ইন্টারনেট–সংশ্লিষ্ট কোনো সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। স্মার্টফোনের ব্যবহার, ইন্টারনেটের ব্যবহারসহ সাইবার জগতের অনেক কিছুতেই প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। এমনকি মাসে মোবাইল ডেটার ব্যবহারেও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।

মোবাইল অপারেটরদের সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে মাসে গড়ে ৭ দশমিক ২৬ জিবি (গিগাবাইট) ডেটা ব্যবহার করা হয়। যেখানে ভারতে ২৭ দশমিক ৫ জিবি, পাকিস্তানে ৮ দশমিক ৩৫ জিবি, শ্রীলঙ্কায় ১১ দশমিক ৬ জিবি, মালয়েশিয়ায় ২১ দশমিক ৬ জিবি, থাইল্যান্ডে ৩০ দশমিক ৩ জিবি এবং ভিয়েতনামে ৯ দশমিক ২ জিবি ব্যবহার করেন গ্রাহকেরা।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৩ কোটির বেশি ইন্টারনেট গ্রাহক। যার মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহক ১১ কোটি ৬৫ লাখের বেশি। এ ছাড়া দেশে ফোরজি নেটওয়ার্কের বিস্তার প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য অবকাঠামো রয়েছে। যদিও সব জায়গায় ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়া নিয়ে এখনো অভিযোগ আছে।

অপারেটরসহ সংশ্লিষ্টরা মোবাইল ডেটার ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে জানায়, উপযুক্ত কনটেন্ট ও ব্যবহারের সুযোগ না থাকা, স্মার্টফোন ও ডেটার দাম, ডিজিটাল সক্ষমতা এবং প্রয়োজনবোধ না করা।

দেশে ইন্টারনেট সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইনে ভিডিও দেখা, মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার, অনলাইন বিনোদন এবং ভিডিও কলে। মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশে ডেটা ব্যবহারের জন্য অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এটাকে কাজে লাগাতে হবে।বি এম মইনুল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন কনটেন্ট এবং কনটেন্ট নির্মাতাদের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশেও এ ধরনের নির্মাতাদের দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ওটিটি প্ল্যাটফর্মও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি ওটিটি রয়েছে, যা শহরকেন্দ্রিক এবং সবার কাছে পৌঁছায়নি।

এ ছাড়া অনলাইনভিত্তিক সেবা খাতও বাংলাদেশে বড় হয়নি। দেশে যে কয়েকটি ই-কমার্স রয়েছে, তাদের বাজারও ছোট ও ঢাকাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ অনলাইনে পণ্য কেনা ও সেবা গ্রহণের বিষয়টিও শহরের বাইরে তেমন যায়নি। অনলাইনে লেনদেনের ক্ষেত্রেও তা–ই। ই-কমার্স, ডিজিটাল পেমেন্ট, সরকারি-বেসরকারি সেবা মিলিয়ে সবার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠেনি।

ডেটার ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন আর ইন্টারনেটের সংযোগের জন্য স্মার্টফোন প্রয়োজন। কিন্তু এই দুই সংযোগই বাংলাদেশে তুলনামূলক কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চলতি এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার সরাসরি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল। তবে বিশ্বব্যাংকের ‘ডিজিটাল অগ্রগতি ও প্রবণতা প্রতিবেদন ২০২৩’–এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৩৯ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।

অন্যদিকে স্মার্টফোনের ব্যবহারও কম এ দেশে। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের ৭২ শতাংশ পরিবারে স্মার্টফোন রয়েছে। পরিবার পর্যায়ে স্মার্টফোনের ব্যবহারে অগ্রগতি থাকলেও ব্যক্তি পর্যায়ে কম। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সংখ্যা ৫২ শতাংশ।

ব্রডব্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মুঠোফোন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না।

ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন কম ব্যবহারের কারণ হিসেবে সামর্থ্যের বিষয়টি সামনে আনা হয়। জিএসএমএর জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদনে মুঠোফোনে ইন্টারনেটের ডেটা খরচ ও মুঠোফোনের দামকে অন্যতম বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্রডব্যান্ড কমিশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে স্মার্টফোনের সর্বজনীন ব্যবহার নিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর ‘স্ট্র্যাটেজিস টুয়ার্ডস ইউনিভার্সাল স্মার্টফোন অ্যাকসেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে সামর্থ্য না থাকায় ব্যবহার করেন না ১১ শতাংশ, সুযোগ না থাকায় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না এমন মানুষের সংখ্যা ১৭ শতাংশ মানুষ।

বাংলাদেশে ডেটা ব্যবহারের হার প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় কম হওয়ার কারণ হিসেবে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম খরচজনিত সীমাবদ্ধতা ও ডিজিটাল সক্ষমতার অভাবের কথা বলেন।

প্রথম আলোকে সাহেদ আলম বলেন, যদিও প্রতি জিবি ইন্টারনেটের মূল্য বৈশ্বিকভাবে এখানে কম। তার পরও নিম্নআয়ের কারণে স্মার্টফোন, কর এবং ডেটা প্যাকেজের মোট খরচ অনেক ব্যবহারকারীর জন্য এখনো বেশি। তা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং ডিজিটাল শিক্ষার হার এখনো তুলনামূলক কম থাকায় অনেকেই পূর্ণভাবে অনলাইন সুবিধা নিতে পারছেন না।

ব্রডব্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মুঠোফোন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ না করাও ডেটার ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। ব্রডব্যান্ড কমিশন বলেছে, দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনই মনে করেন না এবং ৬ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তার কারণে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। অন্যদিকে জিএসএমএর প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ শতাংশ পুরুষ ও ৬ শতাংশ নারী বলেছেন, ইন্টারনেট তাঁদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের দামের বিষয়টির এখানে ভূমিকা আছে। এখনো ইন্টারনেট অনেকের কাছে সামর্থ্যের বাইরে। এ ছাড়া স্মার্টফোনের উচ্চ মূল্য তো রয়েছেই। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশে স্থানীয় প্ল্যাটফর্ম কম এবং দেশি-বিদেশি যেসব আছে, তার ব্যবহারও কম। তিনি মনে করেন, দেশে ডেটা ব্যবহারের জন্য অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এটাকে কাজে লাগাতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র র জন য ড ট র ব যবহ র ব শ বব দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে বইমেলায় বিক্রি কম, এখনো আশায় আছেন প্রকাশকেরা

রাজশাহী বিভাগীয় বইমেলার প্রথম তিন দিনে লোকজনের ভিড় থাকলেও বেচাকেনা তেমন হয়নি। এতে অনেক প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকেরা ও আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা কালেক্টরেট মাঠে ৯ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে এবং রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ মেলা চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০টি বেসরকারি প্রকাশনাসহ মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে মেলা চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়।

উদ্বোধনের আগের দিন বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। সেই কর্দমাক্ত পরিবেশেই মেলার উদ্বোধন হয়। দর্শনার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পরে প্রতিটি স্টলের সামনে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বিক্রির খরা কাটেনি বলে জানালেন বিক্রেতারা।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন অংশে তখনো পানি জমে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলেও কাদা। সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। স্টলের সামনে ইটের সলিংয়ের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন অনেকে। অনেকে বই দেখছেন।

সূর্যোদয় প্রকাশনীর বিক্রেতা রিপন আলী বলেন, প্রথম দিন তো কাদাপানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো মানুষ ছিলেন। এখন ইট বিছানোর পর আরও বেশি মানুষ আসছেন, ভিড়ও করছেন, কিন্তু বই কিনছেন খুব কম।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে কাদার ওপর চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল বিক্রয়কর্মী ও চিত্রশিল্পী অর্ণব পাল সন্তুকে। তিনি বলেন, মানুষ আসছেন, ঘুরে দেখছেন, কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। মেলার ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতে পারত। আরেক বিক্রেতা আবদুল্লাহ হীল বাকি জানালেন, এমনও স্টল আছে, যেখানে সারা দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বইও বিক্রি হচ্ছে না।

তবে হতাশার ভিড়ে আশার কথাও শোনালেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম থেকে আসা নন্দন বইঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, বেচাবিক্রি আজ না হোক কাল হবে। মানুষ যে মেলায় এসে বই হাতে নিয়ে দেখছেন, এটাই বড় পাওয়া। এতে তাঁদের মধ্যে বই কেনার আগ্রহ তৈরি হবে।

মেলায় আসা পাঠকদের মধ্যে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। দুই সন্তানের জন্য শিশুতোষ বই কিনে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম।
মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের বই কিনেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় একসঙ্গে অনেক বই পাওয়া যায়, যা বই কেনার জন্য দারুণ সুযোগ।

রাজশাহী কালেক্টরেট মাঠে বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ