বিশ্ব শরণার্থী দিবস ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট
Published: 20th, June 2025 GMT
প্রতিবছর ২০ জুন পালিত হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বিশ্বজুড়ে বসবাসরত শরণার্থীদের প্রতি সৌহার্দ্য প্রকাশ করা। সৌহার্দ্য মানে কেবল তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই নয়, বরং ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা। শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন তারা মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে কঠিন জীবনযাপনরত শরণার্থীদের এ–ও বোঝানো যে তারা একা নয়, সারা বিশ্ব তাদের সঙ্গে আছে।
পুরো পৃথিবীতে অবস্থিত শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্ব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানুষ ভাগাভাগি করে নিলেও আমরা পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে পৃথিবীর অধিকাংশ (প্রায় ৭৩ শতাংশ) শরণার্থীর আশ্রয় হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এই দেশগুলোর অনেকেই তাদের নিজ নিজ উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘ সময় ধরে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবন বলতে গেলে একটি হতাশাময়, মর্যাদাহীন, পরিচিতির সংকট এবং অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে কাটে। কেননা আমরা যতই সারা বিশ্বের মানুষের সাহায্য–সহযোগিতার কথা বলি না কেন, শরণার্থীদের সমস্যার তুলনায় সেই সাহায্য ও সহযোগিতা অপ্রতুল। মৌলিক চাহিদার কিছুটা পূরণের মাধ্যমে শরণার্থীদের সমস্যার কিছু সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা তাদের প্রধান সমস্যা বিশেষ করে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে বেশির ভাগ সময় ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনও এমনই। আমরা জানি যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসবাস বেশ পুরোনো। ২০১৭ সালে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের প্রবেশ করেছে, তাদের বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করেনি। ফলে তারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যদিও বাংলাদেশ সরকার তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রধান যে সমস্যা, অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টির কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ফলে তাদের জীবনের দুর্দশা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর দশটা সাধারণ মানুষের যে জীবন, সে জীবন একজন শরণার্থীর নেই। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও নেই, ফলে তাদের অনেক চাহিদাই অপূর্ণ থেকে যায়।
এই দুর্দশা থেকে শিশুদেরও মুক্তি নেই। একটা প্রজন্ম বড় হচ্ছে জাতিগতভাবে পরিচিতির সংকট নিয়ে। এদের সঙ্গে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে জন্ম নেওয়া প্রায় ৩০ হাজার শিশু। এমন লাখ লাখ শিশু কোনো ধরনের আধুনিক সুযোগ–সুবিধা ছাড়াই বড় হচ্ছে। এরা না পাচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, না তারা সামনে দেখতে পাচ্ছে কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। মা–বাবার জন্য এক বড় কষ্টের বিষয় হলো, সন্তানদের একটি দিগ্ভ্রান্ত এবং সামাজিক ও জাতীয় পরিচয়হীন অবস্থায় বড় হতে দেখা। এক বিষাদময় ও হতাশাগ্রস্ত প্রজন্ম বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই মানবিক দায় কি কেবলই আমাদের? বিশ্বসভ্যতা কি কিছুই করবে না তাদের জন্য? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কোথায় খুঁজব। যদিও শরণার্থীদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিতে জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর এক বক্তব্যে উন্নত দেশগুলোর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, তারপরও আমরা দেখছি সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থীদের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতার পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রবণতা। এর প্রভাব অবধারিতভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পড়বে এবং পড়ছে।
রোহিঙ্গা সংকটকে আরও জটিল করে তোলার পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে আরাকান আর্মির দখল ও মিয়ানমারের মিলিটারি জান্তার সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা। রাখাইনে অবস্থিত বাকি রোহিঙ্গারাও নিরাপত্তার অভাব ও জীবন বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। এমন একটা জটিল পরিস্থিতিতে রাখাইনে অবস্থিত জনগোষ্ঠীর জন্য সাহায্য পাঠাতে মানবিক করিডর বা প্যাসেজ বা চ্যানেলের মতো নানাবিধ বিভ্রান্তিমূলক আলাপ-আলোচনাও আমরা বিগত কয়েক মাসে দেখেছি, যা প্রকৃত অর্থে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি।
আমরা যদি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে মানবিক করিডরের উদাহরণ দেখি তাহলে দেখতে পাই যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সহিংসতার মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করে শরণার্থী হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে। ইতিমধ্যেই নির্যাতনের শিকার হয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাই বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলার কোনো বিকল্প নেই। অথচ রোহিঙ্গা সংকটের এত বছর হয়ে যাওয়ার পরও আমরা এ বিষয়ে কোনো বিশদ কর্মপরিকল্পনা ও নীতিমালা দেখিনি।
শরণার্থীবিষয়ক নীতি বা পলিসি প্রণয়ন এখন বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি বিষয়, কেননা সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারত থেকেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ঠেলে পাঠানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশের শরণার্থীবিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীসহ সব ধরনের শরণার্থী জনগোষ্ঠীর যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা উচিত।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের যেহেতু কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না, তাদের জীবনযাপনকে আরও মর্যাদাপূর্ণ করে তোলার কাজ করাই শ্রেয়। একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার জন্য কেবলমাত্র মৌলিক চাহিদার কিছু কিছু মেটানোই যথেষ্ট নয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
এই শিক্ষা বলতে আমরা কেবলমাত্র অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলছি না বরং এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে শরণার্থীদের সন্তানেরাও উচ্চশিক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয়েও যাওয়ার সুযোগ পায়। তাই তাদের কেবলমাত্র জনবিস্ফোরণের একটি উদাহরণ বা দেশের জন্য বোঝা হিসেবে বিবেচনা না করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোর দিকে নজর দিতে হবে।
কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাদের আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় ফলে তারা যখন দেশে ফেরত যাবে সেই দক্ষতা তারা কাজে লাগাতে পারবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে পরিকল্পনায় এর সঙ্গে স্থানীয়দেরও জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একটি কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। তা না হলে স্থানীয়দের মধ্যেও হতাশা কাজ করবে।
ইতিমধ্যেই আমরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখেছি, দীর্ঘ সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে থাকার কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যেমন সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি সম্পর্ক ২০১৭ সালে ছিল, তা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। এবং স্থানীয়রা এখন আর রোহিঙ্গাদের ইতিবাচক চোখে দেখছে না। পারস্পরিক সম্পর্কের বাইরেও রোহিঙ্গাদের স্থানীয় মিডিয়াতে ‘ডেমোনাইজড’ বা নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও নেতিবাচক দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমরা এটাও দেখছি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনেকেই নানাবিধ বেআইনি কাজেও যুক্ত হচ্ছে। এতে করে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মধ্যকার যে ইতিবাচক সহাবস্থানের প্রত্যাশা আমরা করি, তা ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায় বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্যকে আমরা রোহিঙ্গাদের প্রেক্ষাপটে কতটা বাস্তবায়ন করতে পারছি, তা একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে যাবে। আমরা দিন দিন দেখছি এই খাতের আর্থিক সহায়তা কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের সেবা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে। ধনী ও প্রভাবশালী দেশগুলো আরও ইতিবাচকভাবে এগিয়ে না এলে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের পরিবর্তন বেশ কঠিন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেন্দ্র করে ভূরাজনীতির অবসান নিয়েও জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থাসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর এগিয়ে আসতে হবে, তা না হলে শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য কেবলই ফাঁকা বুলি হিসেবেই থেকে যাবে।
বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শরণ র থ দ র স জনগ ষ ঠ র দ র জ বন র সমস য ব যবস থ র জন য ক জ কর সহয গ ও আমর অবস থ বসব স
এছাড়াও পড়ুন:
২৭ নভেম্বর জকসু নির্বাচন না হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা হবে: আপ বাংলাদেশ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচন ২৭ নভেম্বরেই অনুষ্ঠিত না হলে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছে ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশ। এ সময় পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে সংগঠনটি।
সোমবার (৩ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নিচে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
২৭ নভেম্বরই জকসু নির্বাচন চায় ছাত্রশিবির
জকসু নির্বাচন নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ ছাত্র সংগঠনগুলোর
দাবিগুলো হলো— আসন্ন জকসু নির্বাচন ২৭ নভেম্বরেই অনুষ্ঠিত করতে হবে; নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে; সব সংগঠনকে সমান সুযোগ দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে; অরাজনৈতিক, নিরাপদ ও শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জবির প্রধান সংগঠক মাসুদ রানা বলেন, “আমরা যখন জকসুর দাবিতে অনশন করছিলাম, তখন প্রশাসন ২৭ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের অনশন ভাঙিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একটি মহল নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে।”
তিনি বলেন, “ডিসেম্বর মাসে ভর্তি পরীক্ষা ও বিভিন্ন বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় ওই মাসে নির্বাচন অসম্ভব। তাই ২৭ নভেম্বরই জকসু নির্বাচনের উপযুক্ত সময়।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা জানতে চাই, নির্বাচন পেছানোর মধ্য দিয়ে জকসু নির্বাচন ভণ্ডুল করার কোনো প্রক্রিয়া চলছে কিনা। পুরান ঢাকাকে অস্থিতিশীল করে একটি মহল নির্বাচন পণ্ড করতে চায়। শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম ভোট হবে জকসু নির্বাচন—তা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।”
ঢাকা/লিমন/মেহেদী