মুন্সিগঞ্জে মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ধাওয়া দিয়েছেন কয়েক শ গ্রামবাসী। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সদর উপজেলার চর আবদুল্লাহ ও কাউয়াদি এলাকায় দুই দফায় এ ঘটনা ঘটে। এতে স্থানীয় গ্রামবাসী ও অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শাহাদাত হোসেন সরকার, স্থানীয় কিবরিয়া মিজি ও বিএনপি নেতা লিটন মিজির লোকজন ইজারা এলাকার বাইরে ফসলি জমি ঘেঁষে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ গ্রামবাসীর।

প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন সরকার, কিবরিয়া মিজি ও লিটন মিজিরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তাঁরা নিজেদের বাহিনী দিয়ে আজ সকালে চর আবদুল্লাহ এলাকায় শতাধিক ড্রেজার নিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে বালু উত্তোলন শুরু করেন। এতে স্থানীয় গ্রামবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কর্ণপাত না করে উল্টো ভয়ভীতি দেখিয়ে বালু উত্তোলন করতে থাকেন। সকাল ৯টার দিকে চর আবদুল্লাহ এলাকার বাসিন্দারা একত্র হয়ে ট্রলারযোগে লাঠিসোঁটা নিয়ে বালু উত্তোলনকারীদের ধাওয়া দেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। একপর্যায়ে চর আবদুল্লাহ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা। পরে সকাল ১০টার দিকে ড্রেজার নিয়ে পাশের কাউয়াদি গ্রামে যায় চক্রটি। সেখানেও তারা নদীর তীরবর্তী ফসলি জমির পাশে বালু উত্তোলন শুরু করে। পরে ওই গ্রামের লোকজন একত্র হয়ে তাদের ধাওয়া করেন।

কাউয়াদি গ্রামের নেকমত ব্যাপারী বলেন, ‘আমাদের গ্রামের সব জমি তিন ফসলি। কিছু জমি আছে তাতে বর্ষাতেও পানি ওঠে না। জমিগুলোও খুব উর্বর। আমাদের গ্রামের মানুষের মূল পেশা কৃষিকাজ। অথচ বিএনপি নেতা ও নৌ–ডাকাতদের চক্রটি অবৈধভাবে আমাদের জমি ঘেঁষে বালু লুট শুরু করে। আমরা বাধা দিলে উল্টো আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।’

স্থানীয় কৃষক মোতালেব ব্যাপারী বলেন, কোরবানির ঈদের আগে ১০ থেকে ১৫ দিন তাঁদের জমি ঘেঁষে বালু কেটেছে চক্রটি। ঈদের পর আবার শুরু করেছে। এভাবে কাটতে থাকলে তাঁদের জমি, বাড়িঘর সব ভেঙে যাবে। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।

অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন সরকার বলেন, ‘বৈধভাবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বালুমহাল ইজারা নিয়েছি। প্রশাসন যেখানে দেখিয়েছে, সেসব এলাকায় আমরা নিয়ম মেনে বালু তুলি। তবে দীর্ঘদিন অবৈধভাবে আওয়ামী সরকারের লোকজন ওই এলাকায় বালু তুলছিল। তখন স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে নিয়মিত টাকাপয়সা দিত। আমরা বৈধভাবে নেওয়ায় তাঁদের টাকাপয়সা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এ কারণে ওই লোকগুলো সাধারণ মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে আমাদের বিপক্ষে অবস্থান করিয়েছে। আমরা কোনো স্থান থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করিনি।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে মধ্যচর রমাজানবেগ মৌজার ১৫০ একর নদীতে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। বালুমহালটি ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৯ টাকায় ইজারা পেয়েছেন মেসার্স সম্রাট ট্রেডার্সের মালিক বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন। ভাষানচর মৌজার ১৫০ একরের বালুমহাল ৮ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয় মেসার্স মনির এন্টারপ্রাইজের মালিক জি এস মনির হোসেনকে। তবে দুটি বালুমহালে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাহাদাত হোসেন সরকার, কিবরিয়া মিজি ও লিটন মিজিরা। দুটি প্রতিষ্ঠানকে নদীর ৮০০ ফুট গভীরে বালু উত্তোলনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। তবে কোনো শর্ত না মেনেই নদীর তীর ও ইজারার বাইরের এলাকায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দীর্ঘদিন বালুমহাল ইজারার নামে অবৈধভাবে বালু কেটেছেন আওয়ামী লীগের লোকজন। যার কারণে কৃষকের অনেক জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন বিএনপির লোকজন বেশি বেপরোয়া হয়ে বালু কাটা শুরু করেছেন। যাঁরা বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত তাঁরা ব্যাপক ক্ষমতাবান। এ জন্য ইজারা এলাকার বাইরে ফসলি জমি ঘেঁষে বালু উত্তোলন করছে। প্রশাসন এখনই ব্যবস্থা না নিলে ফসলি জমিসহ মেঘনা তীরবর্তী গ্রামের বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।

মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমাতুল জান্নাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি ইতিমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি। ইজারার সুযোগ নিয়ে ইজারার বাইরে গিয়ে ফসলি জমি ও মানুষের ক্ষতি করে যদি কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে তাঁদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ হ দ ত হ স ন সরক র নদ র ত র গ র মব স অব ধ ব ল র ল কজন ইজ র র আম দ র এল ক য় ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

‘আল–কাহহার’: অপরাজিত প্রভুত্ব শুধু আল্লাহর

যখন আকাশের বিশালতা থরথর করে কাঁপে, পাহাড়ের গর্বিত শিখর নত হয়, তখন একটি নাম হৃদয়ের গভীরে শিহরণ জাগায়, সেটি হলো আল–কাহহার। তিনি আল্লাহ, যিনি সৃষ্টির প্রতিটি কণাকে তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সামনে কোনো শক্তি টিকে না, কোনো অহংকার টেকে না।

তিনি সেই সত্তা, যিনি অত্যাচারীদের ধূলিসাৎ করেন, মৃত্যুর মাধ্যমে সবাইকে নতজানু করেন এবং তাঁর ইচ্ছায় বিশ্বচরাচর পরিচালিত হয়। আল–কাহহার নামটি শুধু তাঁর শক্তির প্রকাশ নয়; বরং আমাদের জীবনকে আলোকিত করার এক আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ। আসুন, এই নামের গভীর তাৎপর্যে ডুব দিই, যা আমাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঞ্চার করে।

আল–কাহহার আল্লাহর সেই গুণ, যা তাঁর সর্বোচ্চ প্রভুত্ব ও অপরিমেয় ক্ষমতার কথা বলে। তিনি সেই সত্তা, যাঁর হাতে সমগ্র সৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত।

বলো, বিভিন্ন ইলাহ ভালো, না একক, অপ্রতিরোধ্য আল্লাহ?সুরা রাদ, আয়াত: ১৬

পবিত্র কোরআনে এ নামটি ছয়বার উল্লেখিত হয়েছে এবং প্রতিবারই এটি তাঁর আল–ওয়াহিদ নামের সঙ্গে জুড়ে এসেছে। সুরা আর–রাদে বলা হয়েছে, ‘বলো, বিভিন্ন ইলাহ ভালো, না একক, অপ্রতিরোধ্য আল্লাহ?’ (আয়াত: ১৬)

আবার সুরা ইবরাহিমে বলা হয়েছে, ‘এবং তারা সবাই একক, অপ্রতিরোধ্য আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে।’ (আয়াত: ৪৮)

এই আয়াতগুলো আমাদের হৃদয়ে গেঁথে দেয় যে তিনি একক এবং তাঁর ক্ষমতার সামনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তিনি সেই সত্তা, যাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই ঘটে না।

আরও পড়ুন‘আল-ওয়াহিদ’ আল্লাহর অনন্য নাম২৩ জুন ২০২৫

ইমাম খাত্তাবি (রহ.) বলেন, ‘আল–কাহহার তিনি, যিনি অহংকারীদের শাস্তির মাধ্যমে নত করেন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সব সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর মহিমার সামনে সবকিছু অসহায়।’ (আল–সালাবি, কিসসাতু বাদ’ইল খালক, পৃ. ১১৩৬)

তিনি সেই সত্তা, যাঁর ক্ষমতা কোনো সীমার মধ্যে বাঁধা নয়। পবিত্র কোরআন বলে, ‘কোনো প্রাণী নেই, যার কপাল তাঁর হাতে নেই। তাঁর হুকুম তাতে চলে এবং তাঁর ফয়সালা তাতে ন্যায়পরায়ণ।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৫৬)

এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিছুই নেই—না আমাদের জীবন, না আমাদের মৃত্যু।

আল–কাহহার ও আল–ওয়াহিদ নামের সংযোগ একটি অপূর্ব সত্য উন্মোচন করে। আল্লাহর একত্ব তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘যিনি সবকিছুর ওপর অপ্রতিরোধ্য, তিনিই একক। ক্ষমতা ও একত্ব একে অপরের পরিপূরক। দুটি সমান ক্ষমতাশালী সত্তা কখনোই থাকতে পারে না।’ (তারীকুল হিজরাতাইন, পৃ. ২৩৩)

আল–কাহহার তিনি, যিনি অহংকারীদের শাস্তির মাধ্যমে নত করেন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সব সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর মহিমার সামনে সবকিছু অসহায়।ইমাম খাত্তাবি (রহ.), কিসসাতু বাদ’ইল খালক, পৃ. ১১৩৬

পৃথিবীর রাজারা তাদের সেনাবাহিনী ও সমর্থকদের দ্বারা ক্ষমতা প্রয়োগ করে, কিন্তু আল্লাহ তাঁর একক সত্তায়, কারও সাহায্য ছাড়াই সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি সেই সত্তা, যাঁর কাছে সবাই নতজানু, যিনি কোনো সাহায্যকারীর মুখাপেক্ষী নন।

আল্লাহর এই ক্ষমতা শুধু শাস্তি বা ধ্বংসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে একটি অপূর্ব ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তিনি বাতাস সৃষ্টি করেছেন, যা একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি পানি সৃষ্টি করেছেন, যাকে বাতাস প্রভাবিত করে। তিনি আগুন সৃষ্টি করেছেন, যাকে পানি নিভিয়ে দেয়। তিনি লোহা সৃষ্টি করেছেন, যাকে আগুন গলিয়ে দেয়। তিনি পাথর সৃষ্টি করেছেন, যাকে লোহা ভেঙে দেয়।’ (তারীকুল হিজরাতাইন, পৃ. ২৩৩)

এই ভারসাম্য তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার প্রমাণ। তিনি সৃষ্টির প্রতিটি উপাদানকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন, যেন প্রতিটি তাঁর ইচ্ছার অধীনে থাকে।

আরও পড়ুনআল্লাহর ‘আল মুমিন’ নামের মহিমা১৮ জুন ২০২৫

তবে আল্লাহর এই অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে অস্বীকার করে না। তিনি আমাদের পছন্দের স্বাধীনতা দিয়েছেন, যার জন্য আমরা জবাবদিহি করব। আমরা যখন কোনো কাজ করি, যেমন ভ্রমণের পরিকল্পনা, খাওয়া বা বিশ্রাম, তখন আমরা তা নিজেদের ইচ্ছায় করি। এই স্বাধীনতা আমাদের দায়িত্বশীল করে। ‘তিনি অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু তিনি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন। আমাদের কাজ আমাদের পছন্দের ফল।’ (মা’আল্লাহ, সালমান আওদাহ, পৃ. ১০৭)

এই সত্য আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদেরকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহির প্রতি সচেতন করে।

পবিত্র কোরআনে এ নামটি ছয়বার উল্লেখিত হয়েছে এবং প্রতিবারই এটি তাঁর আল–ওয়াহিদ নামের সঙ্গে জুড়ে এসেছে।

আল–কাহহার নামটি আমাদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভীতি জাগায়। যখন আমরা জীবনের ঝড়ে হতাশ হই, তখন এ নামটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে তিনিই আমাদের একমাত্র আশ্রয়। তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা আমাদের শেখায় যে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর ইচ্ছার অধীনে। আমরা যখন তাঁর এই নামের প্রতি চিন্তা করি, তখন আমাদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও বিনয় আরও গভীর হয়। তিনি আমাদের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক এবং আমাদের একমাত্র উপাস্য।

এ নামটি আমাদের জীবনে একটি আলোকবর্তিকা। তিনি আমাদের শেখান যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করা আমাদের কর্তব্য। তাঁর ক্ষমতার সামনে আমরা নতজানু হই, তাঁর প্রভুত্বের সাক্ষ্য দিই। তিনি আল–কাহহার, যিনি অপ্রতিরোধ্য, একক ও অতুলনীয়। তাঁর মহিমার কাছে আমাদের হৃদয় নুয়ে পড়ে এবং আমরা তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমে শান্তি খুঁজে পাই।

সূত্র: আল–জাজিরা ডট নেট। অনুবাদ: মনযূরুল হক

আরও পড়ুনইসমে আজমের শক্তি ও রহস্য৩০ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ