পুরোনো প্রযুক্তির গ্যাস মিটার গছিয়ে দিচ্ছে জাপান
Published: 28th, May 2025 GMT
জাপান থেকে পুরোনো প্রযুক্তির প্রিপেইড গ্যাস মিটার কিনছে বাংলাদেশ। সরকার টু সরকার (জিটুজি) পদ্ধতিতে এসব মিটার কেনার জন্য জাপান থেকে ঋণ নিতে হবে কঠিন শর্তে। ঋণ দেবে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন (জেবিআইসি)। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে ঋণ যেন সংকটে না পড়ে, সে নিশ্চয়তাও চাইছে দেশটি। এই ঋণের আওতায় আট লাখ গ্যাস মিটার কিনতে বাংলাদেশের খরচ হবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। প্রতি মিটারের পেছনে ব্যয় হবে প্রায় ১২ হাজার টাকা। প্রধান উপদেষ্টা ড.
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের প্রিপেইড মিটার স্থাপন নীতিমালা অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে স্মার্ট গ্যাস মিটার বসানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু জাপানে তৈরি পুরোনো প্রযুক্তির (নন-স্মার্ট) গ্যাস মিটার নেওয়া হলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ জন্য প্রচলিত নীতিমালাও পরিবর্তন করতে হবে। এতে গ্রাহকের ভোগান্তি বাড়তে পারে।
২০১৯ সালে আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ করে সরকার। তাই এ খাতে বিদ্যমান ও প্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাড়া বোঝা হওয়ার মতো প্রকল্প নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের অনীহা রয়েছে। তারপরও জাপানের মিটার কিনতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এর নেপথ্যে নানা ধরনের চাপ রয়েছে বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
জাপানের মিটারে অনীহা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, তিতাসসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এ মিটার নিতে চাইছে না। জাপান জোর করে পুরোনো প্রযুক্তির এসব মিটার চাপিয়ে দিচ্ছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জেবিআইসি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি নন-বাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ২০২৩ সালের নভেম্বরে দু’পক্ষের মধ্যে সই হয় আরেকটি এমওইউ। এরপর পেট্রোবাংলা, তিতাস, কর্ণফুলী ও বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সঙ্গে মিটার স্থাপনে ঋণ দিতে একাধিক বৈঠক করে জেবিআইসি।
জেবিআইসির ঋণে জাপান থেকে গ্রাহক পর্যায়ে প্রিপেইড গ্যাস মিটার কেনা নিয়ে গত ১৯ জানুয়ারি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করেন। ওই বৈঠক থেকে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জন্য দুই লাখ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য দেড় লাখ ও বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জন্য সাড়ে চার লাখ মিটার কেনার সিদ্ধান্ত হয়। জেবিআইসির শর্ত অনুসারে, এসব মিটার জাপানের অনদা ইনকরপোরেশনের কাছ থেকে কেনার কথা রয়েছে। মিটারগুলো দেশটির টয়োকেইকি কোম্পানির তৈরি।
গত ২২ জানুয়ারি জেবিআইসি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে ফেব্রুয়ারির শুরুতে একটি সমঝোতা কমিটি গঠনের অনুরোধ করে। চিঠিতে এ প্রকল্প জাপান সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয়। ফলে ফেব্রুয়ারির বৈঠকে জাপানের অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকবে বলে জানায় জেবিআইসি। ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি সমঝোতা বৈঠকে ঋণের শর্ত নিয়ে আলোচনা হয়।
এদিকে, ১২ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (পরিকল্পনা) সভাপতিত্বে আরেকটি বৈঠক হয়। সেখানে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, জাপান থেকে যে মিটার কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (এনএফসি) মিটার। বর্তমানে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে যে মিটার নেওয়া হচ্ছে, তা স্মার্ট মিটার। জাপানের মিটার থেকে তাৎক্ষণিক তথ্য (রিয়েল টাইম ডেটা) পাওয়া সম্ভব নয়। আর এ মিটার নিলে গ্রাহকের ভোগান্তি বাড়বে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা-১ অধিশাখার যুগ্ম সচিব আকানুর রহমান বৈঠকে বলেন, জেবিআইসি নন-স্মার্ট মিটারের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা নেওয়া ঠিক হবে না। অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমীন বলেন, যদি তিতাসের স্মার্ট মিটারের চাহিদা থাকে, তাহলে জেবিআইসির ঋণ নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী বলেন, আবাসিক পর্যায়ে খোলাবাজার থেকে স্মার্ট প্রিপেইড মিটার ক্রয় ও স্থাপন নীতিমালা-২০১৯ এবং পরে ২০২৪ সালে সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ওই বৈঠক থেকে জাপানের প্রস্তাবিত মিটার লাগালে গ্রাহক পর্যায়ে কী সমস্যা হতে পারে, তা চিহ্নিত করে পেট্রোবাংলাকে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পাশাপাশি ঋণের শর্তগুলো পর্যালোচনা এবং মিটারবিষয়ক নীতিমালা পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কিনা, তারও মতামত জানাতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সংস্থাটির এক পরিচালক সমকালকে জানান, তিতাসসহ অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর মতামত নিয়ে প্রতিবেদন এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জাপানের মিটার এখন বসানোর প্রয়োজন নেই বলে বিতরণ কোম্পানিগুলো মত দিয়েছে। এতে কারিগরি জটিলতা বাড়তে পারে। পাশাপাশি ঋণের কয়েকটি শর্ত বেশ কঠিন বলে জানানো হয়।
এ নিয়ে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে স্মার্ট মিটার নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে, যাতে গ্রাহকের ভোগান্তি কমে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহক যেন গ্যাস মিটার রিচার্জ করতে পারে। এখন জাপান যে মিটার দিচ্ছে, তাতে এসব সুবিধা থাকবে না। সেই সঙ্গে স্মার্ট মিটার কেনার নীতিমালাও বদলাতে হবে।
ঋণের কঠিন শর্ত
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বব্যাংক কিংবা এডিবির চেয়েও কঠিন শর্ত জেবিআইসির ঋণে। একে তো বায়ার্স ক্রেডিট, সেই সঙ্গে ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম। ঋণে প্রতিশ্রুতি চার্জ দশমিক ৫০ শতাংশ, অগ্রিম ফি ১ দশমিক ৫ শতাংশ, এজেন্ট ফি ২০ হাজার জাপানি ইয়েনসহ সব খরচ এ ঋণ থেকে বাংলাদেশকেই দিতে হবে। ঋণ পরিশোধে বিশ্বব্যাংক বা এডিবির ২০ থেকে ৩৫ বছর পাওয়া গেলেও জেবিআইসি ঋণ পরিশোধের সময় মাত্র ১০ বছর। ঋণ নেওয়ার ছয় মাস পরই প্রথম কিস্তি দিতে হবে। সুদ ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৩৯ থেকে ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত। এ ঋণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিশ্চয়তা আনতে হবে, যাতে এ ঋণ নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি না থাকে। সরকারকে ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তার পাশাপাশি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও কিস্তি যাতে সংকটে না পড়ে, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে।
আগেও কেনা হয়েছিল জাপানি মিটার
জাইকার সহযোগিতায় এরই মধ্যে জাপানের টয়োকেইকির তৈরি ৩ লাখ ২০ হাজার মিটার ঢাকা-চট্টগ্রামে তিতাস ও কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির গ্রাহকের ঘরে লাগানো হয়েছে। টয়োকেইকি সাইটের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ২ লাখ ও চট্টগ্রামে ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়। মিটারগুলো এসটিকে২৫এমআই মডেলের। তাইওয়ানেও গ্রাহক পর্যায়ে এসব গ্যাস মিটার লাগানোর নজির রয়েছে। সেগুলো এনএস সিরিজের।
এদিকে অনদা ইনকরপোরেশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, এই ২ লাখ ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটার লাগানোর পর আরও ১ লাখ ২০ হাজার মিটার বসানোর কাজ পায় তারা। প্রতি মিটার স্থাপনে গড়ে খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। জাপানের মিটার স্থাপনের মধ্যেই এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় স্মার্ট মিটার কেনার উদ্যোগ শুরু হয়। এরই মধ্যে সিলেটে চীনের তৈরি ৬০ হাজার স্মার্ট প্রযুক্তির মিটার বসেছে।
কারা কী বলছেন
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অনদা ইনকরপোরেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হোসেন আহমেদ মালেক সমকালকে বলেন, ‘আমরা এনএফএস প্রযুক্তির (স্মার্ট নয়) মিটার দিতে চেয়েছি। জাইকার সহযোগিতায় তিতাসে আগেও এই প্রযুক্তির মিটার বসানো হয়েছে। এখন একটি গ্রুপ চীনা মিটার কেনার জন্য জাপানি প্রযুক্তির মিটারের বিরোধিতা করছে। চীনা মিটার স্মার্ট হলেও ২জি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি কম, তাই এনএফএস প্রযুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন গ্যাস কোম্পানিগুলো স্মার্ট মিটার চাইলে আমরা আগামীতে ৪জি প্রযুক্তি লাগিয়ে দেব।’
তিনি বলেন, চীনা মিটারের মান জাপানের চেয়ে কম হলেও দাম বেশি।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ সমকালকে বলেন, জাপান থেকে একটি প্রস্তাব এসেছে। এ বিষয়ে আমাদের মতামত জ্বালানি বিভাগকে জানানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত মাসে সমকালকে জানিয়েছিলেন, উচ্চ সুদ, প্রযুক্তিগত ঘাটতির বিষয়টি জেবিআইসিকে জানানো হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ড স ট র ব উশন জ ব আইস র কর মকর ত ন র জন য প রস ত ব ক পর য য় ব শ বব য গ র হক র সরক র র ন শ চয়ত দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।
সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।
ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’