগুলো ভাড়া করা হতো। এই জাহাজগুলো চট্টগ্রাম ও করাচি বন্দর থেকে জেদ্দায় হজযাত্রী পরিবহন করত। ১৯৬০ সাল থেকে পাকিস্তান সরকারের প্যান ইসলামিক স্টিম শিপ কোম্পানির জাহাজ, যেমন ‘শাফিনা-ই-আরব ১ ও ২’, ‘শাফিনা-ই-মুরাদ’, ‘শাফিনা-ই-হাজ্জাজ’ এবং ‘শাফিনা-ই-আবিদ’ এই কাজে নিয়োজিত হয়। এ ছাড়া ‘এমভি শামস’ নামের একটি জাহাজ নিয়মিত চট্টগ্রাম ও করাচিতে চলাচল করত। ‘শাফিনা-ই-হাজ্জাজ’ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যার ধারণক্ষমতা ছিল প্রায় ৪ হাজার যাত্রী। হজ মৌসুমের বাইরে এই জাহাজগুলো মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হতো।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে জাহাজের তৃতীয় শ্রেণি বা ডেকে ভ্রমণ করে হজ পালনের খরচ ছিল ১ হাজার ৯১৯ টাকা, যার মধ্যে ৯১৯ টাকা ছিল জাহাজ ভাড়া এবং বাকি ১ হাজার টাকা মক্কায় থাকাখাওয়া ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য খরচ ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং প্রথম শ্রেণির জন্য ৭ হাজার টাকা। তবে করাচি থেকে বিমানে হজযাত্রার খরচ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বন্দর
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের মালিকানাধীন ‘শাফিনা-ই-আরব’ ও ‘শাফিনা-ই-আরাফাত’ জাহাজ দুটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ২ হাজার ৭০০ পূর্ব পাকিস্তানি হজযাত্রী নিয়ে জেদ্দায় যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দরে মাইনের উপস্থিতির কারণে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। ‘মুহাম্মদি’ জাহাজ চট্টগ্রামের পরিবর্তে মোংলায় যায়, কিন্তু নাব্যতা সংকটের কারণে সেখানে নোঙর করতে ব্যর্থ হয় এবং চাঁদপুরে নোঙর করে। ফিরে আসা হজযাত্রীদের আত্মীয়স্বজনকে মোংলা থেকে চাঁদপুরে যেতে হয়েছিল।
আরও পড়ুনবিরে গারস: যে কুয়ায় নবীজি (সা.) গোসল করতেন০৪ মে ২০২৫১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ হাজার ৬০০ হজযাত্রী হজ পালন করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ‘হিজবুল বাহার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করে, যা ১৯৭৭ থেকে পাঁচ-ছয় বছর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জেদ্দায় হজযাত্রী পরিবহন করে। তবে ১৯৮৫ সালের পর থেকে হজযাত্রীরা বিমানে যাতায়াত শুরু করেন এবং সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম থেকে হজযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পাহাড়তলী হজ ক্যাম্প থেকে হজ-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হতো। পরবর্তী সময়ে ঢাকার আশকোনায় স্থায়ী হজ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখান থেকে বাংলাদেশের হজযাত্রীদের সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হজযাত্রীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। মোগল ও ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশক পর্যন্ত, এই বন্দর হজযাত্রার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। সমুদ্রপথে হজযাত্রা বন্ধ হলেও চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্য বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫