মেটার কাছে সরকার ৩,৭৭১টি অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছে
Published: 12th, June 2025 GMT
বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৭৭১টি অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তথ্য চেয়ে অনুরোধ পেয়েছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। তবে বছরের প্রথমার্ধের চেয়ে শেষার্ধে এ ধরনের অনুরোধের সংখ্যা কমে আসে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে ৪ হাজার ২২০টি কনটেন্টে (আধেয়) ব্যবহারকারীদের প্রবেশ সীমিত করে দেয় মেটা। পাশাপাশি একই বছরে গুগলের কাছে সরকার ৫ হাজার ৮২৭টি আধেয় সরানোর অনুরোধ করেছিল।
বিশ্বের শীর্ষ দুই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেটা ও গুগল বছরে দুবার স্বচ্ছতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই স্বচ্ছতা প্রতিবেদন থেকে বাংলাদেশ-সম্পর্কিত এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মেটা ও গুগলের স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া ও আধেয় সরানোর অনুরোধ বেশি ছিল। পরের ছয় মাসে তা কমে আসে। উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ওই বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয়।
বাংলাদেশ সরকারের হয়ে এসব প্ল্যাটফর্মের কাছে অনুরোধ জানিয়ে থাকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বছরের শেষভাগে এসে অনুরোধের পরিমাণ কমে আসা প্রসঙ্গে বিটিআরসির এক সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের সময়ে এসে অনুরোধের পরিমাণ তুলনামূলক কমেছে।
মেটা বলছে, সংশ্লিষ্ট আইন এবং নিজেদের পরিষেবা শর্তাবলির আলোকে বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের অনুরোধে প্রতিষ্ঠানটি সাড়া দেয়। মেটার দাবি, প্রতিটি অনুরোধ আইনি মানদণ্ড যাচাইয়ে সতর্কতার সঙ্গে তারা সেটি পর্যালোচনা করে থাকে।
গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার মেটার কাছে ৯২৬টি অনুরোধ করে। এর মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ার অনুরোধ ছিল ৮৯৭টি আর জরুরি ভিত্তিতে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ ছিল ২৯টি। সরকার মেটার কাছে ১ হাজার ৪৮৬টি অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ ক্ষেত্রে মেটা তথ্য দিয়েছে।
এর আগের ছয় মাস অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৫০১টি অনুরোধের মাধ্যমে ২ হাজার ২৮৫টি অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল সরকার। এ সময় ৬৮ দশমিক ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে সাড়া দেয় মেটা। সবমিলিয়ে ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৭৭১টি অ্যাকাউন্টের বিষয়ে মেটার কাছে তথ্য চাওয়া হয়।
গত বছরের শেষ ছয় মাসে মেটা বাংলাদেশে ১ হাজার ২৮০টির মতো আধেয়তে প্রবেশ সীমিত করে দেয়। এর মধ্যে ফেসবুকে মন্তব্য (কমেন্ট) ১ হাজার ১৪০টির বেশি, ১২৩টি পোস্ট, ৮টি প্রোফাইল রয়েছে। আর প্রথম ছয় মাসে মেটা ২ হাজার ৯৪০টির বেশি আধেয়তে প্রবেশ সীমিত করে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৬০০টির বেশি ফেসবুক মন্তব্য, পোস্ট ৩১৭টি, পেজ ও গ্রুপ ১টি এবং প্রোফাইল ৫টি।
মেটা বলেছে, ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীন বিভিন্ন অপরাধের জন্য স্থানীয় আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি যেসব রিপোর্ট করেছে, মেটা সেসব আধেয়তে প্রবেশ সীমিত করেছে। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত পণ্য, ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বৈরিতা উসকে দেওয়ার মতো বিষয় ছাড়াও স্থানীয় অন্যান্য আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল।
ইউটিউবের আধেয় সরানোর অনুরোধ
বাংলাদেশ সরকার গুগলের কাছে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫৩টি অনুরোধ জানায়। এসব অনুরোধে ১ হাজার ৩৫৭টি আধেয় সরাতে বলা হয়। এসব অনুরোধের ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে গুগল কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে যথেষ্ট তথ্য ছিল না। বাকিগুলো আইনি প্রক্রিয়া, নীতিমালাসহ বিভিন্ন কারণে সরানো হয়।
সরকারের অনুরোধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল মানহানি, নিয়ন্ত্রিত পণ্য ও সেবা এবং সরকারের সমালোচনার বিষয়বস্তু। সরকার সবচেয়ে বেশি ইউটিউবের বিষয়বস্তু সরানোর অনুরোধ জানিয়েছিল।
এর আগে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৩৭টি অনুরোধ করা হয়। ওই সময়ে ৪ হাজার ৪৭০টি আধেয় সরানোর জন্য অনুরোধ করে সরকার। সবমিলিয়ে এক বছরে গুগলের কাছে সরকার ৫ হাজার ৮২৭টি আধেয় সরানোর অনুরোধ করেছিল।
আরও পড়ুনইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ ০১ মে ২০২৫গুগল তাদের স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে ব্যবহারকারীর তথ্য চাওয়ার অনুরোধের বিষয়ও প্রকাশ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের তথ্য প্রকাশ করেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ সরকার ২৮টি অনুরোধ জানায়। এর মধ্য ৩০টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। গুগল ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে সাড়া দিয়েছে।
তথ্য ব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে আসছে ডিজিটালি রাইট নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। বছরের শেষার্ধে তথ্য চেয়ে অনুরোধের পরিমাণ কম হওয়া প্রসঙ্গে ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বছরের শেষ ছয় মাসে অনুরোধ কমে আসার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, আগের ছয় মাসে রাজনৈতিক কারণে কনটেন্ট (আধেয়) নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা ছিল।
মিরাজ আহমেদ আরও বলেন, ‘লিগ্যাল রিকোয়েস্ট’কে যাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনে সরকার উপায় হিসেবে ব্যবহার না করে, এ বিষয়ে এখন রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার সময় এসেছে। না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের আইনি ব্যবস্থার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা থেকেই যাবে।
নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে আধেয় অপসারণে বিচারিক তদারকি এবং নিয়মিত তথ্য প্রকাশের যে সুযোগ রাখা হয়েছে, সেটি কেবল নীতিগত অঙ্গীকারে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব প্রয়োগে প্রতিফলিত হওয়া জরুরি বলেও মনে করেন ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আরও পড়ুনতথ্য চেয়ে সরকারের অনুরোধের সঙ্গে বাড়ছে মেটার সাড়াও০৫ ডিসেম্বর ২০২৩.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন র ধ জ ন য় ল দ শ সরক র র অন র ধ র বছর র শ ষ ২০২৪ স ল ব যবস থ সরক র র প রক শ ছয় ম স রক র র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
সোনালী ও রূপালী মুনাফায়, অগ্রণী ও জনতা লোকসানে
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গত বছরের শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে দুটিই বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় দেশের শীর্ষ লোকসানি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি গত বছর শেষে একাই লোকসান করেছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংক লোকসান করেছে ৯৮২ কোটি টাকা।
তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে সোনালী ব্যাংক, গত বছর শেষে ব্যাংকটি মুনাফা করেছে ৯৮৮ কোটি টাকা; আর রূপালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ১১ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ও জনতা মিলে গত বছর শেষে লোকসান করেছে ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। আর সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক মিলে মুনাফা করেছে ৯৯৯ কোটি টাকা। তবে চার ব্যাংকই মন্দঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিজেদের চাহিদামতো ছাড় পেয়েছে। এ কারণে কাগজে–কলমে জনতা ও অগ্রণী লোকসান কিছুটা কম দেখাতে পেরেছে; আর সোনালী ও রূপালীর মুনাফা বেড়েছে। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী, মন্দঋণের বিপরীতে যথাযথ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র আরও খারাপ হতো। ব্যাংক চারটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক মোট ছয়টি। উল্লেখিত চারটির বাইরে বাকি দুটি হচ্ছে–বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল।
নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন এসব ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়লে বিভিন্ন সময় সরকার জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকালে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি সরকারঘনিষ্ঠ আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে ব্যাংকগুলোতে বন্ধ হয়নি অনিয়ম–দুর্নীতি। এখন লোকসানে থাকা জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।
মুনাফায় শীর্ষে সোনালী ব্যাংক
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক কয়েক বছর ধরে তাদের মুনাফার ধারা অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৩৭১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৬৫১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংকের মুনাফা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৮ কোটি টাকায়। ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সোনালী ব্যাংক।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল হল–মার্ক গ্রুপ। এ ঘটনা ছিল সে সময় দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ অনিয়মের সবচেয়ে বড় ঘটনা। তাই দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল হল–মার্ক কেলেঙ্কারি। শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়েছিল। এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ব্যাংকটি পুনর্গঠন শুরু হয়। তাতে ধীরে ধীরে দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের প্রতি আবারও আস্থা ফিরতে শুরু করে আমানতকারীদের।
বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। ২০১২ সালে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঋণের ৩৩ শতাংশই সরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া।
হল-মার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংক তাদের ঋণের গতি কমিয়ে দেয়। কৌশলও পাল্টে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ না দিয়ে ব্যাংকটি সরকারি বিভিন্ন পণ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার বদলে অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে সুদ আয়ের পথ বেছে নেয়। আর তাতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়। বেড়েছে গ্রাহকও। এক যুগ আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিল এক কোটির ঘরে। এখন সেই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের সুদ ও ট্রেজারি খাত থেকে গত বছর আমাদের ভালো আয় হয়েছে। তবে আয়ের ক্ষেত্রে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ট্রেজারি খাতে। আবার অবলোপন করা ঋণ থেকেও ভালো আদায় হয়েছে, যা মুনাফায় যুক্ত হয়েছে। বেসরকারি ঋণের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এরপর মুনাফা এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।’
রূপালী ব্যাংকের মুনাফা কমেছে
রূপালী ব্যাংক ২০২২ সালে ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। ২০২৩ সালে সেই মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকায়। তবে ২০২৪ সালে তাদের মুনাফা কমে ১১ কোটি টাকায় নেমে আসে। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৬৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৪১ শতাংশের বেশি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলে যে পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কথা, তা সংরক্ষণ করতে হলে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ত। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যাংকটিকে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গত বছরের শেষে ব্যাংকটি ১১ কোটি টাকা মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায়।
এ নিয়ে রূপালী ব্যাংকের এমডি কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমে গেছে। এসব ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এখন কম সুদের আমানত এনে ভালো ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
রেকর্ড লোকসানে জনতা ব্যাংক
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জনতা ব্যাংকের। ২০২২ সালে ১১৩ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটি রেকর্ড ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এই লোকসান রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লোকসানের রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্যাংকটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় নিয়েছে। যদিও খেলাপিঋণের বিপরীতে ওই পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো, তাহলে লোকসানও কয়েক গুণ বেড়ে যেত। ব্যাংকটি এই চরম দুর্দশায় পড়েছে বিদায়ী সরকারের মেয়াদে লাগামহীন ঋণ দেওয়ার কারণে, যেসব ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে।
গত মেয়াদে ব্যবসায়ীদের কয়েকজন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাংকটি থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছেন। ফলে ১০টি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ৫৫ শতাংশ ঋণ আটকা পড়েছে। প্রভাবশালী এসব গ্রাহকের দেওয়া বেশির ভাগ ঋণ ফেরত আসছে না, এতে গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যাংকটির পরিস্থিতি এমন নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। কারণ, এসব ঋণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার গ্রাহকদের অনেকেই লাপাত্তা, কেউ জেলে আবার কারও কারখানা বন্ধ।
জনতা ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। রপ্তানি বাণিজ্যতেও শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। সেই ব্যাংক এখন নাজুক পরিস্থিতিতে। কারণ, গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকটিতে। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা আওয়ামীপন্থী পরিচালকেরা। যদিও এসব অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ঋণ ছিল ৯৮ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা গত বছর শেষে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০০ কোটি টাকা। তবে চলতি বছর ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে। তবে গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে আবার ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকও লোকসানে
মুনাফার দিক থেকে অগ্রণী ব্যাংক একসময় ভালো অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালে ব্যাংকটি বড় ধরনের লোকসান করেছে। ২০২২ সালে ১১০ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৬৯ কোটি টাকা মুনাফা করা ব্যাংকটি ২০২৪ সালে ৯৮২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি এবং অদক্ষতাই এই লোকসানের অন্যতম কারণ। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৯৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, ঋণ ছিল ৭৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের মতো অগ্রণী ব্যাংকও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে এখন সংকটে পড়েছে।
ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে নিয়মের বাইরে যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে, এখন তা বেরিয়ে আসছে। নিরাপত্তা সঞ্চিত সংরক্ষণে ছাড় না নিলে ব্যাংকটির লোকসান আরও অনেক বেশি হতো। যদি প্রকৃত লোকসানের চিত্র সবাই জানত, তাহলেই ভালো হতো। এই ব্যাংকের ঋণের অনেক টাকা বাইরে চলে গেছে। এ জন্য ঘুরে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। ব্যাংকটির গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা এখন দেশে আছেন, ব্যবসা চালাচ্ছেন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তাঁদের আরও সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তাহলে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।