অনলাইনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভিডিও কতজন চিনতে পারে
Published: 26th, May 2025 GMT
আমার খুব কাছের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয়। নতুন এই ডিজিটাল বিশ্বে তাঁদের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, কেউ কেউ গুগলে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু খুঁজেও বের করতে পারেন।
হোয়াটসঅ্যাপে ফাইল শেয়ার করতে কিছুটা ঝামেলা হলেও অনায়াসে অডিও-ভিডিও কল করতে পারেন। এর মাধ্যমে দূর পরবাসে অবস্থিত স্বজনের সঙ্গে যেমন তাঁরা কথা বলতে পারছেন, তেমনি আবার মুঠোফোনে পাঠাতে পারছেন বাড়ি থেকে দূরে থাকা সন্তানের মাসের খরচ। ডিজিটাল এই পরিষেবা পরিণত বয়সে এসে তাঁদের জীবনে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা।
সমস্যাটা শুরু হয় ডিজিটাল জীবনযাপনের আলোচনা আরেকটু এগিয়ে নিলে। নিজেদের প্রতি বেজায় সন্তুষ্ট থেকে ওনারা বুঝতে থাকেন, উনি যে রাজনৈতিক বা আদর্শিক জায়গা থেকে চিন্তা করেন, পুরো ইন্টারনেট সেভাবেই চিন্তা করছে। অন্য সবার সঙ্গে তাঁদের চিন্তাধারা এতটাই মিলে যাচ্ছে, গোটা জীবদ্দশায় কেন জানি সেটি শুধু এই ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার পরই সম্ভব হচ্ছে।
একজন ভাবছেন, অমুক দেশ খুব ভালো, অন্যদের ভিডিওতে তিনি দেখছেন সবাই তেমনটিই মনে করছেন। আবার অন্য একজন যিনি ভাবছেন, সেই একই দেশ খারাপ, তিনিও দেখছেন পুরো ইন্টারনেট ওনার সঙ্গে একমত হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
ইউটিউবের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভিউ, লাইক, ক্লিকবেট, কমেন্টের ব্যবসাটা ওনাদের বোঝার কথা নয়। যে ভিডিও উনি দেখতে চান, শুধু সে ভিডিওগুলোই ওনার সামনে এনে তুলে ধরার জন্য কত কত গবেষণা যে হয়ে গেছে, অপরূপ ডিজিটাল দুনিয়ার বিরূপ সে অংশটুকু ওনাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে।
ইউনেসকো–আইপিএসওএসের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা ৮৫ ভাগ নাগরিক অনলাইনে ভুল তথ্যের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। আমাদের দেশের জন্য সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন হবে। আমাদের এক বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনো জানেনই না কী সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে অনলাইনে ও বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুল তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানো সম্ভব। আমাদের অবস্থা হয়েছে ‘মাথাও নেই, মাথাব্যথাও নেই’ ধরনের। ভুল তথ্য ছড়ানো হয়—সেটি না জানলে সেটি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার তো সুযোগই নেই, কারণও নেই।
আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের হলেও গণহারে তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে বলে প্রচার করতে পারি, তাহলে ১৩ কোটি মানুষের সর্বনিম্ন তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতাটুকু কেন নিশ্চিত করতে পারি না?তথ্য সাক্ষরতা বলতে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করা ও ব্যবহার করাকে বোঝানো হয়ে থাকলেও, মিডিয়া সাক্ষরতায় মিডিয়ার বিষয়বস্তুকে সমালোচনামূলকভাবে বোঝা ও সে অনুযায়ী আচরণ করার বিষয়ও রয়েছে।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর মিডিয়া লিটারেসি এডুকেশনের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, মিডিয়া বলতে বার্তা প্রেরণের জন্য ব্যবহৃত সব ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম, মুদ্রিত বা শৈল্পিক দৃশ্য হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমকে বোঝায়। মিডিয়া সাক্ষরতা হলো সব ধরনের মিডিয়া ব্যবহার করে বার্তা বা তথ্য প্রাপ্তি (অ্যাকসেস), সেটির বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, নতুন তথ্য তৈরি এবং মিডিয়াকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা।
এর মধ্যে মিডিয়া ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি বা মিডিয়াকে যথার্থভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারটা সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য অনেক পরে বিবেচনায় আসবে। অন্যদিকে দেশব্যাপী ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন ওয়েবসাইট, সামাজিক মাধ্যম, অ্যাপ, ইত্যাদির মাধ্যম মানুষ আশপাশ থেকে শিখেই ব্যবহার শুরু করেছে, অর্থাৎ একটু চেষ্টা করলেই অ্যাকসেস পাচ্ছে। সমস্যাটা হচ্ছে তথ্য বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে গিয়ে।
মিডিয়ায় আসা বার্তা বা সংবাদের উদ্দেশ্য বোঝা, তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বা নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা, ভুয়া খবর ও ভুল তথ্য শনাক্ত করতে পারা, এদিক থেকে বলতে গেলে একেবারেই পিছিয়ে আছে মিডিয়া সাক্ষরতা না থাকা আমাদের এক বিশাল জনগোষ্ঠী। ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সম্পাদিত এবং উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে হতে পারে, সেটি জানেন না অনেক ব্যবহারকারী। অথচ গুজব এবং ভুয়া খবরকে উপলক্ষ করে অস্থিরতা সৃষ্টি, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে।
আরও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, যাঁরা কনটেন্ট তৈরি করেন, তাঁদেরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশ সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কনটেন্ট তৈরি করেন বা ভিউ বাড়িয়ে আয় করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুয়া তথ্যসংবলিত, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কনটেন্ট তৈরি করেন। ইউনেসকোর সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, দুই–তৃতীয়াংশ ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা অনলাইনে তথ্য শেয়ার করার আগে পদ্ধতিগতভাবে তথ্য যাচাই করেন না।
আমাদের ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব ছিল এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ দেশের কোটি মানুষ ক্রিকেট খেলা দেখে, সে খেলার সময় নিয়মিত কি সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা যায় না? রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর নীতিমালা কি তৈরি করা যায় না? শুধু ২০২৪ সালেই ইউনেসকো ৩২টি দেশকে জাতীয় মিডিয়া ও তথ্য সাক্ষরতা নীতি এবং কৌশল তৈরিতে সহায়তা করেছে।
আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের হলেও গণহারে তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে বলে প্রচার করতে পারি, তাহলে ১৩ কোটি মানুষের সর্বনিম্ন তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতাটুকু কেন নিশ্চিত করতে পারি না?
ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে, অথচ প্রাথমিক জিনিসপত্র শেখানো সম্ভব নয়, এমনটি বলার সুযোগ তো আর নেই। যাযাবর বলেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু বাড়িয়ে দিয়েছে আবেগ। সে আবেগ সংবরণের জন্য তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতার বিকল্প নেই।
● ড.
বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ন শ চ ত কর কনট ন ট স ক ষরত ১৩ ক ট আম দ র অন য য় র জন য র করত
এছাড়াও পড়ুন:
দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম, এখানে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই: জেড আই খান পান্না
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।
আজ শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বারের হলরুমে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার সংকট ও আইনি প্রতিকার পাওয়ার পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জেড আই খান পান্না। সেমিনারটির আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস (এইচআরসিবিএম), বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।
বক্তব্যে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এখানে সংখ্যালঘুর কথা বলা হচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। আজ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেখি, জুতা দিয়ে বাড়ি দিতে দেখি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। তাই আমি সবচেয়ে বড় অসহায়।’
এসব কথা বলতে বলতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জীবনে কখনো জেনে-বুঝে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন, তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
জেড আই খান পান্না আরও বলেন, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এটা সাম্প্রদায়িকতার দেশ না। সংবিধানে যেন কেউ হাত না দেয়। সরকারের অনেকেই বিদেশি হয়েও স্বদেশি ভাব দেখাচ্ছেন।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমাজে ন্যায়বিচার বা সুবিচার পাওয়ার কথা থাকলেও তা মিলছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার হয় না। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে বেরিয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন কুমার রায় বলেন, সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা হলেও সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না, এমনকি দুঃখও প্রকাশ করে না।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ শুরু হলে তা দমন করতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে উল্লেখ করে সুমন কুমার দাবি করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনাতনী সম্প্রদায়ের বাক্স্বাধীনতা বন্ধ করতে, নেতৃত্ব দমন করতে এসব করা হচ্ছে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে কে পাল। সঞ্চালনায় ছিলেন এইচআরসিবিএমের বাংলাদেশ চ্যাপটারের আহ্বায়ক লাকি বাছাড়। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ও মো. গোলাম মোস্তফা।