মানব সভ্যতা প্লাস্টিকে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত সামগ্রী ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারে না মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৪৩ কোটি টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার দুই-তৃতীয়াংশ মাত্র একবার ব্যবহারের পরে বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। প্রতিদিন বিশ্বের সমুদ্র, নদী এবং হ্রদে প্লাস্টিকভর্তি ২ হাজার ট্রাকের সমপরিমাণ আবর্জনা ফেলা হয়। বিশ্বে প্রতিবছর ১৯ থেকে ২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য জলজ বাস্তুতন্ত্রে মিশে যায়, যা হ্রদ, নদী  এবং সমুদ্রকে দূষিত করে। ট্রপিক অঞ্চল থেকে আর্কটিক অঞ্চল সর্বত্রই প্লাস্টিকের রাজত্ব।  প্লাস্টিক এবং এর থেকে তৈরি পণ্য বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। মাছ ধরার জাল থেকে শুরু করে পানির বোতল এবং আবর্জনার ব্যাগের মতো একক ব্যবহারের জিনিসপত্র সবকিছুই ছড়িয়ে পড়ছে খাল, বিল, নদী, সমুদ্রে, পাড়ি দিচ্ছে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে।  দীর্ঘ পথ ভ্রমণে প্লাস্টিক সামগ্রীতে (যেমন ধরি প্লাস্টিক বোতল)  জড়িয়ে এক অঞ্চলের প্রাণীকে নিয়ে হাজির করছে ভিন্ন আবহাওয়া, জলবায়ুর অঞ্চলে, ফলে বিনষ্ট হচ্ছে প্রজাতির প্রাকৃতিক বিন্যাস।  


প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশের সব অনুষঙ্গ মাটি, পানি, বাতাস দূষিত করছে।  পৃথিবীর সিংহভাগজুড়ে থাকা সমুদ্রকে শ্বাসরোধ করছে। পরিবেশ এবং খাদ্যচক্রের বিভিন্ন ধাপে ঢুকে মানুষসহ অন্যান্য জীবের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে এবং আমাদের জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে।  আমরা এখন প্রতিবছর ৪৩০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন এবং ব্যবহার করি, যার দুই-তৃতীয়াংশই স্বল্পস্থায়ী পণ্য যা শিগগিরই বর্জ্যে পরিণত হয়। ‘বিচ ক্লিনআপ অ্যান্ড বিয়ন্ড প্লাস্টিক’  নামের একটি সংস্থা তাদের গবেষণা তথ্য থেকে বলেছে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালে রিসাইকেল বিনে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্লাস্টিক পুনঃচক্রায়ন করা হয়েছিল। আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৮৫ শতাংশের শেষ গন্তব্য ল্যান্ডফিল আর বাকি ১০ শতাংশ পোড়ানো হয় ইনসিনারেটরের মাধ্যমে। ল্যান্ডফিলে যে ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হলো সেটি মাটির কতটা ক্ষতি করছে এবং জীব ও খাদ্যচক্রে এর কী প্রভাব পড়ছে সে নিয়ে আমাদের জানাও সীমিত।  প্রায় ১৩ হাজার রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিকসামগ্রী তৈরিতে এবং এসব রাসায়নিকের অনেকগুলোর  বিষক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের এখনও পুরো ধারণা নেই।   


পুনঃচক্রায়নকালে নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক একত্রিত হয়ে যে ককটেল উৎপন্ন হয় সেটি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।  অপরদিকে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনে প্লাস্টিক উৎপাদনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। প্লাস্টিক উৎপাদনে বিশ্বে জ্বালানি ব্যবহারের বিশাল অংশ ব্যয় হয়। ২০১৯ সালে প্লাস্টিক উৎপাদনে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয় যা বিশ্বব্যাপী নির্গমনের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী মোট নির্গমনের উৎস প্লাস্টিক শিল্প এবং জীবাশ্ম জ্বালানির রূপান্তর। আমাদের নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক মোটেও জৈব পচনশীল নয় বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ছোট থেকে ছোট টুকরোতে ভেঙে যায়, যেটি মাইক্রোপ্লাস্টিক কিংবা  ন্যানোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত। মাটি, পানি, বায়ু সর্বত্র এর বিচরণ এবং সহজেই প্রবেশ করছে প্রাণীদেহে। মাইক্রোপ্লাস্টিক পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং দূষণ ঘটাচ্ছে। বলা হয়, আমাদের পোশাক এবং লন্ড্রির মতো দৈনন্দিন জিনিসপত্র থেকে শুরু করে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া বা সমুদ্রের গভীরতম স্থানের মতো উল্লেখযোগ্য স্থান পর্যন্ত এর বিচরণ। সময়ের চক্রে প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হচ্ছে।  এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের পাকস্থলীতে এবং রক্তেও পাওয়া  যাচ্ছে বলে  গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, আকারে ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক মানব স্বাস্থ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিশাল হুমকি। 


প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী পুনঃচক্রায়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন প্লাস্টিকসামগ্রী একত্রে পুনঃচক্রায়ন বা রিসাইকেল করার সময় নতুন ধরনের রাসায়নিকের সৃষ্টি হয়, যেটি একক প্লাস্টিক সামগ্রীতে থাকা প্লাস্টিকের চেয়েও ভয়ানক ক্ষতিকর।  আমরা প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার করি এবং তাতে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ সংরক্ষণ করে থাকি, যেমন,  ধরা যাক প্লাস্টিক কনটেইনারে আমরা কীটনাশক সংরক্ষণ করছি এবং দীর্ঘদিন ধরে এই কনটেইনার কীটনাশকের কিছু অংশ শোষণ করে। এভাবে নানা কনটেইনারে সংরক্ষিত দ্রব্য থেকে শোষিত রাসায়নিক মিলেমিশে রাসায়নিকের ককটেল তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে এই বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য  প্লাস্টিক থেকে তৈরি পণ্যগুলোতে স্থানান্তরিত হতে পারে।  


২০১০ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি প্লাস্টিক উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় আছে, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নাই বললেই চলে। যদিও অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কম প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে, তবুও অব্যবস্থাপিত প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ এখানে  উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দেশে প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নানা আইন থাকলেও এর অপর্যাপ্ত ব্যবহার এবং অসচেতনার কারণে প্লাস্টিক দূষণ ভয়াবহ রূপ নিয়ে কৃষিকেও হুমকির মুখে ফেলছে। প্লাস্টিক যেন সিন্দবাদের ভূত হয়ে আমাদের ঘাড়ে উঠে বসেছে, তাকে খুব সহজেই যে নামানো যাচ্ছে না তা আমাদের নেওয়া ব্যবস্থার অসফলতা থেকেই বোঝা যায়।   এটা বলা ঠিক হবে না যে, আমরা এখনই প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে দেই এবং সেটা সম্ভবও  না।  বরং প্লাস্টিক কীভাবে পরিবেশসম্মত উপায়ে ব্যবহার করা যায়, প্লাস্টিক উৎপাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার পরিহার করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। তাই পরিবেশ দিবস এলে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের স্লোগান দিলেই হবে না। এর উৎপাদন এবং ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্লাস্টিককে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে  আমরা  অভিশপ্ত প্লাস্টিক সভ্যতায় নিয়ন্ত্রিত ও পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত হবো এবং সেদিকেই বুঝি যাচ্ছে বিশ্ব।


 ড.

এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
saifullahasm@yahoo.com 
  

 


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য প ল স ট ক উৎপ দ ব যবহ র কর ব শ বব য প র ব যবহ র ব যবস থ হ র কর আম দ র পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে বইমেলায় বিক্রি কম, এখনো আশায় আছেন প্রকাশকেরা

রাজশাহী বিভাগীয় বইমেলার প্রথম তিন দিনে লোকজনের ভিড় থাকলেও বেচাকেনা তেমন হয়নি। এতে অনেক প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকেরা ও আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা কালেক্টরেট মাঠে ৯ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে এবং রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ মেলা চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০টি বেসরকারি প্রকাশনাসহ মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে মেলা চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়।

উদ্বোধনের আগের দিন বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। সেই কর্দমাক্ত পরিবেশেই মেলার উদ্বোধন হয়। দর্শনার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পরে প্রতিটি স্টলের সামনে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বিক্রির খরা কাটেনি বলে জানালেন বিক্রেতারা।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন অংশে তখনো পানি জমে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলেও কাদা। সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। স্টলের সামনে ইটের সলিংয়ের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন অনেকে। অনেকে বই দেখছেন।

সূর্যোদয় প্রকাশনীর বিক্রেতা রিপন আলী বলেন, প্রথম দিন তো কাদাপানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো মানুষ ছিলেন। এখন ইট বিছানোর পর আরও বেশি মানুষ আসছেন, ভিড়ও করছেন, কিন্তু বই কিনছেন খুব কম।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে কাদার ওপর চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল বিক্রয়কর্মী ও চিত্রশিল্পী অর্ণব পাল সন্তুকে। তিনি বলেন, মানুষ আসছেন, ঘুরে দেখছেন, কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। মেলার ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতে পারত। আরেক বিক্রেতা আবদুল্লাহ হীল বাকি জানালেন, এমনও স্টল আছে, যেখানে সারা দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বইও বিক্রি হচ্ছে না।

তবে হতাশার ভিড়ে আশার কথাও শোনালেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম থেকে আসা নন্দন বইঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, বেচাবিক্রি আজ না হোক কাল হবে। মানুষ যে মেলায় এসে বই হাতে নিয়ে দেখছেন, এটাই বড় পাওয়া। এতে তাঁদের মধ্যে বই কেনার আগ্রহ তৈরি হবে।

মেলায় আসা পাঠকদের মধ্যে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। দুই সন্তানের জন্য শিশুতোষ বই কিনে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম।
মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের বই কিনেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় একসঙ্গে অনেক বই পাওয়া যায়, যা বই কেনার জন্য দারুণ সুযোগ।

রাজশাহী কালেক্টরেট মাঠে বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ