প্রতিবছর ২০ জুন পালিত হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বিশ্বজুড়ে বসবাসরত শরণার্থীদের প্রতি সৌহার্দ্য প্রকাশ করা। সৌহার্দ্য মানে কেবল তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই নয়, বরং ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা। শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন তারা মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে কঠিন জীবনযাপনরত শরণার্থীদের এ–ও বোঝানো যে তারা একা নয়, সারা বিশ্ব তাদের সঙ্গে আছে।

পুরো পৃথিবীতে অবস্থিত শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্ব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানুষ ভাগাভাগি করে নিলেও আমরা পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে পৃথিবীর অধিকাংশ (প্রায় ৭৩ শতাংশ) শরণার্থীর আশ্রয় হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এই দেশগুলোর অনেকেই তাদের নিজ নিজ উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘ সময় ধরে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবন বলতে গেলে একটি হতাশাময়, মর্যাদাহীন, পরিচিতির সংকট এবং অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে কাটে। কেননা আমরা যতই সারা বিশ্বের মানুষের সাহায্য–সহযোগিতার কথা বলি না কেন, শরণার্থীদের সমস্যার তুলনায় সেই সাহায্য ও সহযোগিতা অপ্রতুল। মৌলিক চাহিদার কিছুটা পূরণের মাধ্যমে শরণার্থীদের সমস্যার কিছু সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা তাদের প্রধান সমস্যা বিশেষ করে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে বেশির ভাগ সময় ব্যর্থ হচ্ছে।

বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনও এমনই। আমরা জানি যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসবাস বেশ পুরোনো। ২০১৭ সালে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের প্রবেশ করেছে, তাদের বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করেনি। ফলে তারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যদিও বাংলাদেশ সরকার তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রধান যে সমস্যা, অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টির কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ফলে তাদের জীবনের দুর্দশা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর দশটা সাধারণ মানুষের যে জীবন, সে জীবন একজন শরণার্থীর নেই। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও নেই, ফলে তাদের অনেক চাহিদাই অপূর্ণ থেকে যায়।

এই দুর্দশা থেকে শিশুদেরও মুক্তি নেই। একটা প্রজন্ম বড় হচ্ছে জাতিগতভাবে পরিচিতির সংকট নিয়ে। এদের সঙ্গে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে জন্ম নেওয়া প্রায় ৩০ হাজার শিশু। এমন লাখ লাখ শিশু কোনো ধরনের আধুনিক সুযোগ–সুবিধা ছাড়াই বড় হচ্ছে। এরা না পাচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, না তারা সামনে দেখতে পাচ্ছে কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। মা–বাবার জন্য এক বড় কষ্টের বিষয় হলো, সন্তানদের একটি দিগ্‌ভ্রান্ত এবং সামাজিক ও জাতীয় পরিচয়হীন অবস্থায় বড় হতে দেখা। এক বিষাদময় ও হতাশাগ্রস্ত প্রজন্ম বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই মানবিক দায় কি কেবলই আমাদের? বিশ্বসভ্যতা কি কিছুই করবে না তাদের জন্য? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কোথায় খুঁজব। যদিও শরণার্থীদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিতে জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর এক বক্তব্যে উন্নত দেশগুলোর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, তারপরও আমরা দেখছি সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থীদের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতার পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রবণতা। এর প্রভাব অবধারিতভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পড়বে এবং পড়ছে।

রোহিঙ্গা সংকটকে আরও জটিল করে তোলার পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে আরাকান আর্মির দখল ও মিয়ানমারের মিলিটারি জান্তার সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা। রাখাইনে অবস্থিত বাকি রোহিঙ্গারাও নিরাপত্তার অভাব ও জীবন বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। এমন একটা জটিল পরিস্থিতিতে রাখাইনে অবস্থিত জনগোষ্ঠীর জন্য সাহায্য পাঠাতে মানবিক করিডর বা প্যাসেজ বা চ্যানেলের মতো নানাবিধ বিভ্রান্তিমূলক আলাপ-আলোচনাও আমরা বিগত কয়েক মাসে দেখেছি, যা প্রকৃত অর্থে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি।

আমরা যদি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে মানবিক করিডরের উদাহরণ দেখি তাহলে দেখতে পাই যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সহিংসতার মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করে শরণার্থী হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে। ইতিমধ্যেই নির্যাতনের শিকার হয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাই বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলার কোনো বিকল্প নেই। অথচ রোহিঙ্গা সংকটের এত বছর হয়ে যাওয়ার পরও আমরা এ বিষয়ে কোনো বিশদ কর্মপরিকল্পনা ও নীতিমালা দেখিনি।

শরণার্থীবিষয়ক নীতি বা পলিসি প্রণয়ন এখন বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি বিষয়, কেননা সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারত থেকেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ঠেলে পাঠানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশের শরণার্থীবিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীসহ সব ধরনের শরণার্থী জনগোষ্ঠীর যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা উচিত।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের যেহেতু কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না, তাদের জীবনযাপনকে আরও মর্যাদাপূর্ণ করে তোলার কাজ করাই শ্রেয়। একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার জন্য কেবলমাত্র মৌলিক চাহিদার কিছু কিছু মেটানোই যথেষ্ট নয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

এই শিক্ষা বলতে আমরা কেবলমাত্র অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলছি না বরং এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে শরণার্থীদের সন্তানেরাও উচ্চশিক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয়েও যাওয়ার সুযোগ পায়। তাই তাদের কেবলমাত্র জনবিস্ফোরণের একটি উদাহরণ বা দেশের জন্য বোঝা হিসেবে বিবেচনা না করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোর দিকে নজর দিতে হবে।

কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাদের আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় ফলে তারা যখন দেশে ফেরত যাবে সেই দক্ষতা তারা কাজে লাগাতে পারবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে পরিকল্পনায় এর সঙ্গে স্থানীয়দেরও জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একটি কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। তা না হলে স্থানীয়দের মধ্যেও হতাশা কাজ করবে।

ইতিমধ্যেই আমরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখেছি, দীর্ঘ সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে থাকার কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যেমন সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি সম্পর্ক ২০১৭ সালে ছিল, তা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। এবং স্থানীয়রা এখন আর রোহিঙ্গাদের ইতিবাচক চোখে দেখছে না। পারস্পরিক সম্পর্কের বাইরেও রোহিঙ্গাদের স্থানীয় মিডিয়াতে ‘ডেমোনাইজড’ বা নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও নেতিবাচক দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমরা এটাও দেখছি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনেকেই নানাবিধ বেআইনি কাজেও যুক্ত হচ্ছে। এতে করে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মধ্যকার যে ইতিবাচক সহাবস্থানের প্রত্যাশা আমরা করি, তা ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্যকে আমরা রোহিঙ্গাদের প্রেক্ষাপটে কতটা বাস্তবায়ন করতে পারছি, তা একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে যাবে। আমরা দিন দিন দেখছি এই খাতের আর্থিক সহায়তা কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের সেবা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে। ধনী ও প্রভাবশালী দেশগুলো আরও ইতিবাচকভাবে এগিয়ে না এলে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের পরিবর্তন বেশ কঠিন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেন্দ্র করে ভূরাজনীতির অবসান নিয়েও জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থাসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর এগিয়ে আসতে হবে, তা না হলে শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য কেবলই ফাঁকা বুলি হিসেবেই থেকে যাবে।

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শরণ র থ দ র স জনগ ষ ঠ র দ র জ বন র সমস য ব যবস থ র জন য ক জ কর সহয গ ও আমর অবস থ বসব স

এছাড়াও পড়ুন:

সত্য আড়াল করার চেষ্টা ছিল

সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে—এ সত্য আড়াল করার চেষ্টা ছিল পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বেশির ভাগ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এর পরিবর্তে ছাত্র-জনতাকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী’ এবং আন্দোলনকে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা ছিল।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর ভাষায় ‘উসকানি’, ‘দুষ্কৃতকারী’ ও ‘বিরোধী চক্রান্ত’—এ ধরনের শব্দ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার যেসব যুক্তি দিত এবং যে ভাষায় কথা বলত, তার প্রতিফলন দেখা গেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে।

গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক এসবির ১৬টি প্রতিবেদন নানা মাধ্যমে পেয়েছে প্রথম আলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি এসবির প্রতিবেদনে সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীদের মারমুখী ভূমিকা ও অস্ত্রবাজির বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্টো আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে তৎকালীন সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষে যাতে সংবাদমাধ্যমগুলো জনমত তৈরি করে—এমন পরামর্শও দিয়েছিলেন এসবির গোয়েন্দারা।

যেমন গত বছরের ৪ আগস্ট এসবির গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দলবদ্ধভাবে ও অধিক সংখ্যায় অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ৩১ জুলাইয়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঠে সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

এসবির মাধ্যমেই পুলিশ দেশের সামগ্রিক চিত্র, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। এসবির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনগুলো প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যায়। এ জন্য সরকার অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি এসবির গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

ওই সময়কার গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো গত জুন ও জুলাই মাসের শুরুর দিকে বিশ্লেষণ করেছে এসবির বর্তমান প্রশাসন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে রাজনৈতিক ইন্ধনপ্রাপ্ত, বিএনপি-জামায়াতের সরকার পতনের ষড়যন্ত্র—এভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আন্দোলনের মূল দাবির জায়গা বা ছাত্রসমাজের ন্যায্য ক্ষোভের যৌক্তিকতার চেয়ে নাশকতা-সহিংসতার আশঙ্কা, সরকারি স্থাপনায় আক্রমণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের নিরাপত্তা—এসবে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।

এসবির বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে, সংলাপ, আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বা দাবির ন্যায্যতা তুলনামূলকভাবে কম এসেছে ওই সময়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে। কিছু ক্ষেত্রে আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হলেও সেটি আন্দোলন দমন বা নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে এসেছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনগুলোতে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের গুরুত্ব, জনগণের ক্ষোভ বা সমবেদনার জায়গা উপেক্ষিত হয়েছে।

এসবির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ওই সময়কার গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে আন্দোলন চলাকালে বিপরীত বয়ান (কাউন্টার ন্যারেটিভ) তৈরির পরামর্শও দেওয়া হতো। ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ গড়ে তোলার জন্য তৎকালীন সরকার যাতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, সে সুপারিশ ছিল।

এসবির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে ওই সময়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করায় বাস্তব পরিস্থিতি মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছিলেন তৎকালীন কর্মকর্তারা। পেশাদারত্বের সঙ্গে নির্মোহভাবে কাজ না করলে তা কারও জন্যই সুফল বয়ে আনে না।’

এসবির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ওই সময়কার প্রতিবেদনগুলোতে মাঠের বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়েছে।

শেষ দিকে শঙ্কায় ছিলেন গোয়েন্দারা

এসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, তৎকালীন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমননীতির কারণে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দ্রুত ব্যাপকতা লাভ করে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, পেশাজীবী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষ তাতে যুক্ত হন। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দ্রুতই আন্দোলনে নতুন নতুন শ্রেণি ও শক্তি যুক্ত হয়।

কিন্তু তৎকালীন গোয়েন্দারা আন্দোলনের ব্যাপকতার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আন্দোলনকারীদের ‘বহিরাগত’, ‘রাজনৈতিক অপশক্তি’ এবং ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছে।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে ‘গণভবন, বঙ্গভবন, সচিবালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ইত্যাদি দখলের চেষ্টা হতে পারে’—এমন ইঙ্গিত ছিল ওই সময়কার গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

গত বছরের ৫ জুন থেকে ২০ জুলাইয়ের প্রতিবেদনগুলো আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করেছে এসবির বর্তমান প্রশাসন। এতে দেখা যায়, ওই সময় গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ ছিল, আন্দোলন দমন না করলে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সুযোগ নিতে পারে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন তখনকার গোয়েন্দারা।

গত বছরের ২১ জুলাই থেকে ৪ আগস্টের প্রতিবেদনগুলোতে গণগ্রেপ্তার ও দমননীতির বিষয়গুলো উঠে এসেছে। তবে ওই সময়ের প্রতিবেদনে পরিস্থিতি দ্রুত ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ রূপ নিতে পারে, সরকার পতনের চেষ্টা হতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল ভেঙে যেতে পারে—এসব বিষয় স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে। শেষ দিকের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ক্রমে সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হবে—এমন আভাস দেওয়া হয়েছিল।

একপেশে প্রতিবেদন, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব

এসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অধিকাংশ প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, হতাহতের ঘটনা, গণগ্রেপ্তার, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া—এসব বিষয় খুব কমই গুরুত্ব পেয়েছে। আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের প্রতি প্রতিবেদনগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্টতই একপেশে।

এসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অনেক প্রতিবেদনে আন্দোলনের প্রকৃত উৎস বা সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভকে সেভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাধারণ অভিভাবক—এসব গোষ্ঠীর ন্যায্য অংশগ্রহণকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করার প্রবণতা থাকায় স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনকে পুরোপুরি অনুধাবন করা যায়নি বলেও এসবির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কোনো বিকল্প নেই। নিয়মনীতি মেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশ বর্তমানে সচেষ্ট রয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ