সামাজিক মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সর্বশেষ পোস্ট করেছে– ‘উইদাউট ইটস ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস, হার্ভার্ড ইজ নট হার্ভার্ড’। অর্থাৎ হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ছাড়া হার্ভার্ডই নয়। মানে হার্ভার্ডকে তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা। সেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ট্রাম্পের সে উদ্যোগ সাময়িক স্থগিত করেছেন। 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধের সূচনা এ বছরের মার্চ মাসে। এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসনবিরোধী বিক্ষোভ রয়েছে এ সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। ট্রাম্প প্রশাসন এসব বিক্ষোভকে ‘অ্যান্টিসেমিটিক’ চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু হার্ভার্ড প্রশাসন অভিযোগ নাকচ করে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে।

বলা বাহুল্য, হার্ভার্ড শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়; বিশ্বেরও অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। টাইমস হায়ার এডুকেশনের ২০২৫ সালের বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিংয়ে হার্ভার্ড-এর অবস্থান ৩ নম্বরে। অন্যদিকে কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির র‍্যাঙ্কিং (২০২৫) অনুযায়ী হার্ভার্ডের অবস্থান ৪ নম্বরে। এমনকি ২০২৩ সালে টাইমস হায়ার এডুকেশনের র‍্যাঙ্কিংয়ে ২০২৩ সালে বিশ্বের ১ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল।
হার্ভার্ডের শিক্ষা ও গবেষণার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সর্বশেষ বারাক ওবামাসহ যুক্তরাষ্ট্রের আটজন প্রেসিডেন্ট হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়; ১৬৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। একই সঙ্গে শীর্ষ ধনী বিশ্ববিদ্যালয়ও বলা যায়। হার্ভার্ডের এমন অবস্থানের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়টি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে লড়াই করার হিম্মত রাখছে।
গত এপ্রিল মাসে ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ডের ডাইভার্সি, ইকুইটি ও ইনক্লুশন তথা বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রোগ্রাম বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দাবি জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেসব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। সে জন্য ট্রাম্প প্রশাসন অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয় এবং হার্ভার্ডের ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সরকারের গবেষণা অনুদান স্থগিত করে। এর পর হার্ভার্ড এই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক দাবি করে আদালতে মামলা করে। আর ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে হার্ভার্ড দ্বিতীয় দফায় মামলা করে ২৩ মে, যখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক ও প্রতিশোধমূলক দাবি করে মামলায় উল্লেখ করা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে হার্ভার্ডের সাত সহস্রাধিক বিদেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় পড়বে। আরও বলা হয়, এর মাধ্যমে হার্ভার্ড বিশ্বের সেরা শিক্ষার্থীদের আকর্ষণের জায়গা হারানোর শঙ্কায় পড়বে। যদিও আদালত ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে সাময়িকভাবে বাতিল করেছেন, এর পরও শঙ্কা কাটেনি।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাম্প প্রশাসনের বিরোধ আমাদের জন্যও শিক্ষণীয়। বিশেষত, এটি দেখিয়ে দিয়েছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীর অধিকার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কতটা সোচ্চার হতে পারে। একই সঙ্গে সরকারের হস্তক্ষেপের সীমারেখাও দেখিয়ে দিয়েছে হার্ভার্ড। ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের পর হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালান এম.

গারবার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও স্কলারদের উদ্দেশ করে যে বাণী দিয়েছেন, সেখানেও তিনি প্রশাসনের পরিকল্পনাকে ‘অন্যায় ও অনধিকার’ চর্চার শামিল আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, আমরা আপনাদের সহায়তা করব এবং হার্ভার্ডকে বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ও হার্ভার্ডের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন। বিশেষ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে সরকার তোষণের কাজ করে, তা কতটা লজ্জাজনক, সে ইঙ্গিতই অনেকের বক্তব্যে স্পষ্ট। ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাধর ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যায্য পদক্ষেপে হার্ভার্ড প্রশাসন সমর্থন দেওয়া তো দূরের বিষয়, বরং তাঁর বিরুদ্ধে আদালত পর্যন্ত গেছে।  

অথচ আমরা দেখে এসেছি, আমাদের দেশে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সব পদক্ষেপ কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অকপটে মেনে নেয়! শুধু মানাই নয়, বরং সুবিধা পাওয়ার জন্য শিক্ষকরা সরকারপ্রধানের গুণগান গাওয়া, এমনকি অন্যায় দেখলেও নীরব থাকার ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব নির্লজ্জ কাজ অবলীলায় ঘটেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই ছিল আরও এগিয়ে।
এখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা শিক্ষকদের একার দোষ নেই। বরং সরকারও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে গড়ে তুলেছে। যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য যখন উপাচার্য হওয়ার মানদণ্ড বানানো হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার আলাপ তোলার সুযোগ কোথায়? তা ছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তার ওপর অন্যায়ের প্রতিকারে আদালতের আশ্রয় নিয়েছে এবং আদালতও স্বাধীনভাবে রায় দিয়েছেন। অর্থাৎ শেষ ভরসার জায়গা হিসেবে আদালতের ভূমিকাও এখানে স্পষ্ট।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের কাছে নানাভাবে বন্ধনে আবদ্ধ। সরকারও সেই বন্ধন শিথিল করতে নারাজ। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠতে গেলে এসব বন্ধন শিথিল করতেই হবে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট যেভাবে দ্ব্যর্থহীনভাবে ট্রাম্প প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, আমাদের উপাচার্যরা কি তা পারবেন?
এ জন্য প্রথমেই দলীয় বিবেচনার পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার জন্য স্বাধীনতা ও বরাদ্দ দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি উপাচার্য নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠন করেছে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারগুলোরও এ ক্ষেত্রে সদিচ্ছা থাকতে হবে। হার্ভার্ড অন্তত সে পথই দেখাচ্ছে।

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ব ধ নত উপ চ র য অন য য় র জন য আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘দুই বছর ধরে ঘুরছি, তবু এনআইডি ঠিক হলো না’

দুই বছর ধরে জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) মা–বাবার নাম সংশোধনের জন্য চট্টগ্রামের নির্বাচন কার্যালয়ে ঘুরছেন মো. সাইফুল ইসলাম। কিন্তু এত দিনের চেষ্টার পরও মেলেনি সমাধান।

নগরের উত্তর কাট্টলীতে বসবাসকারী সাইফুল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। জীবিকার তাগিদে যখন যা পান, তা-ই করেন। কয়েক বছর ধরে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সে লক্ষ্যে পাসপোর্ট করতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর এনআইডিতে বাবা ও মায়ের নাম ভুল। এরপর পাসপোর্ট কার্যালয়ের পরামর্শে এনআইডি সংশোধনের জন্য প্রায় দুই বছর আগে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আবেদন করেন তিনি।

গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয় প্রাঙ্গণে কথা হয় সাইফুলের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। প্রথম আলোকে সাইফুল বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় বাবার ডাকনাম কবির আহম্মদ আর মায়ের নাম বুলুয়ারা বেগম দিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার আসল নাম এস এম তৈয়বুর রহমান ও মায়ের নাম বুলু আক্তার। এ কারণে সংশোধনের আবেদন করেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।’

সাইফুল জানান, জাতীয়তা সনদ, প্রত্যয়নপত্র, মা-বাবার এনআইডির অনুলিপি, ভাইয়ের এনআইডি, এমনকি মা-বাবার নিকাহনামাও জমা দিয়েছেন। তবু ফল মেলেনি।

সাইফুল জানান, জাতীয়তা সনদ, প্রত্যয়নপত্র, মা–বাবার এনআইডির অনুলিপি, ভাইয়ের এনআইডি, এমনকি মা–বাবার নিকাহনামাও জমা দিয়েছেন। তবু ফল মেলেনি। তিনি বলেন, ‘দুই বছর ধরে ঘুরছি। কত কাগজ দিলাম, কত লোক ধরলাম। এখন পর্যন্ত কিছু হলো না। ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।’

জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে অনেকেই ভিড় করেন প্রতিদিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্লাস্টিক দূষণ ঠেকাতে অর্থনৈতিক খাতের দায়
  • ঢাবির সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থীদের দেখার কেউ নেই
  • ‘দুই বছর ধরে ঘুরছি, তবু এনআইডি ঠিক হলো না’
  • মুখ দিয়ে লিখে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন বাহার
  • কুয়া