২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট কয়েকটি কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বাজেট হবে ক্ষমতাচ্যুত বিগত সরকারের পতনের পর প্রথম জাতীয় বাজেট। দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে চলমান সংকট মোকাবিলা করার পদক্ষেপ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার এবারের বাজেট কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। সুতরাং উত্তরণ-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি জোরদার করার দায়িত্বও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।

রাজস্ব নীতি সরকারের আর্থিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র, যা অর্থনীতিতে ভারসাম্য বহাল করতে ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও অপর্যাপ্ত রাজস্বের সংকটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের বাণিজ্যিক সুবিধা শেষ হওয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় উদ্ভূত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সংকোচনমূলক বাজেট পেশ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এর প্রধান লক্ষ্য ব্যয় সংকোচন করে বাজেট-ঘাটতি কমিয়ে আনা ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন করা।

সরকারের রাজস্ব আহরণ হার খুব কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সরকারি খাত বিশ্বের সর্বনিম্ন রাজস্ব আদায়ের সরকারি খাতগুলোর মধ্যে একটি। এর পরিমাণ জিডিপির ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। রাজস্ব সংগ্রহ দক্ষতা নির্ণয়ের প্রধান সূচক কর-জিডিপি অনুপাত। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে সর্বনিম্ন। অথচ নেপালের কর-জিডিপি অনুপাত ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ভারতের ২০ শতাংশ।

সরকারি খাতের ছোট আকার সত্ত্বেও বাংলাদেশ বাজেট-ঘাটতি জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি বজায় রেখে এসেছে প্রধানত বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হয়, যা ২০২১ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বরাদ্দ হয় শুধু সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য!

উপলব্ধ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় বাজেটে ৯৮০ বিলিয়ন টাকার বেশি ঋণ সরবরাহ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই বিশাল অঙ্কের ঋণ গ্রহণের কারণে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে উঠে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এ বছর মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বাজেটে ৩৬ হাজার ১৭৬ দশমিক ৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণ দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ বুলেটিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারের ব্যয় জাতীয় বাজেটের ছয় ভাগের এক ভাগ।

২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ৩৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৯ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ ১৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হয়। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ৪০ দশমিক ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।

অবশ্য জিডিপির অনুপাত অনুসারে বাংলাদেশে সরকারি ঋণের পরিমাণ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশ যা আইএমএফ নির্ধারিত ৫৫ শতাংশ সীমার যথেষ্ট নিচে। তবে উল্লেখ্য, সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা জিডিপির ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে রাজস্ব সংগ্রহের ওপর।

সরকারি ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারের ঋণ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দের কারণে সরকারি খাতের আর্থিক নমনীয়তা হ্রাস পায়। দ্রুত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ হিসেবে কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে টি-বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক নমনীয়তার অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।

অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ জোরদার করে আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানোর লক্ষ্য সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত এপ্রিলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল (এমএলটিআরএস)’ প্রকাশ করেছে। ওই রাজস্ব কৌশল অনুযায়ী, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্য তুলে ধরা হয়ে হয়েছে। ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত মধ্য মেয়াদ এবং ২০৩০-৩১ থেকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদ ধরা হয়েছে।

মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করেছে। রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন নির্ণয় ও কর-হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক শুল্ক চুক্তি তদারকের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কর ব্যবস্থাপনা বিভাগ রাজস্ব সংগ্রহের মূল দায়িত্ব পালন করবে।

বাংলাদেশের মোট রাজস্বের দুই–তৃতীয়াংশ সংগ্রহ করা হয় পরোক্ষ কর থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে। পরোক্ষ কর সংগ্রহ করা সহজ ও তা সরকারের রাজস্ব বাড়াতে যথেষ্ট সহায়ক। তবে পরোক্ষ কর আরোপ করা হয় পণ্য ও সেবার ওপর, যা নিম্ন আয়ের মানুষসহ দেশের সব মানুষ গ্রহণ করে থাকেন। ফলে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক চাপ পড়ে। পরোক্ষ করের ওপর অধিক নির্ভরতা সমাজে আয়ের বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা রাখে।

পক্ষান্তরে প্রত্যক্ষ কর, যেমন আয়কর, করপোরেট কর, সম্পত্তি, সম্পদ ও উত্তরাধিকার কর ইত্যাদি করের বোঝার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করে। এশিয়ার যেসব দেশ সফলভাবে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়াতে পেরেছে, দেখা গেছে তারা ক্রমান্বয়ে পরোক্ষ কর থেকে সরে প্রত্যক্ষ করের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছে। যেমন ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, কোরিয়া।

বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের যাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থনীতির ভারসাম্য বহাল রেখে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনা, কর সংগ্রহে পরিধি বাড়ানো, ভ্যাট কাঠামোর আধুনিকায়ন, শুল্ক কাঠামো সংস্কার, অব্যাহতি হ্রাস ও করব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাপক পরিসরে উদ্যোগ নিতে হবে। কর নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর তার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

টি আই এম নূরুল কবীর ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি–বিশ্লেষক। নির্বাহী পরিচালক, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। ই-মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০২৫ ২৬ ঋণ জ ড প র লক ষ য কর জ ড প পদক ষ প সরক র র ব যবস থ অন য য় পর শ ধ অন প ত র জন য আর থ ক দশম ক র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সোনালী ও রূপালী মুনাফায়, অগ্রণী ও জনতা লোকসানে

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গত বছরের শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে দুটিই বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় দেশের শীর্ষ লোকসানি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি গত বছর শেষে একাই লোকসান করেছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংক লোকসান করেছে ৯৮২ কোটি টাকা।

তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে সোনালী ব্যাংক, গত বছর শেষে ব্যাংকটি মুনাফা করেছে ৯৮৮ কোটি টাকা; আর রূপালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ১১ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ও জনতা মিলে গত বছর শেষে লোকসান করেছে ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। আর সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক মিলে মুনাফা করেছে ৯৯৯ কোটি টাকা। তবে চার ব্যাংকই মন্দঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিজেদের চাহিদামতো ছাড় পেয়েছে। এ কারণে কাগজে–কলমে জনতা ও অগ্রণী লোকসান কিছুটা কম দেখাতে পেরেছে; আর সোনালী ও রূপালীর মুনাফা বেড়েছে। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী, মন্দঋণের বিপরীতে যথাযথ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র আরও খারাপ হতো। ব্যাংক চারটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক মোট ছয়টি। উল্লেখিত চারটির বাইরে বাকি দুটি হচ্ছে–বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল।

নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন এসব ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়লে বিভিন্ন সময় সরকার জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকালে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি সরকারঘনিষ্ঠ আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে ব্যাংকগুলোতে বন্ধ হয়নি অনিয়ম–দুর্নীতি। এখন লোকসানে থাকা জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।

মুনাফায় শীর্ষে সোনালী ব্যাংক

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক কয়েক বছর ধরে তাদের মুনাফার ধারা অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৩৭১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৬৫১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংকের মুনাফা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৮ কোটি টাকায়। ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সোনালী ব্যাংক।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল হল–মার্ক গ্রুপ। এ ঘটনা ছিল সে সময় দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ অনিয়মের সবচেয়ে বড় ঘটনা। তাই দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল হল–মার্ক কেলেঙ্কারি। শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়েছিল। এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ব্যাংকটি পুনর্গঠন শুরু হয়। তাতে ধীরে ধীরে দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের প্রতি আবারও আস্থা ফিরতে শুরু করে আমানতকারীদের।

বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। ২০১২ সালে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঋণের ৩৩ শতাংশই সরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া।

হল-মার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংক তাদের ঋণের গতি কমিয়ে দেয়। কৌশলও পাল্টে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ না দিয়ে ব্যাংকটি সরকারি বিভিন্ন পণ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার বদলে অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে সুদ আয়ের পথ বেছে নেয়। আর তাতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়। বেড়েছে গ্রাহকও। এক যুগ আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিল এক কোটির ঘরে। এখন সেই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়েছে।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের সুদ ও ট্রেজারি খাত থেকে গত বছর আমাদের ভালো আয় হয়েছে। তবে আয়ের ক্ষেত্রে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ট্রেজারি খাতে। আবার অবলোপন করা ঋণ থেকেও ভালো আদায় হয়েছে, যা মুনাফায় যুক্ত হয়েছে। বেসরকারি ঋণের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এরপর মুনাফা এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।’

রূপালী ব্যাংকের মুনাফা কমেছে

রূপালী ব্যাংক ২০২২ সালে ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। ২০২৩ সালে সেই মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকায়। তবে ২০২৪ সালে তাদের মুনাফা কমে ১১ কোটি টাকায় নেমে আসে। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৬৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৪১ শতাংশের বেশি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলে যে পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কথা, তা সংরক্ষণ করতে হলে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ত। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যাংকটিকে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গত বছরের শেষে ব্যাংকটি ১১ কোটি টাকা মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায়।

এ নিয়ে রূপালী ব্যাংকের এমডি কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমে গেছে। এসব ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এখন কম সুদের আমানত এনে ভালো ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

রেকর্ড লোকসানে জনতা ব্যাংক

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জনতা ব্যাংকের। ২০২২ সালে ১১৩ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটি রেকর্ড ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এই লোকসান রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লোকসানের রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্যাংকটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় নিয়েছে। যদিও খেলাপিঋণের বিপরীতে ওই পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো, তাহলে লোকসানও কয়েক গুণ বেড়ে যেত। ব্যাংকটি এই চরম দুর্দশায় পড়েছে বিদায়ী সরকারের মেয়াদে লাগামহীন ঋণ দেওয়ার কারণে, যেসব ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে।

গত মেয়াদে ব্যবসায়ীদের কয়েকজন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাংকটি থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছেন। ফলে ১০টি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ৫৫ শতাংশ ঋণ আটকা পড়েছে। প্রভাবশালী এসব গ্রাহকের দেওয়া বেশির ভাগ ঋণ ফেরত আসছে না, এতে গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যাংকটির পরিস্থিতি এমন নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। কারণ, এসব ঋণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার গ্রাহকদের অনেকেই লাপাত্তা, কেউ জেলে আবার কারও কারখানা বন্ধ।

জনতা ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। রপ্তানি বাণিজ্যতেও শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। সেই ব্যাংক এখন নাজুক পরিস্থিতিতে। কারণ, গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকটিতে। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা আওয়ামীপন্থী পরিচালকেরা। যদিও এসব অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ঋণ ছিল ৯৮ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা গত বছর শেষে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০০ কোটি টাকা। তবে চলতি বছর ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে। তবে গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে আবার ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

জনতা ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকও লোকসানে

মুনাফার দিক থেকে অগ্রণী ব্যাংক একসময় ভালো অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালে ব্যাংকটি বড় ধরনের লোকসান করেছে। ২০২২ সালে ১১০ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৬৯ কোটি টাকা মুনাফা করা ব্যাংকটি ২০২৪ সালে ৯৮২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি এবং অদক্ষতাই এই লোকসানের অন্যতম কারণ। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৯৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, ঋণ ছিল ৭৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের মতো অগ্রণী ব্যাংকও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে এখন সংকটে পড়েছে।

ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে নিয়মের বাইরে যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে, এখন তা বেরিয়ে আসছে। নিরাপত্তা সঞ্চিত সংরক্ষণে ছাড় না নিলে ব্যাংকটির লোকসান আরও অনেক বেশি হতো। যদি প্রকৃত লোকসানের চিত্র সবাই জানত, তাহলেই ভালো হতো। এই ব্যাংকের ঋণের অনেক টাকা বাইরে চলে গেছে। এ জন্য ঘুরে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। ব্যাংকটির গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা এখন দেশে আছেন, ব্যবসা চালাচ্ছেন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তাঁদের আরও সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তাহলে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
  • সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ হাজার কোটি টাকা
  • রাশিয়ার প্রয়াত বিরোধী নেতা নাভালনির শরীরে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল: স্ত্রীর দাবি
  • রূপালী লাইফের আর্থিক হিসাবে ৬৯ কোটি টাকার গরমিল
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি ইউনিটে ভর্তি: মাইগ্রেশন, বিষয় ও প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ প্রকাশ
  • হেলথ টেকনোলজি কোর্সে ভর্তি, অপেক্ষমাণ থেকে তৃতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ
  • তাপমাত্রা বেড়ে দেশের ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা, কীভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে
  • শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দিল ঢাকা ইন্স্যুরেন্স
  • সোনালী ও রূপালী মুনাফায়, অগ্রণী ও জনতা লোকসানে
  • বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল কেন