আমার খুব কাছের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয়। নতুন এই ডিজিটাল বিশ্বে তাঁদের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, কেউ কেউ গুগলে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু খুঁজেও বের করতে পারেন।

হোয়াটসঅ্যাপে ফাইল শেয়ার করতে কিছুটা ঝামেলা হলেও অনায়াসে অডিও-ভিডিও কল করতে পারেন। এর মাধ্যমে দূর পরবাসে অবস্থিত স্বজনের সঙ্গে যেমন তাঁরা কথা বলতে পারছেন, তেমনি আবার মুঠোফোনে পাঠাতে পারছেন বাড়ি থেকে দূরে থাকা সন্তানের মাসের খরচ। ডিজিটাল এই পরিষেবা পরিণত বয়সে এসে তাঁদের জীবনে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা।

সমস্যাটা শুরু হয় ডিজিটাল জীবনযাপনের আলোচনা আরেকটু এগিয়ে নিলে। নিজেদের প্রতি বেজায় সন্তুষ্ট থেকে ওনারা বুঝতে থাকেন, উনি যে রাজনৈতিক বা আদর্শিক জায়গা থেকে চিন্তা করেন, পুরো ইন্টারনেট সেভাবেই চিন্তা করছে। অন্য সবার সঙ্গে তাঁদের চিন্তাধারা এতটাই মিলে যাচ্ছে, গোটা জীবদ্দশায় কেন জানি সেটি শুধু এই ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার পরই সম্ভব হচ্ছে।

একজন ভাবছেন, অমুক দেশ খুব ভালো, অন্যদের ভিডিওতে তিনি দেখছেন সবাই তেমনটিই মনে করছেন। আবার অন্য একজন যিনি ভাবছেন, সেই একই দেশ খারাপ, তিনিও দেখছেন পুরো ইন্টারনেট ওনার সঙ্গে একমত হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

ইউটিউবের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভিউ, লাইক, ক্লিকবেট, কমেন্টের ব্যবসাটা ওনাদের বোঝার কথা নয়। যে ভিডিও উনি দেখতে চান, শুধু সে ভিডিওগুলোই ওনার সামনে এনে তুলে ধরার জন্য কত কত গবেষণা যে হয়ে গেছে, অপরূপ ডিজিটাল দুনিয়ার বিরূপ সে অংশটুকু ওনাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে।      

ইউনেসকো–আইপিএসওএসের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা ৮৫ ভাগ নাগরিক অনলাইনে ভুল তথ্যের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। আমাদের দেশের জন্য সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন হবে। আমাদের এক বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনো জানেনই না কী সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে অনলাইনে ও বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুল তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানো সম্ভব। আমাদের অবস্থা হয়েছে ‘মাথাও নেই, মাথাব্যথাও নেই’ ধরনের। ভুল তথ্য ছড়ানো হয়—সেটি না জানলে সেটি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার তো সুযোগই নেই, কারণও নেই।

আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের হলেও গণহারে তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে বলে প্রচার করতে পারি, তাহলে ১৩ কোটি মানুষের সর্বনিম্ন তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতাটুকু কেন নিশ্চিত করতে পারি না? 

তথ্য সাক্ষরতা বলতে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করা ও ব্যবহার করাকে বোঝানো হয়ে থাকলেও, মিডিয়া সাক্ষরতায় মিডিয়ার বিষয়বস্তুকে সমালোচনামূলকভাবে বোঝা ও সে অনুযায়ী আচরণ করার বিষয়ও রয়েছে।

ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর মিডিয়া লিটারেসি এডুকেশনের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, মিডিয়া বলতে বার্তা প্রেরণের জন্য ব্যবহৃত সব ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম, মুদ্রিত বা শৈল্পিক দৃশ্য হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমকে বোঝায়। মিডিয়া সাক্ষরতা হলো সব ধরনের মিডিয়া ব্যবহার করে বার্তা বা তথ্য প্রাপ্তি (অ্যাকসেস), সেটির বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, নতুন তথ্য তৈরি এবং মিডিয়াকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা। 

এর মধ্যে মিডিয়া ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি বা মিডিয়াকে যথার্থভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারটা সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য অনেক পরে বিবেচনায় আসবে। অন্যদিকে দেশব্যাপী ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন ওয়েবসাইট, সামাজিক মাধ্যম, অ্যাপ, ইত্যাদির মাধ্যম মানুষ আশপাশ থেকে শিখেই ব্যবহার শুরু করেছে, অর্থাৎ একটু চেষ্টা করলেই অ্যাকসেস পাচ্ছে। সমস্যাটা হচ্ছে তথ্য বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে গিয়ে।

মিডিয়ায় আসা বার্তা বা সংবাদের উদ্দেশ্য বোঝা, তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বা নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা, ভুয়া খবর ও ভুল তথ্য শনাক্ত করতে পারা, এদিক থেকে বলতে গেলে একেবারেই পিছিয়ে আছে মিডিয়া সাক্ষরতা না থাকা আমাদের এক বিশাল জনগোষ্ঠী। ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সম্পাদিত এবং উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে হতে পারে, সেটি জানেন না অনেক ব্যবহারকারী। অথচ গুজব এবং ভুয়া খবরকে উপলক্ষ করে অস্থিরতা সৃষ্টি, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। 

আরও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, যাঁরা কনটেন্ট তৈরি করেন, তাঁদেরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশ সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কনটেন্ট তৈরি করেন বা ভিউ বাড়িয়ে আয় করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুয়া তথ্যসংবলিত, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কনটেন্ট তৈরি করেন। ইউনেসকোর সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, দুই–তৃতীয়াংশ ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা অনলাইনে তথ্য শেয়ার করার আগে পদ্ধতিগতভাবে তথ্য যাচাই করেন না।

আমাদের ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্ব ছিল এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ দেশের কোটি মানুষ ক্রিকেট খেলা দেখে, সে খেলার সময় নিয়মিত কি সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা যায় না? রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর নীতিমালা কি তৈরি করা যায় না? শুধু ২০২৪ সালেই ইউনেসকো ৩২টি দেশকে জাতীয় মিডিয়া ও তথ্য সাক্ষরতা নীতি এবং কৌশল তৈরিতে সহায়তা করেছে। 

আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের হলেও গণহারে তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে বলে প্রচার করতে পারি, তাহলে ১৩ কোটি মানুষের সর্বনিম্ন তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতাটুকু কেন নিশ্চিত করতে পারি না? 

ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে, অথচ প্রাথমিক জিনিসপত্র শেখানো সম্ভব নয়, এমনটি বলার সুযোগ তো আর নেই। যাযাবর বলেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু বাড়িয়ে দিয়েছে আবেগ। সে আবেগ সংবরণের জন্য তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতার বিকল্প নেই।  

ড.

বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ন শ চ ত কর কনট ন ট স ক ষরত ১৩ ক ট আম দ র অন য য় র জন য র করত

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে বইমেলায় বিক্রি কম, এখনো আশায় আছেন প্রকাশকেরা

রাজশাহী বিভাগীয় বইমেলার প্রথম তিন দিনে লোকজনের ভিড় থাকলেও বেচাকেনা তেমন হয়নি। এতে অনেক প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকেরা ও আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা কালেক্টরেট মাঠে ৯ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে এবং রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ মেলা চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০টি বেসরকারি প্রকাশনাসহ মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে মেলা চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়।

উদ্বোধনের আগের দিন বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। সেই কর্দমাক্ত পরিবেশেই মেলার উদ্বোধন হয়। দর্শনার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পরে প্রতিটি স্টলের সামনে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বিক্রির খরা কাটেনি বলে জানালেন বিক্রেতারা।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন অংশে তখনো পানি জমে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলেও কাদা। সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। স্টলের সামনে ইটের সলিংয়ের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন অনেকে। অনেকে বই দেখছেন।

সূর্যোদয় প্রকাশনীর বিক্রেতা রিপন আলী বলেন, প্রথম দিন তো কাদাপানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো মানুষ ছিলেন। এখন ইট বিছানোর পর আরও বেশি মানুষ আসছেন, ভিড়ও করছেন, কিন্তু বই কিনছেন খুব কম।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে কাদার ওপর চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল বিক্রয়কর্মী ও চিত্রশিল্পী অর্ণব পাল সন্তুকে। তিনি বলেন, মানুষ আসছেন, ঘুরে দেখছেন, কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। মেলার ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতে পারত। আরেক বিক্রেতা আবদুল্লাহ হীল বাকি জানালেন, এমনও স্টল আছে, যেখানে সারা দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বইও বিক্রি হচ্ছে না।

তবে হতাশার ভিড়ে আশার কথাও শোনালেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম থেকে আসা নন্দন বইঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, বেচাবিক্রি আজ না হোক কাল হবে। মানুষ যে মেলায় এসে বই হাতে নিয়ে দেখছেন, এটাই বড় পাওয়া। এতে তাঁদের মধ্যে বই কেনার আগ্রহ তৈরি হবে।

মেলায় আসা পাঠকদের মধ্যে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। দুই সন্তানের জন্য শিশুতোষ বই কিনে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম।
মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের বই কিনেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় একসঙ্গে অনেক বই পাওয়া যায়, যা বই কেনার জন্য দারুণ সুযোগ।

রাজশাহী কালেক্টরেট মাঠে বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ