গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী জাহাজে কারা আছেন, এতে কী ত্রাণ আছে
Published: 5th, June 2025 GMT
আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) পরিচালিত ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটি ইতালি থেকে গাজা উপত্যকার পথে রয়েছে। জাহাজটি গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী ওই জাহাজে আছেন।
গত ২ মার্চ থেকে গাজায় পুরোপুরিভাবে ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে দেয় জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। এমন অবস্থায় অনাহারে ভুগে বেশ কয়েকজন শিশু মারা যায়। ত্রাণ প্রবেশে বাধা দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ‘ম্যাডলিন’ নামের এই জাহাজ যাত্রা শুরু করে।
বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার হিসাব অনুসারে, গাজার ২৩ লাখের বেশি বাসিন্দার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ তীব্রমাত্রায় খাদ্যসংকটে ভুগছেন।
গাজার প্রথম ও একমাত্র নারী মৎস্যশিকারির নামানুসারে ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছে। এটি ১ জুন ইতালির সিসিলির কাতানিয়া শহর থেকে রওনা দিয়েছে। মাল্টার উপকূলে ‘কনসায়েন্স’ নামে এফএফসি পরিচালিত আরেকটি ত্রাণবাহী জাহাজে বোমা হামলা হওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছে।
২ হাজার কিলোমিটার (১ হাজার ২৫০ মাইল) দীর্ঘ এই যাত্রায় যদি কোনো বিঘ্ন না ঘটে, তাহলে গন্তব্যে পৌঁছাতে জাহাজটির প্রায় ৭ দিন সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুনগাজায় ফ্লোটিলার ত্রাণবাহী জাহাজ ঢুকতে দেবে না ইসরায়েল১৩ ঘণ্টা আগেগবেষণা সংস্থা ফরেনসিক আর্কিটেকচার ও জাহাজে থাকা গারমিন লাইভ ট্র্যাকারের মাধ্যমে জাহাজটির অবস্থান শনাক্ত করা হচ্ছে। গ্রিনিচ মান সময় ৪ জুন রাত ১১টা নাগাদ গ্রিক দ্বীপ ক্রিটের দক্ষিণে অবস্থান করছিল ‘ম্যাডলিন’।
গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলেছে, তারা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ত্রাণবাহী জাহাজটিকে নিজেদের জলসীমায় প্রবেশ করতে দেবে না।
নজরদারি ড্রোন
গত মঙ্গলবার গভীর রাতে ‘ম্যাডলিন’ জাহাজের ওপর একটি নজরদারি ড্রোনকে ওড়াউড়ি করতে দেখা যায়। জাহাজটি তখন গ্রিসের জলসীমা থেকে প্রায় ৬৮ কিলোমিটার (৪২ মাইল) দূরত্বে অবস্থান করছিল।
পরে জানা যায়, এটি গ্রিসের হেলেনিক কোস্টগার্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘হেরন’ মডেলের ড্রোন। পরে এটি সরে যায়।
জাহাজের ভেতর কারা আছেন
‘ম্যাডলিন’ জাহাজে মোট ১২ জন মানবাধিকারকর্মী আছেন। তাঁরা হলেন—সুইডেনের পরিবেশবিষয়ক আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসান, জার্মানির ইয়াসেমিন আচার, ফ্রান্সের ব্যাপতিস্ত আন্দ্রে, ব্রাজিলের থিয়াগো আভিলা, ফ্রান্সের ওমর ফায়াদ, পাস্কাল মৌরিয়েরাস, ইয়ানিস মোহামদি, তুরস্কের সুলাইব ওর্দু, স্পেনের সার্জিও তোরিবিও, নেদারল্যান্ডসের মার্কো ফন রেনেস ও ফ্রান্সের রিভা ভিয়া।
এফএফসি জোরালোভাবে বলেছে, ম্যাডলিন জাহাজে থাকা স্বেচ্ছাসেবক ও নাবিকদের সবাই অসহিংস আচরণের চর্চা করেন। তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে বেসামরিক প্রতিরোধের অংশ হিসেবে নিরস্ত্র অবস্থায় গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যাত্রা করছেন।
আগের জাহাজগুলোর কী হয়েছিল
গত মাসে গাজার উদ্দেশে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় আরেকটি জাহাজ মাল্টার উপকূলে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে। জাহাজটি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল।
এফএফসি আল–জাজিরাকে বলেছে, গত ২ মে স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটে ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে ড্রোন হামলা হয়। এতে জাহাজে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয় ও ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়।
১৫ বছর আগে, ২০১০ সালের ৩১ মে ইসরায়েলি কমান্ডোরা তুর্কি কর্মীদের বহনকারী সবচেয়ে বড় ত্রাণবাহী জাহাজ মাভি মারমারাতে প্রাণঘাতী হামলা চালায়। ‘গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ নামক জাহাজটি গাজার অবরোধ ভাঙার উদ্দেশ্যে ১০ হাজার টন মানবিক সহায়তা নিয়ে ইস্তাম্বুল থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। ওই হামলায় ৯ জন স্বেচ্ছাসেবক নিহত হন।
২০০৭ সাল থেকে গাজার স্থল, জল ও আকাশপথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল।
জাহাজটিতে কী কী ত্রাণ আছে
ফ্রি ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের এক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গাজার মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে যেসব সহায়তা দরকার, সেগুলো বহন করছে জাহাজটি। এর মধ্যে আছে—চিকিৎসা সরঞ্জাম, ময়দা, চাল, শিশুদের দুধ (বেবি ফর্মুলা), ডায়াপার, নারীদের স্যানিটারি পণ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ কিট, ক্রাচ ও শিশুদের কৃত্রিম অঙ্গ।
গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি
ইসরায়েলে তিন মাস ধরে পুরোপুরি অবরোধ চলার কারণে গাজার প্রতি পাঁচ ফিলিস্তিনির একজন এখন চরম খাদ্যসংকটে ভুগছেন।
সর্বশেষ ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার মোট জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১৯ লাখ ৫০ হাজার মানুষ তীব্র খাদ্যঘাটতিতে আছে।
আইপিসি আরও বলেছে, ইসরায়েলের এই অবরোধ অব্যাহত থাকলে ‘প্রশাসনিক অঞ্চলের ভেতরে ও বাইরে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানচ্যুতি’ ঘটতে পারে। কারণ, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) নামের একটি ত্রাণ বিতরণ সংস্থা গত মাসে গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু ২৭ মে এর নতুন বিতরণকেন্দ্র চালু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিশেষ করে কয়েক দিন ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রাণঘাতী গুলিতে বিপুল প্রাণহানির ঘটনার পর এই কেন্দ্র ঘিরে বিতর্ক আরও জোরদার হয়েছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে ওই ত্রাণকেন্দ্রগুলোয় নিয়ে আসছে এবং সেখানে হামলা চালাচ্ছে। এসব কেন্দ্রে গত আট দিনে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র জ হ জট অবস থ অবর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
মাঝরাতে সরকারি কর্মকাণ্ড কতটা স্বাভাবিক
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোধকরি একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা সম্ভব। তাঁরা যেভাবে গভীর কিংবা শেষ রাতে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছেন; তাতে তো মনে হচ্ছে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা দিনে কাজ না করে রাতেই মনে হয় বেশি কাজ করেন! কয়েকটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।
মাস কয়েক আগে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ হয়ে গেল, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাত তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে রাত তিনটার সময় আর কোনো মন্ত্রী এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। আমরা সবাই ভাবলাম, তিনি হয়তো বড় কোনো ঘোষণা দেবেন। এরপর কী দেখলাম?
তিনি খুব সাধারণভাবে বললেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার নিজেদের উদ্যোগকে কঠিন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।
সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি যুদ্ধবিমান ঢাকা শহরের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল বিল্ডিংয়ে ভেঙে পড়ল। আগুনে দগ্ধ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নিজেরা উঠে এসে হাঁটছে; এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে যে কেউ হয়তো ট্রমায় চলে যাবে। ওই স্কুলের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা হয়তো সরাসরি সেই দৃশ্য দেখেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে—এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সময়ের দাবি ছিল। এ সিদ্ধান্ত সরকার দিনের বেলাতেই নিতে পারত। অথচ আমরা কী দেখলাম?
সরকারের পক্ষ থেকে রাত তিনটার দিকে ফেসবুকে এসে ঘোষণা করা হলো, পরের দিনের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।দিন দু-এক আগে এ সরকারকেই যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, এ কথা বলছি কারণ, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা’—সেই ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গভীর রাতে ফেসবুক এসে লাইভ করেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
এই আড়াই ঘণ্টার লাইভে মূল যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন, সারমর্ম করলে দাঁড়ায়: বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তিনি এটাও বলেছেন, এই সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হেয়ার রোড থেকে আসে। অর্থাৎ উপদেষ্টারা যেখানে থাকেন।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। যদিও ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তিনি বেশ কয়েকবার এডিট করেছেন। তবে প্রথমে যা লিখেছেন, সেটা হচ্ছে, নতুন একটি দলের মহারথীদের কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়িত। এ ছাড়া তিনি এটাও বলেছেন, একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তাঁদের কেন প্রশ্রয় দেওয়া হলো? আপনারা যদি জানেনই কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে সরকারের অংশ হিসেবে আপনাদের তো দায়িত্ব তাঁদের আইনের আওতায় আনা। সেটা না করে ফেসবুকে পোস্ট করতে হচ্ছে কেন? তা–ও আবার রাত তিনটায়!
এই সরকার কি মাঝরাতের ফেসবুকীয় সরকারে পরিণত হয়েছে? পরীক্ষা পেছানোর মতো সিদ্ধান্ত যখন মাঝরাতে নিতে হয়, সংবাদ সম্মেলন যখন রাত তিনটায় করতে হয়, তখন তো প্রশ্ন জাগতেই পারে। কারণ এটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।
রাষ্ট্র যদি ভালো না থাকে তবে তার মাত্রা কতটুকু, সেটা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]