অভয়নগরে পুড়িয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি পরিদর্শনে নাগরিক প্রতিনিধিদল, নিরাপত্তা ও বিচার নিশ্চিতের দাবি
Published: 3rd, June 2025 GMT
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে পুড়িয়ে দেওয়া হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িগুলো পরিদর্শন করেছে ঢাকার একটি নাগরিক প্রতিনিধিদল। আজ মঙ্গলবার দুপুরে বাড়িগুলো পরিদর্শনের পর প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি দোষীদের বিচারের দাবি জানান। সেই সঙ্গে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
গত ২২ মে সন্ধ্যায় উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের একটি বাড়িতে কৃষক দল নেতা তরিকুল ইসলামকে (৫০) কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। তিনি উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন। তাঁকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে একদল লোক ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের অন্তত ২০টি হিন্দুবাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া উপজেলার সুন্দলী বাজারে দুটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় আহত হন অন্তত ১০ জন।
আজ দুপুরে পরিদর্শনে এসে নাগরিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের শিকার কৃষক দল নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে যান। সেখানে তাঁরা নিহতের ভাই এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলোও ঘুরে দেখেন এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলো ঘুরে দেখেন নাগরিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। আজ দুপুরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারিভাবে নদী মারার ফল ‘ভবদহ জলাবদ্ধতা’
নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক না রাখলে পরিণতি কত ভয়ংকর হতে পারে, তা যশোরের ভবদহে দেখে এলাম। গণমাধ্যমসূত্রে দীর্ঘকাল ধরে যশোরের ভবদহের জলাবদ্ধতার কথা শুনে আসছি। সরেজমিন সেই জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধান করে এলাম। ভবদহে জলাবদ্ধতার যে ধরন দেখে এলাম, দেশে সরকারিভাবে এমন জলাবদ্ধতা তৈরি করার দৃষ্টান্ত অনেক আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজে সিদ্ধহস্ত।
ভবদহ জলাবদ্ধতা বোঝার আগে আমাদের সেখানকার নদী সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। যশোর সদর উপজেলা থেকে মুক্তেশ্বরীর নামে একটি নদী চলে এসেছে অভয়নগরের দিকে। মাঝপথে একটি প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুক্তেশ্বরীর নাম হয় টেকা।
অভয়নগর বাজারের ঠিক পাশেই শ্রী নামে একটি নদী এসে মিলিত হয়েছে টেকা নদীর সঙ্গে। এরপর টেকা নাম বদলে হয়েছে হরি নদ। ঠিক যেখানে হরি নাম হয়েছে, তার বাঁ তীর থেকে শ্রী নামে আরেকটি নদী বিল ডাকাতিয়া দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। হরি নদের ভাটিতে আপারভদ্রা নামে আরেকটি নদী এসে মিলিত হয়েছে। তখন হরি নদের নাম হয়েছে তেলিগাতী গ্যাংরাইল, যা শিবসা নদী হয়ে চলে গেছে সমুদ্রে।
ভবদহ বাজার থেকে নদীর ভাটিতে প্রচুর পলি জমেছে। নদীটির দুই দিকে অনেকাংশ অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। মাছের ঘের, দোকানপাট, বাড়িসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে নদীতে। দেখলাম, পানি উন্নয়ন বোর্ড হরি নদের মাটি তুলে নদের ভেতরে ফেলেছে। ফলে নদটি অনেক সংকুচিত হয়েছে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি উজানে চলে আসে। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ষাটের দশকে হরি নদের ভবদহ নামক স্থানে জোয়ারের পানি যাতে আসতে না পারে, সে জন্য ২১ ভেন্টের একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। কেবল তা–ই নয়, শ্রী নামের উপনদী এবং শাখানদী—উভয় অংশের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। হরি নদের শাখা হিসেবে যে অংশ প্রবাহিত হতো, সেটিও ৪০০-৫০০ ফুট প্রশস্তের।
২১ ভেন্টের স্লুইসগেট তৈরি করার মাধ্যমে সমুদ্রের লোনাপানি টেকা নদী ও শ্রী নদীতে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এতে প্রথম কয়েক বছর লবণাক্ত জোয়ারের পানির প্রবাহ বন্ধ করে চাষাবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল। ১৫-২০ বছরের মধ্যেই স্লুইসগেটের ভাটিতে প্রচুর পলি জমা হয় এবং বর্ষার পানি স্লুইসগেট খুলে দিলেও আর নিচে নামে না। কারণ, ভাটিতে পলি পড়ে অনেক উঁচু হয়েছে। গত শতকের আশির দশক থেকে ক্রমে জলাবদ্ধতা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
ভবদহ এলাকায় অনেক নিম্নাঞ্চল আছে। ভবদহের যে স্থানে ২১ ভেন্টের স্লুইসগেট আছে, তার উজানে ৫২টি নিম্নাঞ্চল আছে। নদীর ডান তীর–সংলগ্ন আরও ১২৯টি নিম্নাঞ্চল আছে। আগে এগুলোতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করত। এখন লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে না। কিন্তু ভাটি উঁচু হওয়ার কারণে অভয়নগর থেকে শুরু করে যশোর জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। জলাবদ্ধতায় কয়েকটি উপজেলায় বাড়িঘর-সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়।
নদীকে নদীর মতো থাকতে দেওয়া না গেলে ভবদহ জলাবদ্ধতা দূর হবে না। বর্তমানে ভবদহ এলাকায় ঘেরপদ্ধতিতে প্রচুর মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। নদী উন্মুক্ত থাকলে ঘেরপদ্ধতিতে মাছ চাষ করা কঠিন হবে না। ভবদহ সংকট নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবেভবদহ জলাবদ্ধতা থেকে উত্তরণে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুবার ড্রেজার মেশিনও আনা হয়েছিল খননের জন্য। এ ছাড়া কয়েকবার খনন করা হয়েছে। কিন্তু খননের কয়েক বছরের মধ্যে আবার পলি পড়ে ভরাট হয় নদী। একবার এ নদীর জোয়ারের পানি একটি বিলের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেটাতে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া গেছে।
ভবদহ এলাকায় দেখলাম, ২১ ভেন্ট এবং ৬ ভেন্টের উজানে মোট ২০টি পাম্প দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি তুলে ভাটিতে দেওয়া হয়। আরেকটি ৩ ভেন্টের স্লুইসগেট তৈরি করেছে বিএডিসি। স্থানীয় লোকজন বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ সাপেক্ষে সেখানেও পাম্প চালু করেছে। কেবল পাম্প করে পানি তুলে জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবদহে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২১ ভেন্টের এই স্লুইস গেটটি ভবদহ জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ