সামাজিক ব্যবসার মডেল কি স্বাস্থ্যসেবার নতুন দিশা
Published: 23rd, May 2025 GMT
স্বাস্থ্য খাত মানবসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলেও বাংলাদেশে এটি ক্রমেই ব্যবসায়িক রূপ নিয়েছে। বেসরকারি খাত কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন; তারা শুধু মুনাফার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে এবং তাদের সেবার খরচ গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। সরকারি হাসপাতালগুলো ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকটও রয়েছে। অর্থের অভাবে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যেন অনেকের জন্য স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবাকে সম্পূর্ণভাবে মুনাফানির্ভর ব্যবসায় পরিণত করা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়; কেননা এটি সরাসরি মানুষের জীবন ও সুস্থতার সঙ্গে জড়িত। ১৯৭০ সালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান ‘সর্বোচ্চ মুনাফা’ করাকেই ব্যবসার মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করেন। আর এর বিপরীতে এসে আরেক নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম বলেন যে ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হবে সমাজের কল্যাণ নিশ্চিতকরণ কিংবা এক বা একাধিক সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ।
স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এখন প্রয়োজন ঠিক এমনই একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি, যেখানে ব্যবসায়িক কাঠামো ঠিক রেখেই সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য ও মানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে কাজ করা হবে। এতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে, আবার সাধারণ মানুষও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পাবে। ড.
‘সামাজিক ব্যবসা’ শব্দবন্ধটিই যেন একধরনের দ্বন্দ্ব। ‘সামাজিক’ শব্দটি সাধারণত মানুষের কল্যাণ, মানবতা ও সেবার প্রতীক। অন্যদিকে ‘ব্যবসা’ মানেই মুনাফা অর্জন, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং বাজারকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা। একদিকে নিঃস্বার্থ সেবা, অন্যদিকে লাভের হিসাব—এই দুই বিপরীত ধারণার সংমিশ্রণকে স্ববিরোধী মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই শব্দ যুগল যখন এক হয় তখন তারা বিপরীত ধারার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। এটি ব্যবসার সাধারণ ধারণা বা কাঠামোকে ব্যবহার করে আর্থিক স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। কিন্তু লক্ষ্য থাকে সামাজিক সমস্যার সমাধান।
এককথায় কনভেনশনাল বিজনেস মডেলে সমাজের সমস্যা দূরীকরণ কিংবা দারিদ্র্য বিমোচন প্রধানতম উদ্দেশ্য নয়, বরং একধরনের বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত)। অন্যদিকে সামাজিক ব্যবসা মডেলে সামাজিক কল্যাণই হলো মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এটি ব্যবসার মতো পরিচালিত হলেও উদ্দেশ্য থাকে সমাজের উন্নয়ন, মুনাফা নয়।
মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি প্রস্তাবের পর ২০০৬ সালে গ্রামীণ ড্যানন ফুডস এবং ২০০৮ সালে গ্রামীণ ভিওলিয়া ওয়াটার-এর মতো প্রকল্প চালু করেন। এই প্রকল্পগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল যথাক্রমে অপুষ্টি দূর করা এবং আর্সেনিক সমস্যার সমাধান (আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের মাধ্যমে)। অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ধারণাটি বাংলাদেশে একটি নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করে। ধারণা করা যায়, সেই সময় যদি সরকারের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠা যেত।
বর্তমানে গ্রামীণ কল্যাণ দেশব্যাপী ১৪৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে ও বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। এ ছাড়া গ্রামীণ হেলথ সার্ভিসেস লিমিটেড বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, বরিশাল ও সাতক্ষীরায় চক্ষু হাসপাতালের মাধ্যমে স্বল্প ও বিনা মূল্যে চোখের চিকিৎসা এবং অপারেশন সেবা দিচ্ছে। ঢাকায় ৫০০ শয্যার একটি ‘টারশিয়ারি লেবেল’-এর হাসপাতাল নির্মাণাধীন, যা সামাজিক ব্যবসা মডেলে পরিচালিত হবে। এসব কার্যক্রমে বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসা মডেলকে বেগবান করবে।
কথায় আছে, ‘স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কোনো ব্যয় নয় বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ’। স্বাস্থ্য খাতে যত ব্যয় করা হয়, ফেরত পাওয়া যায় তার থেকে বহুগুণ বেশি। আর এই বিনিয়োগ হচ্ছে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, জনগণের পকেট থেকে নয়। অথচ সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনগণের পকেট থেকে চিকিৎসা বাবদ যে খরচ হয়, তার ৬৪ শতাংশ হয় ওষুধের পেছনে এবং ১১-১৩ শতাংশ খরচ হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। অর্থাৎ শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধ কেনাতেই তিন-চতুর্থাংশ টাকা খরচ হয়ে যায়। তাই শুধু এই দুই খাতে নেওয়া কিছু উদ্যোগ এবং আধুনিক ধারণার প্রয়োগ দেশের স্বাস্থ্য খাতকে আমূল বদলে দিতে পারে।
সামাজিক ব্যবসার জনপ্রিয়তা এবং বৈশ্বিক বিস্তৃতিস্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসা মডেল একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফিলিপাইনের কথা। ফিলিপাইনে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে চালু করা ‘পিপলস ফার্মেসি’ মডেল স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ‘জেনেরিক’ ওষুধ সরবরাহ করে যাচ্ছে, যেখানে সরকার ভর্তুকি ও ট্যাক্স ছাড় দিয়ে ওষুধের দাম আরও কমিয়ে এনে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ওষুধসেবা সহজলভ্য করে তুলেছে। স্থানীয়ভাবে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশেও মডেলটি প্রয়োগ করা যেতে পারে, যাতে করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওষুধের খরচ কমে এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হয়।
অন্যদিকে রোগনির্ণয় বা ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচও এই দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ। এ সমস্যা সমাধানে পৃথিবীর অনেক দেশই এখন সামাজিক ব্যবসা মডেল প্রয়োগ করছে। কেনিয়ার ‘মেডিক মোবাইল’ মডেল এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যা সাধারণত মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্প খরচে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়। এই মডেল বিশেষভাবে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালের সুবিধা খুবই সীমিত।
মেডিক মোবাইল স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও রোগনির্ণয়ের সুবিধা প্রদান করে। মডেলটি চালু হওয়ার পর দেশটিতে রোগীদের উচ্চ খরচের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন কমে গেছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা আগের তুলনায় সাশ্রয়ী হয়েছে।
স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে বাংলাদেশেও মডেলটি প্রয়োগ করে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচ কমানোর বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা চাইলেই ভাবতে পারেন। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে এই মডেল বাস্তবায়ন করলে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচ কমবে এবং তাতে যে শুধু অর্থনৈতিক চাপ কমবে, তা নয়, বরং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান আরও গণমুখী হবে।
সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় দেশের মানুষের জন্য একটি স্বাস্থ্যবিমা প্রণয়নের কথা বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই মডেল এমনকি বিমা খাতেও প্রয়োগ করা সম্ভব। আফ্রিকার দেশগুলো তাদের স্বাস্থ্যবিমায় সামাজিক ব্যবসা মডেল অন্তর্ভুক্ত করে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ঘানার ‘ন্যাশনাল হেলথ ইনস্যুরেন্স স্কিম’ একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যেখানে সামাজিক ব্যবসা মডেলের নীতিগুলো ব্যবহার করে স্বাস্থ্যবিমাসেবা প্রসারিত করা হয়েছে।
মডেলটির বিশেষত্ব হলো এতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় সম্প্রদায় একত্রে কাজ করে এবং সামাজিক ব্যবসা মডেলের মূল নীতি অনুসারে, এই স্কিম লাভের চেয়ে সামাজিক কল্যাণকে প্রাধান্য দেয়। ঘানায় এই মডেলের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এসেছে, যা তাদের চিকিৎসা খরচের বোঝা অনেকাংশে কমিয়েছে।
সামাজিক ব্যবসা মডেল ব্যবহার করে হৃদ্রোগের চিকিৎসা, এমনকি কার্ডিয়াক স্টেন্টিংয়ের ক্ষেত্রেও সাশ্রয়ী ও টেকসই সমাধান দেওয়া সম্ভব। এর একটি উদাহরণ হলো ভারতের ‘নারায়ণ হেলথ’ মডেল। এটা হৃদ্রোগের চিকিৎসাকে, বিশেষ করে কার্ডিয়াক স্টেন্টিংকে জনগণের জন্য আরও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে তুলেছে।
এই মডেলে রোগীর আর্থিক সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে উচ্চ মানের হৃদ্রোগ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। ফলে কার্ডিয়াক স্টেন্টিংয়ের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো দেওয়া হয় মাত্র ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ রুপিতে, যা বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম। এই মডেলের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো স্থানীয়ভাবে তৈরি স্টেন্ট ব্যবহার করা, চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অস্ত্রোপচারকক্ষের সর্বোচ্চ ব্যবহার। এ ছাড়া এই মডেলে দরিদ্র রোগীদের জন্য ক্রেডিট সুবিধা দেওয়া হয়, যাতে তারা চিকিৎসা খরচ মেটাতে পারে।
সারা পৃথিবীতেই স্বাস্থ্য খাতে ‘সামাজিক ব্যবসা’ মডেল প্রয়োগের এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। সাশ্রয়ী মূল্যে কৃত্রিম পা সরবরাহ করার জন্য পাকিস্তান ও নেপালের জয়পুর ফুট, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে চশমা সরবরাহ করার জন্য এল সালভাদর এবং পেরুর ভিশন স্প্রিং, সৌরশক্তিচালিত হিয়ারিং এইড উৎপাদন করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সেলেকো, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য উচ্চ মানের ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান করার জন্য মেক্সিকোর সালুদ ডিগনা এবং ব্রাজিলের ড্রাগস ফর নেগলেক্টেড ডিজিজেস ইনিশিয়েটিভ হলো এ রকম উদ্যোগ। এই উদ্যোগগুলো পৃথিবীব্যাপী ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবাকে নিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে।
চ্যালেঞ্জ কোথায়বাংলাদেশে আগেই এ ধরনের উদ্যোগ মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে এলেও তা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। সময় ও বাস্তবতা অনেক বদলে গেলেও সমস্যাগুলো খুব একটা এখনো বদলায়নি। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান সেবাদান-কাঠামো অত্যন্ত খণ্ডিত এবং একই সঙ্গে বহুস্তরবিশিষ্ট, যেখানে সরকারি, বেসরকারি, এনজিও এবং ব্যক্তি খাত এখনো একে অপরের সঙ্গে সমন্বয়হীনভাবে কাজ করছে। এর ফলে কম সময়ে একটি ‘ইন্টিগ্রেটেড’ সামাজিক ব্যবসা মডেল প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জটিল। যে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অধিকাংশ খরচ এখনো রোগীদের পকেট থেকে আসে, সেখানে সাশ্রয়ী সেবা প্রদানের সামাজিক ব্যবসা মডেল আর্থিকভাবে টেকসই করাটা সহজ নয়।
অন্যদিকে সরকারি সেবা ব্যবস্থায় দায়বদ্ধতা ও নজরদারির যে অভাব রয়ে গেছে, তাকে সঙ্গী করে সামাজিক ব্যবসা মডেল চালু হলেও এর কার্যকারিতা ও গুণগত মান নিশ্চিত করা সহজ হবে না। বেসরকারি খাতের ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক বাজারে শক্তিশালী করপোরেট স্বার্থ এবং লবির যে প্রভাব, তাতে কম দামে সেবা পৌঁছে দেওয়ার যেকোনো ধরনের প্রয়াস যে বাধাগ্রস্ত হবে, তা সহজেই অনুমেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশে এখনো সামাজিক ব্যবসাকে আলাদা ব্যবসায়িক শ্রেণি হিসেবে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বা উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা হলে হয়তো প্রয়োজনীয় নিবন্ধন, করকাঠামো বা নীতিগত সুবিধা পাওয়া যেত।
সমাধান কীসামাজিক ব্যবসা মডেলের ধারণাকে সব উদ্যোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সরকারের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য খাতে সামাজিক ব্যবসা মডেল ফলপ্রসূ করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন আইনগত স্বীকৃতি প্রদান, আর্থিক প্রণোদনা (করছাড়, অনুদান, ভর্তুকি), পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) গঠন এবং বৈদেশিক সাহায্যকে সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে সংযুক্ত করা।
এ ছাড়া আইনগত কাঠামো তৈরি করে এবং করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি কার্যক্রমে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে সামাজিক ব্যবসাগুলোর পরিচালনা সহজ করা যেতে পারে। আর্থিক প্রণোদনা ও বিশেষ তহবিলের মাধ্যমে তাদের টেকসই হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব। পিপিপি মডেলের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এবং বৈদেশিক সাহায্যকে সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করে এর কার্যকারিতা বাড়ানো যেতে পারে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে, পরিবর্তনের নতুন স্বপ্ন তৈরি করবে—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। স্বাস্থ্য খাতেও সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগবে, সেই স্বপ্ন দেখাটায় নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত
ডা. সুব্রত পাল স্বাস্থ্য অর্থনৈতিক ইউনিটে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কর্মরত
মতামত লেখকদের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ম জ ক ব যবস র ব যবহ র কর ন ম ন আয় র ব যবস র ম ব যবস য় ক সরক র র ব সরক র ক সমস য সরবর হ আর থ ক উল ল খ লক ষ য দর দ র কল য ণ র খরচ
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’