জাতীয় স্বার্থে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রয়োজন
Published: 14th, June 2025 GMT
জুলাই ঘোষণাপত্রকে নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা মনে করা উচিত হবে না। জাতীয় স্বার্থে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রয়োজন। জুলাই বিপ্লবকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হলে ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে দেশে ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করতে হবে। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সভার আয়োজন করে নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে)।
এই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিদেশ সফর মোটেও ভালো লাগেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি আমার আস্থা হারাচ্ছি প্রফেসর ইউনূসের ওপরে। এতগুলো দিন আমি প্রফেসর ইউনূসকে পূজা করতাম। তাঁর পক্ষে সবকিছু বলতাম। কিন্তু আজকে আমি প্রথমবার বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তিনি এখন অন্যদের হাতের পুতুলে পরিণত হতে পারেন।’
শাহীদুজ্জামান মনে করেন, ছাত্ররা যে জীবন দিল, তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হওয়া উচিত নয়। এটা অনৈতিক। আওয়ামী লীগকেও চিরতরে এ দেশ থেকে বের করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টাকে ছাত্রদের বলা উচিত যে তিনি যে পথে যাচ্ছেন, সে পথ তাঁদের না।
এই আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন এনডিজের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, দেশে এমন একটা আবহ তৈরি করা হচ্ছে যেকোনো নির্বাচন দরকার নেই। কিন্তু নির্বাচনের বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংস্কার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিচারও করতে হবে। নিজেদের মধ্যে যেন অনৈক্য তৈরি না হয়। অনৈক্য তৈরি হলে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
জুলাই ঘোষণাপত্র লাগবে উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দীন মাহাদী বলেন, এ বিষয়ে সবাইকে একমত হতে হবে। এ ঘোষণাপত্রকে একটি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা মনে করা হলে পরবর্তী সময়ে যখন কোনো নির্বাচিত সরকার আসবে, তখন এই আন্দোলনকে এবং গণ–অভ্যুত্থানকে যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম আখ্যা দেওয়া হবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
জাতীয় স্বার্থে এই ঘোষণাপত্র প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন আশরাফ উদ্দীন মাহাদী। সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আলোচনায় আসুন। আপনারা বসুন। আমরা সবাই মিলে বসে আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেব, আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে।’
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকে ‘একটি অসম্পূর্ণ বিপ্লব’ হিসেবে দেখছেন উল্লেখ করে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ) প্রধান সমন্বয়কারী রাফে সালমান রিফাত বলেন, ‘এটিকে বিপ্লবে রূপ দিতে হলে প্রক্লেমেশনের মধ্য দিয়ে আইনগতভাবে, সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ এবং আধিপত্যবাদের সব প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এই সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে ‘আয়নাঘরে’ আক্রমণ করেন বলে জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান। তিনি বলেন, আয়নাঘরের সবাইকে মুক্ত করার জন্য দেনদরবার করেন তাঁরা। বিপ্লব এখনো অসমাপ্ত উল্লেখ করে হাসিনুর রহমান বলেন, সংস্কার করে এমন সংবিধান করতে হবে, যাতে জনগণ আর প্রতারিত না হয়।
এই আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন কর্নেল (অব.) জাকারিয়া হোসেন। এ সময় আরও বক্তব্য দেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী, নিউ নেশনের সাবেক সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, জবানের সম্পাদক রেজাউল করিম রনি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, সম্মিলিত নারী প্রয়াসের সেক্রেটারি ফেরদৌস আরা খানম, আইনজীবী শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক প্রমুখ।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।