Risingbd:
2025-05-27@20:31:02 GMT

‘সাগরমাথা’ জয় যেন এক রূপকথা

Published: 27th, May 2025 GMT

‘সাগরমাথা’ জয় যেন এক রূপকথা

পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট, নেপালি নাম ‌‌‘সাগরমাথা’, তিব্বতি ভাষায় চোমোলুংমা, অর্থাৎ ‘পৃথিবীর দেবী মা’। উচ্চতা প্রায় ৮,৮৪৮ মিটার (বর্তমানে কিছু গবেষণায় ৮,৮৪৯.৮৬ মিটার)। বহু শতাব্দী ধরে এই পর্বতশৃঙ্গকে মানুষ শ্রদ্ধা ও ভয়—দুয়ের মিশ্রণে দেখেছে।

১৮৫৬ সালে ব্রিটিশরা একে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর থেকেই শুরু হয় মানুষের একটি অনন্ত আকাঙ্ক্ষা—‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রাখতেই হবে।’

কিন্তু এভারেস্ট ছিল এক ‘দুর্জেয় দুর্গ’। প্রকৃতির চরম প্রতিকূলতা, অনিশ্চিত আবহাওয়া, ভয়ঙ্কর ঠান্ডা, আর শ্বাসরুদ্ধকর উচ্চতা—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক মৃত্যুকূপের মতো।

এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখতে যাওয়া মানেই মৃত্যুর পায়তারা। শুরুতে যারা গিয়েছিলেন, তারা কেউ ফিরেও আসেননি। প্রথম অভিযান হয় ১৯২১ সালে। তারপর ১৯২৪ সালে জর্জ ম্যালোরি এবং অ্যান্ড্রু আরভাইন ব্রিটিশ অভিযানে অংশ নিয়ে চূড়ার খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তবে তারা ফিরে আসেননি। ম্যালোরির একটি বিখ্যাত উক্তি ইতিহাসে অমর হয়ে আছে “Because it’s there.

এভারেস্ট যেন তখন থেকেই এক অনতিক্রম্য পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় ৩০ বছর ধরে অনেক দেশ, বহু অভিযান—সবই ব্যর্থ হয়। অনেক টাকা আর প্রাণ যায় এভারেস্ট জয়ের আশায়। এর মধ্যে ১৯৫২ সালে সুইস দলের তেনজিং নোরগে প্রথমবার চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছান, কিন্তু তখন সফল হননি। অবশেষে পরের বছর এলো সাফল্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গর্ব হিসেবে এবং রানির রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে এভারেস্ট জয়ের একটা প্রতীকী মূল্যও ছিল। ১৯৫৩ সালে জন হান্টের নেতৃত্বে একটি বিস্তৃত ব্রিটিশ অভিযান যাত্রা করে। দলটি ছিল আন্তর্জাতিক: সদস্য ছিলেন নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন, নেপাল, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের।

এ দলের মূল দুই অভিযাত্রী ছিলেন: স্যার এডমন্ড হিলারি।  নিউজিল্যান্ডের এক মৌমাছি পালনকারী, যিনি পর্বতারোহণে অসম্ভব দক্ষ। আরেকজন তেনজিং নোরগে। নেপালি শেরপা, যিনি ইতিমধ্যে বহু অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, এবং শেরপাদের মধ্যে এক কিংবদন্তি হয়ে উঠছিলেন।

হিলারি ও তেনজিং অভিযানের চূড়ান্ত দুই সদস্য হিসেবে চূড়ায় উঠবার দায়িত্ব পান। ২৮ মে তারা উচ্চ শিবিরে রাত্রিযাপন করেন। ২৯ মে ভোরে তারা যাত্রা শুরু করেন। চূড়ার কিছু আগে তারা পৌঁছান এক ভয়ানক স্থানে—হিলারি স্টেপ নামের এক খাড়া বরফের ঢালে। এই অংশটি এতটাই বিপজ্জনক যে একে The last great obstacle বলা হয়। বহু দক্ষ পর্বতারোহী এই জায়গায় এসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

কিন্তু হিলারি সেই ঢাল জয় করেন। তেনজিং তাকে অনুসরণ করেন। সকাল ১১:৩০ মিনিটে তারা বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছান। অবশেষে ২৯ মে, ১৯৫৩ সালের সকালে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পা পড়লো মানুষের। এ যেন চাঁদে অভিযানের আগে মানুষের আরেক পদছাপের বৃহৎ নির্দেশনা।

এতো আয়োজনের পর চূড়ায় তারা ছিলেন প্রায় ১৫ মিনিট। হিলারি তেনজিংয়ের ছবি তোলেন। তেনজিং, বৌদ্ধ বিশ্বাসমতে, একটি চকোলেট, বিস্কুট ও কিছু ধূপ অর্পণ করেন পর্বতের দেবতাকে।

তারা সেখানে নেপাল, ব্রিটেন, ভারত ও জাতিসংঘের পতাকাও স্থাপন করেন। হিলারি পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডের একটি সংবাদপত্রকে ছোট করে বলেন: Well, George, we knocked the bastard off. মহাপরাক্রমশালী এভারেস্টকে যেন দুই যোদ্ধা সব শেষে নক ডাউনই করলেন! 

ব্যাপারটা তখনকার দিনে এতো অবিশ্বাস্য আর কঠিন ছিলো যে, তারা যখন ফিরে আসেন, তখনও বাকিরা বিশ্বাসই করতে পারছিল না—এই দুজন সত্যিই চূড়ায় পৌঁছেছেন! খবরটি ব্রিটেনে পৌঁছায় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের দিনেই। একে গণ্য করা হয় সেই যুগের শ্রেষ্ঠতম বিজয় হিসেবে। হিলারি নাইহুড উপাধি পান। তাই তাকে বলা হয় স্যার এডমুন্ড হিলারি। তেনজিং অবশ্য ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনস্থ নেপালি হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে নাইট হতে পারেননি, তবে তিনি ভারতের অন্যতম উচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননার অধিকারী হন।

এক অর্থে এভারেস্ট জয় ছিল এক প্রতীকী মানববিজয়। মানুষ যে নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে, তা প্রমাণিত হয় এই অভিযানে। এভারেস্ট অভিযানের পর তেনজিং নোরগে ও হিলারির জীবনও বদলে যায়। তারা কেবল পর্বতারোহী ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন সাংস্কৃতিক নায়ক। হিলারি পরে হিমালয়ে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেন, স্কুল ও হাসপাতাল গড়েন। তেনজিং নেপালে শেরপা সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করেন, নিজের স্মৃতিকথা লেখেন।

তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হিলারি ও তেনজিং কেউই একে অপরকে ‘অগ্রগামী’ হিসেবে দাবি করেননি। তারা দুজনই তাই ঐতিহাসিকভাবে প্রথম এভারেস্টজয়ী।

প্রথম এভারেস্ট বিজয় কেবল শারীরিক পর্বতারোহণ নয়, ছিল এক মানসিক অভিযাত্রা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের ইচ্ছাশক্তির জয়। এই অভিযানের ফলে এভারেস্ট হয়ে ওঠে কেবল একটি পর্বত নয়, এক প্রতীক—স্বপ্ন দেখার, সাহস করার, এবং নিজেদের সীমা অতিক্রম করার।

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ ল এক র একট

এছাড়াও পড়ুন:

‘সাগরমাথা’ জয় যেন এক রূপকথা

পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট, নেপালি নাম ‌‌‘সাগরমাথা’, তিব্বতি ভাষায় চোমোলুংমা, অর্থাৎ ‘পৃথিবীর দেবী মা’। উচ্চতা প্রায় ৮,৮৪৮ মিটার (বর্তমানে কিছু গবেষণায় ৮,৮৪৯.৮৬ মিটার)। বহু শতাব্দী ধরে এই পর্বতশৃঙ্গকে মানুষ শ্রদ্ধা ও ভয়—দুয়ের মিশ্রণে দেখেছে।

১৮৫৬ সালে ব্রিটিশরা একে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর থেকেই শুরু হয় মানুষের একটি অনন্ত আকাঙ্ক্ষা—‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রাখতেই হবে।’

কিন্তু এভারেস্ট ছিল এক ‘দুর্জেয় দুর্গ’। প্রকৃতির চরম প্রতিকূলতা, অনিশ্চিত আবহাওয়া, ভয়ঙ্কর ঠান্ডা, আর শ্বাসরুদ্ধকর উচ্চতা—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক মৃত্যুকূপের মতো।

এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখতে যাওয়া মানেই মৃত্যুর পায়তারা। শুরুতে যারা গিয়েছিলেন, তারা কেউ ফিরেও আসেননি। প্রথম অভিযান হয় ১৯২১ সালে। তারপর ১৯২৪ সালে জর্জ ম্যালোরি এবং অ্যান্ড্রু আরভাইন ব্রিটিশ অভিযানে অংশ নিয়ে চূড়ার খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তবে তারা ফিরে আসেননি। ম্যালোরির একটি বিখ্যাত উক্তি ইতিহাসে অমর হয়ে আছে “Because it’s there.”

এভারেস্ট যেন তখন থেকেই এক অনতিক্রম্য পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় ৩০ বছর ধরে অনেক দেশ, বহু অভিযান—সবই ব্যর্থ হয়। অনেক টাকা আর প্রাণ যায় এভারেস্ট জয়ের আশায়। এর মধ্যে ১৯৫২ সালে সুইস দলের তেনজিং নোরগে প্রথমবার চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছান, কিন্তু তখন সফল হননি। অবশেষে পরের বছর এলো সাফল্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গর্ব হিসেবে এবং রানির রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে এভারেস্ট জয়ের একটা প্রতীকী মূল্যও ছিল। ১৯৫৩ সালে জন হান্টের নেতৃত্বে একটি বিস্তৃত ব্রিটিশ অভিযান যাত্রা করে। দলটি ছিল আন্তর্জাতিক: সদস্য ছিলেন নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন, নেপাল, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের।

এ দলের মূল দুই অভিযাত্রী ছিলেন: স্যার এডমন্ড হিলারি।  নিউজিল্যান্ডের এক মৌমাছি পালনকারী, যিনি পর্বতারোহণে অসম্ভব দক্ষ। আরেকজন তেনজিং নোরগে। নেপালি শেরপা, যিনি ইতিমধ্যে বহু অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, এবং শেরপাদের মধ্যে এক কিংবদন্তি হয়ে উঠছিলেন।

হিলারি ও তেনজিং অভিযানের চূড়ান্ত দুই সদস্য হিসেবে চূড়ায় উঠবার দায়িত্ব পান। ২৮ মে তারা উচ্চ শিবিরে রাত্রিযাপন করেন। ২৯ মে ভোরে তারা যাত্রা শুরু করেন। চূড়ার কিছু আগে তারা পৌঁছান এক ভয়ানক স্থানে—হিলারি স্টেপ নামের এক খাড়া বরফের ঢালে। এই অংশটি এতটাই বিপজ্জনক যে একে The last great obstacle বলা হয়। বহু দক্ষ পর্বতারোহী এই জায়গায় এসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

কিন্তু হিলারি সেই ঢাল জয় করেন। তেনজিং তাকে অনুসরণ করেন। সকাল ১১:৩০ মিনিটে তারা বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছান। অবশেষে ২৯ মে, ১৯৫৩ সালের সকালে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পা পড়লো মানুষের। এ যেন চাঁদে অভিযানের আগে মানুষের আরেক পদছাপের বৃহৎ নির্দেশনা।

এতো আয়োজনের পর চূড়ায় তারা ছিলেন প্রায় ১৫ মিনিট। হিলারি তেনজিংয়ের ছবি তোলেন। তেনজিং, বৌদ্ধ বিশ্বাসমতে, একটি চকোলেট, বিস্কুট ও কিছু ধূপ অর্পণ করেন পর্বতের দেবতাকে।

তারা সেখানে নেপাল, ব্রিটেন, ভারত ও জাতিসংঘের পতাকাও স্থাপন করেন। হিলারি পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডের একটি সংবাদপত্রকে ছোট করে বলেন: Well, George, we knocked the bastard off. মহাপরাক্রমশালী এভারেস্টকে যেন দুই যোদ্ধা সব শেষে নক ডাউনই করলেন! 

ব্যাপারটা তখনকার দিনে এতো অবিশ্বাস্য আর কঠিন ছিলো যে, তারা যখন ফিরে আসেন, তখনও বাকিরা বিশ্বাসই করতে পারছিল না—এই দুজন সত্যিই চূড়ায় পৌঁছেছেন! খবরটি ব্রিটেনে পৌঁছায় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের দিনেই। একে গণ্য করা হয় সেই যুগের শ্রেষ্ঠতম বিজয় হিসেবে। হিলারি নাইহুড উপাধি পান। তাই তাকে বলা হয় স্যার এডমুন্ড হিলারি। তেনজিং অবশ্য ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনস্থ নেপালি হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে নাইট হতে পারেননি, তবে তিনি ভারতের অন্যতম উচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননার অধিকারী হন।

এক অর্থে এভারেস্ট জয় ছিল এক প্রতীকী মানববিজয়। মানুষ যে নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে, তা প্রমাণিত হয় এই অভিযানে। এভারেস্ট অভিযানের পর তেনজিং নোরগে ও হিলারির জীবনও বদলে যায়। তারা কেবল পর্বতারোহী ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন সাংস্কৃতিক নায়ক। হিলারি পরে হিমালয়ে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেন, স্কুল ও হাসপাতাল গড়েন। তেনজিং নেপালে শেরপা সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করেন, নিজের স্মৃতিকথা লেখেন।

তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হিলারি ও তেনজিং কেউই একে অপরকে ‘অগ্রগামী’ হিসেবে দাবি করেননি। তারা দুজনই তাই ঐতিহাসিকভাবে প্রথম এভারেস্টজয়ী।

প্রথম এভারেস্ট বিজয় কেবল শারীরিক পর্বতারোহণ নয়, ছিল এক মানসিক অভিযাত্রা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের ইচ্ছাশক্তির জয়। এই অভিযানের ফলে এভারেস্ট হয়ে ওঠে কেবল একটি পর্বত নয়, এক প্রতীক—স্বপ্ন দেখার, সাহস করার, এবং নিজেদের সীমা অতিক্রম করার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ