মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়া আপিল বিভাগ যেই রায় ঘোষণা করিয়াছেন, তাহা বিবাদীপক্ষের জন্য উল্লাসের উপলক্ষ সৃষ্টি করিলেও বাদীপক্ষে স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষোভের আবহ সৃষ্টি করিয়াছে।

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ উক্ত রায় দিয়াছেন, যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত আজহারুলের মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করা হয়। এই রায়ের ফলে তিনি ইতোমধ্যে কারাগার হইতে মুক্তি পাইয়াছেন। শুধু উহা নহে; মুক্তি পাইয়াই আজহারুল ইসলাম রাজধানীর শাহবাগে গিয়াছেন। সেইখানে পূর্বেই প্রস্তুতকৃত মঞ্চে তিনি স্বীয় দলের পক্ষ হইতে প্রদান করা সংবর্ধনাও গ্রহণ করিয়াছেন।

উপরন্তু সেই সংবর্ধনায় প্রদত্ত ভাষণে এই মুক্তির জন্য জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীকে ধন্যবাদ জানাইয়াছেন। ঘটনাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে, এই শাহবাগেই ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে লক্ষ জনতার দাবির মুখে সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন করিয়া আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, যাহা আজহারুলের মুক্তিতে অবদান রাখিল।

আজহারুলকে মুক্ত করিতে পারিয়া জামায়াত নেতাকর্মীর উল্লাসের কারণ আমরা বুঝি। কিন্তু একই কারণে যেই অপরাধে আজহারুল ট্রাইব্যুনালে দণ্ড পাইয়াছিলেন, সেই অপরাধের ভুক্তভোগী এবং তাহাদের স্বজনের বিষাদের কারণ কি আমরা উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি? আজহারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুর অঞ্চলে ১২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শত শত বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ন্যায় অপরাধ সংঘটনে তাঁহার ভূমিকা ছিল। মঙ্গলবারের রায়ে তাঁহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সেই অভিযোগগুলি খারিজ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু অপরাধগুলি যে সেই সময়ে সংঘটিত হইয়াছিল– উহা তো সত্য। তাহা হইলে সেই ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার কী করিয়া নিশ্চিত করা যাইবে?

দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামি আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পাইলেন। অধিকন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজা হইবার পর এই প্রথম কোনো মামলায় আপিল বিভাগের রায় রিভিউ শুনানির পর আসামিকে মূল মামলায় আপিল করার অনুমতি প্রদান করা হইল। এই সকল বিষয়ে জনমনে কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। রায় ঘোষণাকালে বিচারপতিগণ যেই সকল পর্যবেক্ষণ দিয়াছেন, সেইগুলির সারবত্তা নিশ্চয় আছে।

তবে ইহাও সত্য, এই প্রথম কোনো মামলায় যাহারা নিম্ন আদালতে আসামিপক্ষে সওয়াল করিয়াছেন, তাহাদেরই একটা অংশ উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে দাঁড়াইয়াছেন। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, আপিল বিভাগে উক্ত মামলার শুনানিকালে বিবাদীপক্ষের আইনজীবী যে যুক্তি উপস্থাপন করিয়া আজহারুলের খালাস প্রার্থনা করিয়াছেন, রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আইনজীবী তাহার বিরোধিতা করেন নাই। কোনো মামলায় বাদী-বিবাদীপক্ষ যখন এক হইয়া যায় তখন আদালতের ভিন্ন কোনো অবস্থান গ্রহণ সম্ভবপর হয় না। আজহারুলের মামলায় এই ঘটনাই ঘটিয়াছে। প্রসঙ্গত, প্রতিবেদনমতে, আজহারুলের দল জামায়াত ও উহার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছে। অন্যদিকে সরকারপক্ষও রায়টিকে ‘ন্যায়বিচারের বিজয়’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছে। 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রায় সকল মানুষ যে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয় কামনা করিয়াছিল– ইহা অবিসংবাদিত সত্য। আবার সেই যুদ্ধে এই দেশেরই কিছু মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের দোসররূপে কাজ করিয়াছিল এবং তাহাদের অনেকে জামায়াতে ইসলামী ও তাহার ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন– তাহাও সত্য। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাহাদের এদেশীয় সহযোগীরা যে নারকীয় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করিয়াছিল, সেই সকল অপরাধের ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়– তাহাও সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ভাবিতে হইবে বলিয়া আমরা মনে করি।

স্মরণে রাখিতে হইবে, ভুক্তভোগীগণ অনেকে ৫৩ বৎসর যাবৎ ন্যায়বিচার পাইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এই রাষ্ট্র তাহাদের কথা ভুলিয়া যাইতে পারে না।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আপ ল ব ভ গ আজহ র ল র কর য় ছ ন অপর ধ র র জন য ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ গাওয়ার পর পালিয়ে থাকতে হয়েছিল

শিল্পীর সৌজন্যে

সম্পর্কিত নিবন্ধ