ভোরের আলো ফোটার আগেই বাগেরহাটের কেবি বাজারে হইচই। সাগরে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় মাছ ধরে ফিরেছেন জেলেরা। আজ শুক্রবার ভোরে দুটি ট্রলার একসঙ্গে মাছ নিয়ে ঘাটে ভিড়তেই সরব হয়ে ওঠে এলাকার প্রধান সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণকেন্দ্রটি।

নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রথম দিনেই বাজারে ভিড় করেন শত শত মৎস্য ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও আড়তদার। শুরু হয় ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক। মাছের সরবরাহ কম হলেও চাহিদা ছিল অনেক বেশি।

কেবি মৎস্য অবতরণকেন্দ্রটি শহরের দড়াটানা নদীর তীরের বাসাবাটি এলাকায়। জেলেরা সাগর থেকে ধরা মাছ নিয়ে সরাসরি ঘাটে আসেন। এখান থেকেই বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা মাছ কিনে নিয়ে যান।

ভোরে বাজারে দেখা যায়, ঘাটে ভিড়েছে দুটি ট্রলার। সেখান থেকে শ্রমিকেরা ঝুড়িতে করে মাছ তুলছেন। ইলিশ, রুপচাঁদা, ভেটকি, লইট্টা, ছুরি, জাবা, ঢেলা, চ্যালাসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছ উঠেছে বাজারে। তবে বাজারে যে পরিমাণ মাছ এসেছে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে দাম ছিল চড়া।

সাগর থেকে মাছ ধরে ফেরা জেলে রুহুল আমিন বলেন, ‘সাগরে যাওয়ার পরে কয়েকবার জাল ফেলতে পেরেছি। অল্প কিছু ইলিশ পেয়েছি, বাকি সব আজেবাজে মাছ। পরে ট্রলারে সমস্যা হওয়ার কারণে চলে এসেছি।’

মোরেলগঞ্জ থেকে মাছ কিনতে আসা তৈয়ব মুন্সি বলেন, ‘অনেক দিন পর এলাম। দাম বেশি, তবু কিছু মাছ কিনছি। এখন এলাকায় বিক্রি করতে পারলে ভালো হয়।’

আরও পড়ুনসাগরে মাছ ধরায় ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ আজ, সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন১১ জুন ২০২৫

বাজারে ইলিশের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ইলিশ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রুপচাঁদা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এ ছাড়া কঙ্কণ, তুলারডাটি, ঢেলা, চ্যালা, ভেটকি, লইট্টা, ছুরি, জাবাসহ নানা মাছ বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজিতে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধীরে ধীরে ট্রলারের সংখ্যা ও মাছের পরিমাণ বাড়লে দামও স্বাভাবিক হবে।

কেবি বাজারে মাছ বিক্রি হয় সাধারণত ‘পণ’ হিসেবে। এক পোণে ৮০টি মাছ থাকে। আকার অনুযায়ী প্রতি পোণের দাম নির্ধারিত হয়। ক্রেতারা ঢাকের শব্দে বিট দিয়ে মাছ কেনেন।

কেবি বাজার আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনুপ কুমার বিশ্বাস বলেন, অবরোধের পর আজই প্রথম বঙ্গোপসাগর থেকে ট্রলার এসেছে। তেমন মাছ পায়নি। তবে বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পাইকার আসছেন। যার কারণে দাম কিছুটা বেশি। তবে মাছ বেশি হলে দাম কিছুটা কমে আসবে।

উল্লেখ্য, মাছের প্রজনন ও টেকসই আহরণ নিশ্চিত করতে বঙ্গোপসাগরে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এ সময় সাগরে সব ধরনের মাছ ধরা, পরিবহন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল। এর আগে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ছিল ৬৫ দিন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ৫৮ দ ন র মৎস য

এছাড়াও পড়ুন:

কৃষক ঠকানোর ফাঁদ

আমার নিবাস প্রত্যন্ত চলনবিলে। চলনবিলের সর্ববৃহৎ মাছের আড়ত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটিতে। এ আড়তে মাছচাষিরা যখন তাদের উৎপাদিত কষ্টার্জিত মাছ বিক্রি করতে যান, তখন স্থানীয় ভাষায় ‘ঢলতা’র ফাঁদে পড়েন। ‘ঢলতা’ হলো নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে মণপ্রতি কিছু বেশি নেওয়া বা দেওয়া।

মাছের আড়তে ক্রেতা একজন সাধারণ বিক্রেতার কাছ থেকে ৪০ কেজি মাছ কিনতে ৪৪-৪৫ কেজিতে এক মণ ধরেন। এখানে মণপ্রতি ৪-৫ কেজি মাছ বেশি নেওয়া হয়। অতিরিক্ত ৪-৫ কেজি মাছ বেশি নেওয়াকেই ‘ঢলতা’ বলে। এই ঢলতা দেওয়া মহিষলুটি আড়তের প্রায় ২৫ বছরের পুরোনো অভ্যাস। এটা শুধু যে মাছের ক্ষেত্রেই করা হয়, তা নয়। 

উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলায় আমের মণ ৪০ কেজির বদলে ধরা হতো ৫৪ কেজিতে। এখানে ঢলতা প্রথার মাধ্যমে মণে ১৪ কেজি বেশি নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত হয়। এর তিন দিন পরই আড়তদাররা কেজিপ্রতি ৩ টাকা কমিশন দাবি করেন। এতে গত সোমবার থেকে বন্ধ হয়ে গেছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ এ অঞ্চলের আম কেনাবেচা।

মূলত আমের ভরা মৌসুমে আড়তদারের যে কোনোভাবে আমচাষিকে ঠকানোর অনেক কৌশলের মধ্যে এটিও একটি। যারা কেজিতে ৩ টাকা বা মণে ১২০ টাকা আড়তদারদের কমিশন আবদার মেটাতে চাচ্ছেন না, তাদের বাধ্য হয়ে বাজারে আম বিক্রি করতে হয় আগের মতো ৫৪ কেজিতে মণ ধরে। 

এখন আলোচনায় আসি রাজশাহী অঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ে। রাজশাহীর বাঘা শাহি মসজিদ নির্মাণ করা হয় প্রায় ৫০০ বছর আগে। বাঘা মসজিদের দেয়ালে থাকা টেরাকোটায় আছে আমের মোটিফ। কিন্তু এ অঞ্চলের আমবাজারে যুগ যুগ ধরে চলছে ঢলতা প্রথা। আড়তদারদের চতুরতায় মণপ্রতি ১৪ কেজি বেশি নেওয়ার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে দেরিতে হলেও আম অধ্যুষিত উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় আমচাষিদের বোধোদয় হতে শুরু করেছে। আড়তদাররা কেজিতে ৩ টাকা কমিশনের দাবিতে আম কেনাবেচা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে ত্যক্ত-বিরক্ত আমচাষিরা। আর ঢলতার নামে ঠকে যাওয়া নাটোরের আমচাষিদের ভাষ্য, তাদের জেলায়ও প্রশাসন ঢলতা প্রথা বন্ধে বারকয়েক সভা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আম মৌসুমে এ নিয়ে আম ক্রেতা আড়তদাররা বাগড়া ধরলেও সমাধান মেলে না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের আম ক্রেতা আড়তদারদের অহেতুক ও অযৌক্তিক কমিশন আদায় করার প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার আমচাষিরা ‘কৃষক সমিতি’ গঠন করেছেন, যেটা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। বছরের পর বছর ঠকে যাওয়া আমচাষিদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে মৌসুমি আড়তদারদের ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া ঠেকাতে আমচাষি, স্থানীয় প্রশাসনের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

হয়তো কোরবানির ঈদে টানা কয়েক দিন আম বিক্রির অধিকাংশ বাজার বন্ধ থাকায় বিক্রি করা যায়নি। এতে গাছেই পেকে ঝরতে শুরু করেছে হিমসাগর ও লক্ষ্মণভোগ। এ কারণে মঙ্গলবার রাজশাহীর অধিকাংশ চাষি আম নিয়ে ছোটেন বানেশ্বর হাটে। তবে পাইকার কম থাকায় প্রত্যাশা অনুযায়ী তারা দাম পাননি। তাই বলা বাহুল্য, আম নষ্ট হওয়ার আগেই ‘ঢলতা’, ‘কমিশন’ প্রথা বন্ধে কার্যকর প্রশাসনিক সমাধান আশু প্রয়োজন।

এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল, সমকালের তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সরগরম বাগেরহাটের মাছবাজার
  • অর্ধশত বছরের চামড়ার মোকাম রাজারহাট
  • আমের মৌসুমে সরগরম ফলমুন্ডী
  • সাগরে ইলিশ মিলছে কম, চড়া দাম আড়তে
  • চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের বাজারে অস্থিরতা চলছেই
  • রাজশাহী অঞ্চলে কেজি দরে কেউ আম কিনছেন না, চলছে পুরোনো নিয়মে
  • কৃষক ঠকানোর ফাঁদ
  • কোরবানি কমেছে, লবণ মেশানো চামড়ায় ভালো দামের প্রত্যাশা
  • আমে ঢলন নয়, এবার কমিশন