২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট কয়েকটি কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বাজেট হবে ক্ষমতাচ্যুত বিগত সরকারের পতনের পর প্রথম জাতীয় বাজেট। দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে চলমান সংকট মোকাবিলা করার পদক্ষেপ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার এবারের বাজেট কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশ আগামী ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। সুতরাং উত্তরণ-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি জোরদার করার দায়িত্বও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।

রাজস্ব নীতি সরকারের আর্থিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র, যা অর্থনীতিতে ভারসাম্য বহাল করতে ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও অপর্যাপ্ত রাজস্বের সংকটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের বাণিজ্যিক সুবিধা শেষ হওয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় উদ্ভূত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সংকোচনমূলক বাজেট পেশ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এর প্রধান লক্ষ্য ব্যয় সংকোচন করে বাজেট-ঘাটতি কমিয়ে আনা ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন করা।

সরকারের রাজস্ব আহরণ হার খুব কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সরকারি খাত বিশ্বের সর্বনিম্ন রাজস্ব আদায়ের সরকারি খাতগুলোর মধ্যে একটি। এর পরিমাণ জিডিপির ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। রাজস্ব সংগ্রহ দক্ষতা নির্ণয়ের প্রধান সূচক কর-জিডিপি অনুপাত। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে সর্বনিম্ন। অথচ নেপালের কর-জিডিপি অনুপাত ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ভারতের ২০ শতাংশ।

সরকারি খাতের ছোট আকার সত্ত্বেও বাংলাদেশ বাজেট-ঘাটতি জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি বজায় রেখে এসেছে প্রধানত বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হয়, যা ২০২১ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বরাদ্দ হয় শুধু সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য!

উপলব্ধ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় বাজেটে ৯৮০ বিলিয়ন টাকার বেশি ঋণ সরবরাহ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই বিশাল অঙ্কের ঋণ গ্রহণের কারণে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে উঠে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এ বছর মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বাজেটে ৩৬ হাজার ১৭৬ দশমিক ৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণ দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ বুলেটিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারের ব্যয় জাতীয় বাজেটের ছয় ভাগের এক ভাগ।

২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ৩৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৯ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ ১৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হয়। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ৪০ দশমিক ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।

অবশ্য জিডিপির অনুপাত অনুসারে বাংলাদেশে সরকারি ঋণের পরিমাণ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশ যা আইএমএফ নির্ধারিত ৫৫ শতাংশ সীমার যথেষ্ট নিচে। তবে উল্লেখ্য, সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা জিডিপির ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে রাজস্ব সংগ্রহের ওপর।

সরকারি ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারের ঋণ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দের কারণে সরকারি খাতের আর্থিক নমনীয়তা হ্রাস পায়। দ্রুত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ হিসেবে কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে টি-বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক নমনীয়তার অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।

অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ জোরদার করে আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানোর লক্ষ্য সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত এপ্রিলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ‘মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল (এমএলটিআরএস)’ প্রকাশ করেছে। ওই রাজস্ব কৌশল অনুযায়ী, ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্য তুলে ধরা হয়ে হয়েছে। ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত মধ্য মেয়াদ এবং ২০৩০-৩১ থেকে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদ ধরা হয়েছে।

মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করেছে। রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন নির্ণয় ও কর-হার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক শুল্ক চুক্তি তদারকের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কর ব্যবস্থাপনা বিভাগ রাজস্ব সংগ্রহের মূল দায়িত্ব পালন করবে।

বাংলাদেশের মোট রাজস্বের দুই–তৃতীয়াংশ সংগ্রহ করা হয় পরোক্ষ কর থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে। পরোক্ষ কর সংগ্রহ করা সহজ ও তা সরকারের রাজস্ব বাড়াতে যথেষ্ট সহায়ক। তবে পরোক্ষ কর আরোপ করা হয় পণ্য ও সেবার ওপর, যা নিম্ন আয়ের মানুষসহ দেশের সব মানুষ গ্রহণ করে থাকেন। ফলে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক চাপ পড়ে। পরোক্ষ করের ওপর অধিক নির্ভরতা সমাজে আয়ের বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা রাখে।

পক্ষান্তরে প্রত্যক্ষ কর, যেমন আয়কর, করপোরেট কর, সম্পত্তি, সম্পদ ও উত্তরাধিকার কর ইত্যাদি করের বোঝার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করে। এশিয়ার যেসব দেশ সফলভাবে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়াতে পেরেছে, দেখা গেছে তারা ক্রমান্বয়ে পরোক্ষ কর থেকে সরে প্রত্যক্ষ করের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছে। যেমন ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, কোরিয়া।

বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের যাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থনীতির ভারসাম্য বহাল রেখে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনা, কর সংগ্রহে পরিধি বাড়ানো, ভ্যাট কাঠামোর আধুনিকায়ন, শুল্ক কাঠামো সংস্কার, অব্যাহতি হ্রাস ও করব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাপক পরিসরে উদ্যোগ নিতে হবে। কর নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর তার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

টি আই এম নূরুল কবীর ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি–বিশ্লেষক। নির্বাহী পরিচালক, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। ই-মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০২৫ ২৬ ঋণ জ ড প র লক ষ য কর জ ড প পদক ষ প সরক র র ব যবস থ অন য য় পর শ ধ অন প ত র জন য আর থ ক দশম ক র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনের রোডম্যাপে কবে যাত্রা শুরু করবে বাংলাদেশ

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে মাস দেড়েক আগে বলা হয়েছিল, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এ দেশে গত ১৫ বছরে সতি্যকার অর্থে কোনো নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন না থাকার কারণেই স্বৈরাচারী শাসন চেপে বসতে পেরেছিল।

নাগরিক কোয়ালিশনও অনেক আগেই নির্বাচনের জন্য ‘ফেব্রুয়ারি রোডম্যাপ’ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার থেকে এখনো কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। এদিকে জোর গুজব উঠেছে, আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু তারিখ বললেই কি নির্বাচন হয়?

২.

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা কি আদৌ কিছু শুরু করতে পেরেছি, নাকি আবারও সেই পুরোনো অভ্যাস, অর্থাৎ সময়ক্ষেপণ, সন্দেহ আর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, গত ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমান ও সরকারপ্রধানের বৈঠক হলেও এরপর আর কোনো গঠনমূলক অগ্রগতি নেই।

অনেকেই ভাবছেন, নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে আছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন মানে হাতে তেমন সময় নেই। বাস্তবতা হলো, সরকার যদি সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বড় সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত করতে হবে। আর তা করতে হলে এখন থেকেই খুব জোরেশোরে কাজ শুরু করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানেই নিয়ন্ত্রিত প্রহসন। এ জন্য আমাদের হাতে যেসব কাজ রয়েছে: 

ক. ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের জন্য জুলাই চার্টার।

খ. নির্বাচন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য ন্যূনতম সংস্কারসহ নতুন আইন প্রণয়ন।

গ. ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ।

ঘ. নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ে প্রস্তুতি। এর মধ্যে আছে অমোচনীয় কালিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বিশাল ক্রয়াদেশ এবং লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা।

এই কাজগুলো সময়মতো না হলে তারিখ শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা থাকবে; নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হতে পারে; গণতন্ত্র ফিরবে না। এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে তা দেশকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।

৩.

এ স্থিতাবস্থার প্রথম কারণ ঐকমত্যের ঘাটতি। অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত—সব পক্ষই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে সন্দেহের চোখে। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে গত বছরের জুলাইয়ে আন্দোলন করলেও এখন তাদের সবার পথ আলাদা। সংস্কার নিয়ে সবার আলাদা মত।

নাগরিক কোয়ালিশনের মূল যেসব প্রস্তাব ছিল, তার মধ্যে উচ্চকক্ষে আনুপাতিক বণ্টন নিয়ে বিএনপিসহ দু–একটি দল ছাড়া আর সবার মধ্যে স্পষ্ট মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একেকজন একেক রকম মত দিচ্ছে।

অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে যদিও সবাই একমত হয়েছে, এরপরও নারী আসনে সরাসরি ভোট নিয়ে এখনো কোনো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেই। নিরপেক্ষ নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো আলোচনা এগোচ্ছে না।

নাগরিক কোয়ালিশনের ৭ দফা সংস্কার প্রস্তাব ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের জন্যই প্রয়োজনীয় ছিল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার তা বিবেচনা করার অনুরোধ রইল।

৪.

এদিকে কোনো রাজনৈতিক দলই নিজেদের দলীয় বা অভ্যন্তরীণ সংস্কারের কাজ শুরু করেনি। এত সব ডামাডোলে তা হারিয়েই যাচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনীতি করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে, নতুন রাজনীতির নিজ নিজ দলকে উপযোগী করে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে।

 এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বললেও প্রশাসন এখনো ‘ধীরে চলো’ নীতিতে আছে। নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি ও তালিকা হালনাগাদ খুব ধীরগতিতে চলছে।

এই অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেটে নির্বাচন কমিশন ২ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। এর মধ্যে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করতেই ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা খরচ হবে, যা ২০২৪ সালের নির্বাচনের খরচের প্রায় কাছাকাছি। বাজেট বরাদ্দ হলেও কাজে গতি নেই। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে আস্থা পাচ্ছে না।

২০২৪ সালের নির্বাচনে পুলিশ, র‍্যাব, আনসার, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাড়ে ছয় লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আমাদের পুলিশ কি প্রস্তুত? গোপালগঞ্জের অবস্থা দেখে এ প্রশ্নের উত্তর মনে হয় সবাই জেনে গেছেন।

পত্রিকায় এসেছে, গাড়ির অভাবে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের প্যাট্রোলিং ব্যাহত হচ্ছে। এই গাড়িগুলো কবে কেনা হবে? ২০২৪ সালে নির্বাচনের জন্য শুধু পুলিশের জন্যই বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এবার কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে, সেটা এখনো জানা যায়নি।

এবার নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি বুথে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি, রাতে পাহারা এবং বিস্ফোরণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি বুথে এই সিসিটিভি ক্যামেরার আয়োজন বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার।

এ ছাড়া নির্বাচনের জন্য অমোচনীয় কালি থেকে শুরু করে বিশালসংখ্যক স্টেশনারি পণ্য প্রয়োজন হয়, টেন্ডারের মাধ্যমে কিনতে বেশ কয়েক মাস সময় লাগে। কিন্তু এসবের জন্য এখনো কোনো টেন্ডারের প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। এগুলো ছোটখাটো ব্যাপার হলেও অত্যাবশ্যকীয় এবং সময়সাপেক্ষ।

৫.

এদিকে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। তাঁদের বিবেচনায় রাখলে দেশের বাইরে প্রায় দুই কোটি ভোটার আছেন। নির্বাচনে কোন পদ্ধতিতে তাঁদের করা যুক্ত হবে কিংবা এত কম সময়ে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশে থাকা আমাদের দূতাবাসগুলোর আরও গতিশীলতা দরকার।

 এদিকে সীমানা নির্ধারণ এখনো ঝুলে আছে। কোন এলাকা কোন আসনে পড়বে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। ব্যাপারটি ঠিক না হলে প্রার্থীরা প্রস্তুতি নেবেন কীভাবে? সীমানা ঠিক না করে নির্বাচনের ঘোড়া ছুটিয়ে লাভ নেই।

প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ায় নির্বাচন মানে প্রায় বছরব্যাপী প্রস্তুতির একটি প্রক্রিয়া। এদিকে ঘোষিত সময় থেকে মাত্র সাত মাস আগে বাংলাদেশে এখনো আইনকানুন আর সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা চলছে।

তবে ব্যয়ের দিক থেকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ করতে যাচ্ছি। ভারতের তুলনায় জনপ্রতি প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। কিন্তু এই খরচ জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারছে না।

৬.

আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু দেশের মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক মহলও। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ভারত, চীন—সবাই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চায়। কিন্তু স্থিতিশীলতা মানে শুধু একটি নিয়ম রক্ষার ভোট নয়। সংস্কার আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে এ নির্বাচনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন হবে। আমরা যদি নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান না করি, বাইরের চাপ আরও বাড়বে।

এদিকে মানুষের মধ্যে  হতাশা বাড়ছে। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তারা ভেবেছিল, এবার কিছু বদলাবে। কিন্তু এখন দেখছে আবারও সময়ক্ষেপণ আর দোষারোপের রাজনীতি। তাদের যদি আবারও হতাশ করা হয়, তাহলে অনাস্থা আরও গভীর হবে। এটা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও ভয়ংকর।

এদিকে অর্থনীতিও ঝুলে আছে; নেই বড় কোনো বিনিয়োগ। যে কোটামুক্ত সরকারি চাকরির জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কাজ চোখে পড়ছে না। ফলে বেকারত্ব বাড়ছেই।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো বরাদ্দ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে তবেই নতুন সরকার সংস্কারমুখী বাজেট নিতে পারবে। নতুন বিনিয়োগ আসা, আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) পরবর্তী কিস্তি পাওয়া—সবই এই সংস্কারের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নির্বাচন দেরিতে হলে অর্থনীতিও সংকটে পড়বে।

৭.

সামনে কী হতে পারে? যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হয় এবং এ রকম অরাজকতা চলতেই থাকে, তাহলে সরকার যেকোনো সময় নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে। এতে নতুন করে সংকট তৈরি হবে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয়—ক্ষমতার নতুন পুনর্বিন্যাস হবে; গণতন্ত্র ফিরবে না। বিশ্বাসের সংকট আরও প্রকট হবে। সে রকম কিছু হলে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়দায়িত্ব নিতে হবে।

বিগত স্বৈরাচারী সরকার এ দেশের মানুষের মনমানসিকতা অনেকখানি বদলে ফেলেছে, যার অনেক কিছুই আমরা শুনতে পাচ্ছি। আমাদের দরকার মানুষের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যা হতে হবে সুষ্ঠু ও অবাধ। আর তার জন্য শুধু সরকার নয়, সব দলকেই নিশ্চয়তা দিতে হবে।

এ রকম অবস্থায় বড় দলগুলোর জন্য একটি সর্বসম্মত ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা সনদ’ প্রণয়ন করতে পারে নির্বাচন কমিশন বা নাগরিক সমাজ। এর ভিত্তিতে দলগুলোই ‘কন্ডাক্ট সেল’ করে সরকারকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে।

৮.

এখনো কিছু সময় হাতে আছে। আমরা যদি টাইমলাইন নির্ধারণ করে এবং সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে কাজ শুরু করতে না পারি, তাহলে সরকার বদলাবে ঠিকই, কিন্তু পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত পাল্টাবে না।

সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়, সংবিধান সংস্কারের খসড়া তৈরি হয়, ভোটার তালিকা আর সীমানা নির্ধারণ শেষ হয় এবং সব দল যথাসাধ্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে, তাহলেই শুধু এই নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে।

বিগত স্বৈরাচারী রেজিম এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। তাই একটি নির্বাচনের জন্য আমাদের সবারই দায়দায়িত্ব নিতে হবে। আর যদি তা না পারি, ইতিহাস আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না।

সুবাইল বিন আলম সদস্য, নাগরিক কোয়ালিশন

[email protected]

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্বাচনের রোডম্যাপে কবে যাত্রা শুরু করবে বাংলাদেশ
  • সবজির দামে স্বস্তি, মজুরি বৃদ্ধির হার এখনো কম
  • ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ডের লভ্যাংশ ঘোষণা
  • গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
  • সার আমদানি ও জমি হস্তান্তরের প্রস্তাব অনুমোদন
  • পুঁজিবাজারে বড়-মাঝারি বিনিয়োগকারী বেড়েছে : বিএসইসি
  • সরকারি পলিটেকনিকে ভর্তি: ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে এসএসসি উত্তীর্ণদের সুযোগ
  • ধোনি কেন আইপিএল ছাড়তে পারছেন না: পেছনে হাজার কোটি টাকার খেলা
  • হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ঘোষণা
  • জুলাইয়ের ২৭ দিনে ৯ ব্যাংকে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি