জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন দুলাল হোসেন ওরফে সেলিম। মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লেগে গত বছরের ৩ আগস্ট তিনি মারা যান। আদালতে ভাই হত্যার এমন বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনাসহ ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে মামলা করেন সেলিমের বড় ভাই মোস্তফা কামাল। তবে পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, সেলিম এখনো জীবিত। এরপর সেলিম নিজের জীবিত থাকার প্রমাণ দিতে থানা-আদালতে ঘুরছেন। জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে ‘মৃত’ দেখিয়ে মামলার ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় এলাকায় নানা আলোচনা শুরু হয়েছে।

সেলিমের (৪৮) বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কুশমাইল ইউনিয়নের ধামর গ্রামে। তিনি গ্রামের মৃত আবদুল হাকিমের ছোট ছেলে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর নাম মো.

সেলিম থাকলেও মামলায় তাঁকে দুলাল হোসেন ওরফে সেলিম দেখানো হয়েছে। তাঁর বড় তিন ভাই হলেন হেলাল উদ্দিন, আবুল হোসেন ও মামলার বাদী মোস্তফা কামাল।

মোস্তফা কামাল এলাকায় মস্তু ডাকাত নামে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি ও মারামারির মামলা ছিল। এলাকায় এক হত্যাকাণ্ডের পর ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে তিনি এলাকাছাড়া।

২০২৪ সালের ৩০ আগস্ট আদালতের আদেশে যাত্রাবাড়ী থানায় সেলিম হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। তার আগে ২৭ আগস্ট সেলিমকে নিজের ভাই উল্লেখ করে রাজধানীর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন মোস্তফা কামাল। মামলার আরজিতে ৩ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার শনির আখড়ার কাজলা পেট্রলপাম্পের সামনে ছাত্র-জনতার মিছিলে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেলিম মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়। তাঁর লাশ উদ্ধার করে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার রামকৃষ্ণ মিশনের (আর কে মিশন রোড) পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়। মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ৪১ জনের নাম উল্লেখ ও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৫০ থেকে ২০০ নেতা-কর্মীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলার বাদী মোস্তফা কামালের (৫৫) ঠিকানা হিসেবে আর কে মিশন রোড, বদী মেম্বারের বাড়ি, মুগদা, ঢাকা উল্লেখ করা হয়।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফুলবাড়িয়া থানা-পুলিশ মৃত ব্যক্তির ঠিকানা অনুযায়ী তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, সেলিম এখনো জীবিত এবং নিজ এলাকায় আছেন। ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ভাইদের নিজেদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। মামলার বাদী মোস্তফা ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে এলাকাছাড়া। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় দুটি হত্যা, একটি করে চাঁদাবাজি ও মারামারির মামলা ছিল। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে মৃত দেখানোর পর সেলিম আতঙ্কে থাকায় তাঁকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাড়ির আশপাশে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।

‘মৃত’ দেখিয়ে বড় ভাই মামলা করায় সেলিম এখন নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে থানা ও আদালতে দৌড়াচ্ছেন। সেলিমের কোনো ছেলেসন্তান না থাকায় ১৫ বছর আগে স্ত্রী হাজেরা খাতুন এবং দুই মেয়েকে নিজের কেনা সম্পত্তি থেকে ৪৯ শতক জমি লিখে দিয়েছিলেন। এর পর থেকে বড় ভাই হেলাল উদ্দিন ও আবুল হোসেনে সঙ্গে বিরোধ চলছিল। ভাইদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ২০২২ সালের ১৮ মে সেলিমকে গুরুতর জখম করা হয়। ওই ঘটনায় ২৪ মে সেলিম থানায় মামলা করেন। ভাইদের অত্যাচারে বছরখানেক আগে বাড়ি ছেড়ে ধামর বেলতলী বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে ঘর করে বসবাস করছেন। সেখানে তাঁর একটি দোকান আছে।

শনিবার সকালে বেলতলী বাজারে সেলিমের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, তিনি জিনিসপত্র বিক্রি করছেন। সেলিম বলেন, ‘আন্দোলনে ৩ আগস্ট আমি মারা গেছি দেখিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় আমার ভাই মোস্তফা কামাল মামলা করেছে। একটি ইস্যু সৃষ্টি করে আমাকে পরিকল্পনা করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমি সরকারি লাশ হয়ে যেতাম। আমার স্ত্রী-সন্তান বিচারের জন্য থানায় গেলে তারা দেখত, ৩ আগস্ট আমি মারা গেছি। আন্দোলনের আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। তখন বাড়িতে থাকলে তারা আমাকে মেরে ফেলত।’

সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়েরা প্রায় ১৫০ শতক জমি দখল করে রেখেছেন। জমি নিয়েই ভাইদের সঙ্গে বিরোধ। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে। তাঁর ভাইয়েরা বাড়িতে গেলে মেরে ফেলার ভয় দেখান। এ জন্য ভয়ে বাড়িতে যান না। ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘আমি জীবিত সেটি প্রমাণ করতে দুবার আদালতে গেছি; পুলিশের কাছে গেছি কয়েকবার।’ নিজের ভাইদের বিচার চান তিনি।

দুপুরে মোস্তফা কামালের ভিটেবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণ বাড়িতে কেউ বসবাস করেন না। স্থানীয় আবু বক্কর, মোর্শেদ আলী, শেফালী আক্তার ও রুবেল মিয়া বলেন, মোস্তফাকে এলাকার মানুষ মস্তু ডাকাত হিসেবে চেনেন। ধামর গ্রামের গোলাপ মিয়া, নীল মামুদ ও রয়েল নামের ১০ বছর বয়সী শিশু হত্যায় তিনি জড়িত। এমন কোনো অপরাধ নেই, তিনি করতেন না। তাঁর ভয়ে এলাকার মানুষ এখনো আতঙ্কিত। ২০০৫ ও ২০১২ সালে মোস্তফার বিরুদ্ধে থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়। সর্বশেষ রয়েল হত্যার পর মোস্তফা এলাকা ছাড়েন। ঢাকায় বাস চালিয়ে জীবন চালাচ্ছিলেন বলে জানেন স্থানীয় লোকজন।

সেলিম হত্যা মামলার তদন্তে নেমে বাদীর খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ। ঢাকা ও ফুলবাড়িয়ার ঠিকানার কোথাও নেই মোস্তফা। মামলায় সাক্ষী হিসেবে ১ ও ২ নম্বরে আছেন মো. আলম ও মো. হেলাল। তাঁদের দুজনের বাবার নাম দেখানো হয়েছে মৃত আবদুল হাকিম। বাড়ি ধামর গ্রামে। তাঁরা বর্তমানে ঢাকার মুগদার রুপিবাগে থাকেন বলে উল্লেখ করা হয়।

দুজন সাক্ষীর মধ্যে হেলালের পরিচয় সঠিক পেলেও আবদুল হাকিমের আর কোনো সন্তান ছিল না বলে জানান স্থানীয় লোকজন। দুপুরে হেলালের বাড়িতে গিয়ে ঘরের দরজা খোলা পাওয়া গেলেও ডাকাডাকি করেও বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি।

সেলিমের আরেক ভাই আবুল হোসেন পেশায় দিনমজুর। তাঁর বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর স্ত্রী নাছিমা খাতুন বলেন, সেলিম মারা যাননি। তাঁর সঙ্গে তাঁদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ চলছে। মামলার বাদী মোস্তফা কামাল প্রায় ১৫ বছর ধরে এলাকাছাড়া। তাঁর (মোস্তফা) সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই। জীবিত মানুষকে কেন মৃত দেখানো হলো তিনি বলতে পারবেন না।

সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীরে ছাত্র আন্দোলনে মৃত দেখাইয়া ভাশুরে মামলা করছে। কিন্তু আমার স্বামী তো দোকান করে। বাড়িতে থাকলে মাইরা ফেলত আর দেখাইত আন্দোলনে মারা গেছে। বাড়ি ছেড়ে দেওয়ায় আর মারতে পারেনি। এখন আমরা সব সময় ভয়ে থাকি।’

সেলিম হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছেন গোয়েন্দা পুলিশের ঢাকা ওয়ারীর উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। তিনি তৃতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা।

আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বাদীকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলায় যাঁকে মৃত দেখানো হয়েছে তিনি সম্ভবত বাদীর ভাই। জীবিত ব্যক্তি বাদীর ভাই কি না যাচাইয়ের জন্য আদালতে ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করলে আদালত অনুমতি দিয়েছেন। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেলে সেলিম বাদীর ভাই কি না নিশ্চিত বলা যাবে। তিনি বলেন, ‘বাদীকে পাওয়া না গেলেও মামলা করায় ঘটনার সত্যতা যাচাই করার দায়িত্ব আমাদের। আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ৩ আগস ট এল ক র এল ক য় তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

রংপুরে লিচু কেনাবেচা

২ / ৯বাজারে আনা হয়েছে উচ্চ ফলনশীল বেদানা জাতের লিচু

সম্পর্কিত নিবন্ধ