টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে
Published: 29th, May 2025 GMT
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট কয়েকটি কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বাজেট হবে ক্ষমতাচ্যুত বিগত সরকারের পতনের পর প্রথম জাতীয় বাজেট। দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে চলমান সংকট মোকাবিলা করার পদক্ষেপ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার এবারের বাজেট কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। সুতরাং উত্তরণ-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি জোরদার করার দায়িত্বও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।
রাজস্ব নীতি সরকারের আর্থিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র, যা অর্থনীতিতে ভারসাম্য বহাল করতে ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও অপর্যাপ্ত রাজস্বের সংকটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের বাণিজ্যিক সুবিধা শেষ হওয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় উদ্ভূত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সংকোচনমূলক বাজেট পেশ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এর প্রধান লক্ষ্য ব্যয় সংকোচন করে বাজেট-ঘাটতি কমিয়ে আনা ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন করা।
সরকারের রাজস্ব আহরণ হার খুব কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সরকারি খাত বিশ্বের সর্বনিম্ন রাজস্ব আদায়ের সরকারি খাতগুলোর মধ্যে একটি। এর পরিমাণ জিডিপির ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। রাজস্ব সংগ্রহ দক্ষতা নির্ণয়ের প্রধান সূচক কর-জিডিপি অনুপাত। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে সর্বনিম্ন। অথচ নেপালের কর-জিডিপি অনুপাত ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ভারতের ২০ শতাংশ।
সরকারি খাতের ছোট আকার সত্ত্বেও বাংলাদেশ বাজেট-ঘাটতি জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি বজায় রেখে এসেছে প্রধানত বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হয়, যা ২০২১ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বরাদ্দ হয় শুধু সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য!
উপলব্ধ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় বাজেটে ৯৮০ বিলিয়ন টাকার বেশি ঋণ সরবরাহ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই বিশাল অঙ্কের ঋণ গ্রহণের কারণে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে উঠে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এ বছর মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বাজেটে ৩৬ হাজার ১৭৬ দশমিক ৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণ দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ বুলেটিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারের ব্যয় জাতীয় বাজেটের ছয় ভাগের এক ভাগ।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ৩৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৯ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ ১৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হয়। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ৪০ দশমিক ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
অবশ্য জিডিপির অনুপাত অনুসারে বাংলাদেশে সরকারি ঋণের পরিমাণ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশ যা আইএমএফ নির্ধারিত ৫৫ শতাংশ সীমার যথেষ্ট নিচে। তবে উল্লেখ্য, সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা জিডিপির ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে রাজস্ব সংগ্রহের ওপর।
সরকারি ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারের ঋণ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দের কারণে সরকারি খাতের আর্থিক নমনীয়তা হ্রাস পায়। দ্রুত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ হিসেবে কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে টি-বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক নমনীয়তার অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ জোরদার করে আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানোর লক্ষ্য সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত এপ্রিলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল (এমএলটিআরএস)’ প্রকাশ করেছে। ওই রাজস্ব কৌশল অনুযায়ী, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্য তুলে ধরা হয়ে হয়েছে। ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত মধ্য মেয়াদ এবং ২০৩০-৩১ থেকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদ ধরা হয়েছে।
মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করেছে। রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন নির্ণয় ও কর-হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক শুল্ক চুক্তি তদারকের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কর ব্যবস্থাপনা বিভাগ রাজস্ব সংগ্রহের মূল দায়িত্ব পালন করবে।
বাংলাদেশের মোট রাজস্বের দুই–তৃতীয়াংশ সংগ্রহ করা হয় পরোক্ষ কর থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে। পরোক্ষ কর সংগ্রহ করা সহজ ও তা সরকারের রাজস্ব বাড়াতে যথেষ্ট সহায়ক। তবে পরোক্ষ কর আরোপ করা হয় পণ্য ও সেবার ওপর, যা নিম্ন আয়ের মানুষসহ দেশের সব মানুষ গ্রহণ করে থাকেন। ফলে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক চাপ পড়ে। পরোক্ষ করের ওপর অধিক নির্ভরতা সমাজে আয়ের বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা রাখে।
পক্ষান্তরে প্রত্যক্ষ কর, যেমন আয়কর, করপোরেট কর, সম্পত্তি, সম্পদ ও উত্তরাধিকার কর ইত্যাদি করের বোঝার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করে। এশিয়ার যেসব দেশ সফলভাবে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়াতে পেরেছে, দেখা গেছে তারা ক্রমান্বয়ে পরোক্ষ কর থেকে সরে প্রত্যক্ষ করের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছে। যেমন ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, কোরিয়া।
বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের যাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থনীতির ভারসাম্য বহাল রেখে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনা, কর সংগ্রহে পরিধি বাড়ানো, ভ্যাট কাঠামোর আধুনিকায়ন, শুল্ক কাঠামো সংস্কার, অব্যাহতি হ্রাস ও করব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাপক পরিসরে উদ্যোগ নিতে হবে। কর নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর তার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
টি আই এম নূরুল কবীর ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি–বিশ্লেষক। নির্বাহী পরিচালক, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৫ ২৬ ঋণ জ ড প র লক ষ য কর জ ড প পদক ষ প সরক র র ব যবস থ অন য য় পর শ ধ অন প ত র জন য আর থ ক দশম ক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি বাস্তবায়নে কমিটি
সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (গভর্নেন্স পারফরমেন্স মনিটরিং সিস্টেম- জিপিএমএস)’ বাস্তবায়নে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে তিন সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করেছে সরকার।
সম্প্রতি এই কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
কমিটিতে বাকি দুই সদস্য হলেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকারি কাজের জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিতে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) পরিবর্তে নতুন সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (জিপিএমএস) চালু করা হয়েছে। এই জিপিএমএস বাস্তবায়নে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, অর্থ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার), বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব কমিটিকে সহায়তা করবেন। তাছাড়া, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে।
এ কমিটি জিপিএমএস বাস্তবায়নের বিষয়ে সার্বিক দিক-নির্দেশনা দেবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসে সেকশন ১-এর আওতায় প্রস্তুত করা পরিকল্পনা অনুমোদন দেবে এবং অর্থবছর শুরুর আগে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত করবে এ কমিটি।
এছাড়া, প্রতি অর্থবছর শেষে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসের সার্বিক মূল্যায়ন পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেবে। জিপিএমএস বিষয়ে সরকারের দেওয়া অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা