টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের আশপাশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েকটি পরিবার। গতকাল শনিবার রাত থেকে এ উপজেলায় পানি নামতে শুরু করেছে। উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা উপজেলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আখাউড়ার হাওড়া নদীর বাঁধ রক্ষায় কাজ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক দিন টানা বৃষ্টির কারণে আখাউড়ার বিভিন্ন নদী, খাল ও গাঙে পানি বেড়েছে। আখাউড়া স্থলবন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালন্দি খাল, কালিকাপুর হয়ে আবদুল্লাপুর দিয়ে জাজি গাঙ, বাউতলা দিয়ে মরা গাঙ ও মোগড়া ইউনিয়ন দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওড়া নদী দিয়ে গতকাল রাতে অস্বাভাবিকভাবে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর, আবদুল্লাহপুর, বঙ্গেরচর গ্রামের ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ও কিছু বাড়িঘর তলিয়ে যায়। উপজেলার কেন্দুয়াই মেলার মাঠ এলাকায় অন্তত ১৫টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গতকাল রাত থেকে উপজেলার কালন্দি খাল, জাজি গাঙ ও হাওড়া নদী দিয়ে পানি ঢুকছে। এতে কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর, আবদুল্লাহপুর, বঙ্গেরচর, রহিমপুর, সাবেহনগর, খোলাপাড়া, ওমেদপুর, কর্নেলবাজার, ইটনা, শান্তিপুরসহ ১৫ থেকে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের কিছু রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।

আখাউড়া স্থলবন্দরের মৎস্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারুক মিয়া জানান, গতকাল রাত থেকে পানি ঢুকছে। বন্দরের আশপাশ পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে পানি যেভাবে বাড়ছে, এতে আখাউড়া-আগরতলা সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে দুই দেশের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুর রহমান জানান, আখাউড়া উপজেলার হাওড়া নদীর গঙ্গাসাগর পয়েন্টে আজ সকাল ৯টায় পানির সমতল ছিল ৩ দশমিক ৯৩ মিটার। এখানে বিপৎসীমা ৬ দশমিক শূন্য ৫ মিটার। অর্থাৎ পানি বিপৎসীমার ২ দশমিক ১২ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল একই সময়ে পানির সমতল ছিল ৩ দশমিক ৪৫ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।

আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জি এম রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কিছু গ্রাম তলিয়ে গেছে ও কয়েকটি পরিবার পানিবন্দী আছে। তবে সংখ্যাটি নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তথ্য সংগ্রহ চলছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য জিআর চাল, শুকনা খাবার ও নগদ অর্থ আছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা একটি হটলাইন নম্বর চালু করেছেন। আর বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির অবনতি হবে না।

প্রসঙ্গত, গত বছর আগস্টে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওড়া নদীর তিনটি বাঁধ ভেঙে আখাউড়া উপজেলার ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। তখন ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এতে ১৯৫ হেক্টর ফসলি জমি ও প্রায় ১২ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প ন বন দ উপজ ল র পর ব র ত হয় ছ দশম ক গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

হনুমান কি পর্বত কাঁধে করে উড়ে এসেছিলেন?

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের এক বিশিষ্ট অধ্যায়ে উঠে আসে এক অলৌকিক ঘটনার কথা। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়লে, তাঁকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের—সঞ্জীবনী বুটি। আয়ুর্বেদাচার্য সুষেণের পরামর্শে হনুমান ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে গন্ধমাদন পর্বতে।

রামায়ণে বর্ণিত আছে, নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেন এই পাহাড় বহন করে। পথিমধ্যে তিনি কিছু স্থানে বিশ্রামও নেন; যেসব স্থান আজও ‘হনুমান টোক’, ‘হনুমান চট’, ‘হনুমান ধারা’ নামে পরিচিত।

নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে।

পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয় সব ঘটনা রূপকভাবে লেখা আছে। এককথায় পুরাণের মধ্যে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে আছে। গোলটা ফেলে মালটা বের করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কল্যাণ হয়। এই ঘটনার রূপকতা ব্যাখ্যা করতে একটা গল্পের উল্লেখ করছি।

আরও পড়ুনভারতের আদিতম মহাকাব্য রামায়ণ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাড়িতে ২০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এক ব্যক্তি বাজারে গিয়ে অনেক বাজার করেছেন। ফেরার সময় তিনি নিজের সাইকেলের দুই হ্যান্ডলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, পেছনে দুটো ব্যাগ ঝোলানো, ক্যারিয়ারে একটা বস্তা বাঁধা। জায়গা না পেয়ে নিজের দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক লোক তাঁকে দেখে বললেন ‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন।

তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন। হনুমানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছিল।

রামভক্ত হনুমান ছিলেন যোগী পুরুষ। তিনি যোগবলে অনেক অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি যোগবলে নিজের আকার এত ছোট করে ফেলতে পারতেন যে তাঁকে খালি চোখে দেখা কষ্টকর হয়ে যেত। আবার তিনি ইচ্ছা করলে যোগবলে নিজের আকার অনেক বড় করে ফেলতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।

‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন।

তিনি আসলে ‘সঞ্জীবনী বুটি’ চিনতে না পেরে যোগবলে নিজের শরীরটা অনেক বড় করে সামনে যত ধরনের বৃক্ষ ও লতাপাতা পেয়েছিলেন, সেই সবকিছু সংগ্রহ করে বিশাল এক বোঝা বানিয়ে নিজের পিঠের ওপর তুলে যখন অতি দ্রুত এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিশালদেহী হনুমানকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গোটা পাহাড়টাই পিঠে তুলে নিয়ে লাফাচ্ছেন।

আরও পড়ুনদুর্গাপূজার কাহিনি২০ অক্টোবর ২০২৩

হনুমানের এই অসাধারণ কীর্তিকে অনেকেই অলৌকিক বলেই ভাবেন। কিন্তু অলৌকিকতা ছাপিয়ে এটা তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গুরুর আদেশের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। ভারতের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বাংলাদেশের মহেশখালীর আদিনাথ ধামসহ কিছু স্থানে এই ঘটনার স্মৃতি বহন করে, এমন লোককথা এখনো প্রচলিত।

একটি পাহাড় কাঁধে বহন করে উড়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। আর অবতার, মহাপুরুষ বা প্রেরিত পুরুষেরা কখনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যান না। রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।

রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।

মনে করেন, একজন যোগী পুরুষ নদীর তীর থেকে যোগবলে অদৃশ্য হয়ে নদীর মধ্যে ভেসে উঠলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না, জানতে পারছি না যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই আমার কাছে অলৌকিক। আর ওই যোগী জানেন যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই তাঁর কাছে লৌকিক।

যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভক্তের হৃদয়ে এই ঘটনা গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা এবং নিজেকে গুরুর প্রতি সম্যকভাবে ন্যস্ত করার এক আস্থা ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে রয়েছে। হনুমানের এই গাথা তাঁর ভক্তিমূলক চরিত্রকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি মানবজাতির দুর্দম সাহস ও আত্মত্যাগের কথাও মনে করিয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র: ১. বাল্মীকি রামায়ণ. ২. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ৩. শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ, ৪. মহেশখালীর আদিনাথ ধাম অঞ্চলের লোককথা।

পার্থ দেব বর্মন: গবেষক, সৎসঙ্গ রিসার্চ সেন্টার

আরও পড়ুনরামচন্দ্র, বিষ্ণুর অবতার কিন্তু মানবিক১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ