৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ বা নবম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা থেকে ৬৯০ কিলোমিটার দূরে তাবুক প্রান্তরে যুদ্ধের উদ্দেশে রওনা হন। তাবুক, মদিনা ও দামেস্কের (সিরিয়া) মধ্যবর্তী একটি স্থান। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফের, মুনাফিক ও রোমান সাম্রাজ্যের সম্মিলিত চূড়ান্ত প্রচেষ্টা।
তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি রোমান সাম্রাজ্য মুসলিমদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে চেয়েছিল। এক বছর আগে মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় রোমানদের জন্য অশনিসংকেত হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে আরব ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রোমান শোষণ থেকে মুক্তির চেতনা জাগ্রত হয়। সিরিয়ার রোম-আরব সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মুসলিম শক্তিকে দমন করতে শাম ও আরব সীমান্তে ৪০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেন। (আর-রাহিকুল মাখতুম, সফিউর রহমান মুবারকপুরি, পৃ.
নাবতিদের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) এই প্রস্তুতির খবর পান এবং হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের আগেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মদিনার সব মুসলমানকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন।
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মুসলিম শক্তিকে দমন করতে শাম ও আরব সীমান্তে ৪০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেন।আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫মদিনায় তখন খেজুর পাকার মৌসুম। সময়মতো ফসল না তুললে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিল। খাদ্যাভাব, তীব্র গরম এবং দুর্গম মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তাবুক পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ ছিল। যুদ্ধের রসদও ছিল অপ্রতুল। এমন পরিস্থিতিতে বিশাল রোমান বাহিনীর মোকাবিলা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ৪/৬০০, সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৬০)
রাসুলপ্রেমী সাহাবিরা সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে অবদান রাখেন। উসমান ইবনে আফফান (রা.) সিরিয়ায় ব্যবসায়িক কাফেলার জন্য প্রস্তুত ২০০টি সুসজ্জিত উট (বর্তমান মূল্যে সাড়ে ১৯ কেজি রৌপ্য), ১০০টি খাদ্য-রসদে সজ্জিত উট, ১০০ দিনার (প্রায় ৫ কেজি স্বর্ণ), ৯০০টি উট ও ১০০টি ঘোড়া দান করেন।
আবু বকর (রা.) ঘরের সব সম্পদ, ৪০০ দিরহাম নিয়ে নবীজির দরবারে হাজির হন। ওমর (রা.) অর্ধেক সম্পদ দান করেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ২০০ উকিয়া (১ উকিয়া সমান ৪০ রৌপ্য মুদ্রা) রৌপ্য নিয়ে আসেন। আব্বাস (রা.), তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.), সাদ ইবনে উবাদা (রা.), মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা (রা.) নিজেদের সাধ্যের সবটুকু দান করেন। আসিম ইবনে আদি (রা.) সাড়ে ১৩ হাজার কেজি খেজুর দান করেন। কেউ কেউ দুয়েক মুষ্টি খাবার, নারীরা গলার হার, ঝুমকা, পায়েল ও আংটি দান করেন।
কেউ কেউ দুয়েক মুষ্টি খাবার, নারীরা গলার হার, ঝুমকা, পায়েল ও আংটি দান করেন।আরও পড়ুনযুদ্ধ থামুক, আসুক সরল আলো২৫ ডিসেম্বর ২০২৪রাসুলুল্লাহ (সা.) ৩০ হাজার সাহাবির কাফেলা নিয়ে তাবুকের উদ্দেশে রওনা হন। মদিনায় মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা বা সিবা ইবনে উরফুতা (রা.)-কে স্থলাভিষিক্ত এবং আলী (রা.)-কে পরিবারের দায়িত্ব দেন। হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের খবর পেয়ে যুদ্ধ না করে পালিয়ে যান। আল্লাহ বিনা যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় দান করেন।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা, তোমাদের হয়েছে কী যে যখন তোমাদের আল্লাহর পথে বের হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তোমরা আরও জোরে মাটি কামড়ে ধরো। তোমরা কি আখিরাতের স্থলে দুনিয়ার জীবনকেই বেশি পছন্দ করো? আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগের সামগ্রী তো অতি সামান্য।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ৩৮-৩৯)
সাহাবিদের এই ত্যাগ ও ভালোবাসা ইসলামের ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
লেখক: আলেম
আরও পড়ুনবদর যুদ্ধ: ইতিহাসের বাঁক বদলের ঘটনা১৭ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ ন কর ন প রস ত ত ম নদ র ম সলম
এছাড়াও পড়ুন:
গুলিতে দৃষ্টি হারালেও স্বপ্ন হারায়নি হিমেল, দেখতে চায় স্বাধীন বাংলাদেশ
ছবি-২: মায়ের কাঁধে ভর করে টাঙ্গাইলের একটি অনুষ্ঠানে যেতে বাড়ি থেকে বের হয় দৃষ্টি হারানো হিমেল। তাঁদের বিদায় জানান হিমেলের ভাই মো. জনি মিয়া। আজ মঙ্গলবার সকালে মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের লালবাড়ী গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
গুলিতে দৃষ্টি হারালেও স্বপ্ন হারায়নি হিমেল, দেখতে চায় স্বাধীন বাংলাদেশ
প্রতিনিধি,
গত বছরের ৪ আগস্ট টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গোড়াই হাইওয়ে থানা ঘেরাওয়ের সময় পুলিশের গুলিতে চোখের দৃষ্টি হারায় হিমেল ইসলাম (১৬)। চিকিৎসকেরা তাকে ও তার পরিবারকে জানিয়েছেন, সে আর কখনো চোখে দেখতে পারবে না।
তবু চোখে স্বপ্ন আছে হিমেলের—আবার সুন্দর করে বাঁচার, আবার স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখার। মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে এমনটাই বলল হিমেল।
উপজেলার লালবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খাটের ওপর বসে আছে হিমেল। তার মা নাছিমা বেগম ও বড় ভাই মো. জনি মিয়া (২৫) তাকে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন টাঙ্গাইলের শিল্পকলা একাডেমিতে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ছেলের চোখ হারানো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন নাছিমা বেগম। তিনি বলেন, তাঁর পরিবারে মা, দুই ছেলে, বড় ছেলের স্ত্রী ও এক নাতি আছে। প্রায় ১৫ বছর আগে স্বামী আফাজ উদ্দিন তাঁদের ফেলে অন্যত্র চলে যান। এরপর থেকে নাছিমা বেগমের জীবনে নামে দুর্ভোগ। ছেলেদের নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে থাকেন। বড় ছেলে জনি ১৩-১৪ বছর বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে শ্রমিকের কাজ শুরু করে। হিমেলও ১২-১৩ বছর বয়সে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় এক ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করত।
গত বছরের ৪ আগস্ট গোড়াই হাইওয়ে থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেয় হিমেল। সে সময় তার চোখ, মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগে। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসার পর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এক সপ্তাহ পর ছুটি দেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, সে আর চোখে দেখতে পারবে না। পরে চোখের ক্ষত না শুকানোয় হিমেলকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। এখন নিয়মিত তাকে সিএমএইচে চিকিৎসা নিতে হয়।
নাছিমা বেগম বলেন, ‘আমার বয়স হইছে। এখন আর কাজ করতে পারি না। বড় ছেলেডা এক ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে, ১০ হাজার টাকা বেতন পায়। তা দিয়্যা ছেলে, বউ, মা আর নাতি নিয়া খুব কষ্টে দিন কাটাইতাছি।’
হিমেলের ভাই জনি মিয়া বলেন, ‘আমি উত্তরা স্পিনিং মিলে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। সংসারে ছয়জন মানুষ নিয়া খুব কষ্টে চলি। আল্লায় ভাইডারে যদি ভালো কইর্যা দিত, তাইলে আগের মতো কাজ করা পারত। আমাগো সবাই ভালো কইর্যা চলতে পারতাম।’
হিমেল ইসলাম বলে, ‘আমি ৫ আগস্টের আগে পড়ালেখা করতাম। ক্লাস নাইনের ছাত্র ছিলাম। ডেকোরেশনের কাজ করতাম। এখন আমার চোখে গুলি লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। আগস্টের ৪ তারিখে আন্দোলনে যোগ দিই। হাইওয়ে থানায়। থানা থেকে আমাদের গুলি করে। আহত অনেকের মধ্যে আমি একজন। আমার সারা মুখে এখনো বুলেট আছে। এই বুলেটে আমার অনেক ক্ষতি হয়। দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার পরিবারের অনেক কষ্ট এখন। এখন আমার চাওয়া একটাই—আবার আমি সুন্দর করে বাঁচতে চাই; স্বাধীন বাংলাদেশ আবার দেখতে চাই।’
নাছিমা বেগম জানান, সরকারিভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং রাজনৈতিক দল ও কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছেন। এর সবই হিমেলের চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে।
এদিন হিমেলকে নিয়ে টাঙ্গাইলের পথে রওনা দেন মা নাছিমা বেগম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ভাই জনি মিয়া হিমেলের পায়ে জুতা পরিয়ে দেন, ময়লা মুছে দেন। এরপর গাড়িতে তুলে দেন মা ও ভাইকে।