‘জিয়া মঞ্চে’র সভাপতি হয়ে ফরিদপুরে প্রকাশ্যে খাঁজা বাহিনীর প্রধান
Published: 20th, June 2025 GMT
প্রকাশ্য দিবালোকে চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনায় ৬ মাস পলাতক থেকে ‘জিয়া মঞ্চে’র সভাপতি হয়ে প্রকাশ্যে এলেন ফরিদপুরের কানাইপুর এলাকার সন্ত্রাসী খাঁজা বাহিনীর প্রধান খায়রুজ্জামান ওরফে খাঁজা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ফরিদপুর শহরের একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত এক সভায় সংগঠনটির সদর উপজেলার আংশিক কমিটির সভাপতি হিসেবে খায়রুজ্জামান খাঁজার নাম ঘোষণা করা হয়। এছাড়া সিনিয়র সহ-সভাপতি মো.
সভায় জিয়া মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম. টি আখতার টুটুল, ফরিদপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস সাজ্জাদ আহমেদ শাওন, জেলা জিয়া মঞ্চের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবি.এম মোর্শেদ পলাশ ও সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম আলী উপস্থিত ছিলেন।
নবগঠিত কমিটিকে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে জিয়া মঞ্চ ফরিদপুর জেলা শাখায় কমিটির কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ফরিদপুরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কানাইপুর ইউনিয়নের ঝাউখোলা গ্রামের বিল্লাল খানের ছোট ছেলে ওবায়দুর রহমান খান। ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। খাঁজার বিচারের দাবিতে ওই সময় রাজপথে নেমে আসে সাধারণ জনতা। তারপর থেকে দীর্ঘ ৬ মাস পলাতক ছিলেন খাঁজা।
ওই ঘটনায় ওবায়দুরকে তুলে নিয়ে দুই চোখে লোহার পেরেক দিয়ে খোঁচানো হয়, হাত পায়ের রগ কেটে ফেলাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে ওবায়দুর মারা যান। এ ঘটনার পরে ১১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে খাঁজাকে প্রধান আসামি করে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০ থেকে ১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন নিহতের মা রেখা বেগম। এরপর থেকে পলাতক ছিলেন খাঁজা। এই মামলায় বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও খাজাকে ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
শুধু ওবায়দুর হত্যা নয়, কোতোয়ালি থানায় চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দস্যুতাসহ ১৮টি মামলা রয়েছে খাঁজা বাহিনীর প্রধান খাঁজার নামে।
জানা যায়, ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের ভাটী লক্ষ্মীপুর গ্রামের হানিফ মাতবরের ছেলে খাঁজা। তার বড় ভাই বর্তমান কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন।
পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দাদের হাতে একাধিকবার আগ্নেয়াস্ত্র, ইয়াবা, দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হলেও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জামিনে বের হয়ে আসেন খাঁজা। এরপর পুনরায় শুরু করেন ত্রাসের রাজত্ব। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের হস্তক্ষেপে একটি সাজাপ্রাপ্ত মামলায় খালাস পেয়ে বের হয়ে আসেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভোলপাল্টে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন খাঁজা।
বিভিন্ন সময় খাঁজার গ্রেপ্তারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল একটি বিদেশি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলিসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন খায়রুজ্জামান খাঁজা। সড়কে বাসে ডাকাতির প্রস্তুতির সময় তাকে আটক করা হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়।
২০২১ সালের ১৫ মে দুইজন সহযোগীসহ কোতোয়ালি থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে খাঁজাকে। তৎকালীন সময়ে এক প্রেসব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা জানান, তার বিরুদ্ধে কানাইপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দস্যুতা, ভূমি দখলসহ নানা বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দস্যুতাসহ ১৮টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন।
এরপর ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল ইয়াবাসহ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। একই বছরে তৎকালীন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান অন্যত্র বদলির পরদিন এলাকায় ছাত্রলীগের বিভক্তিকরণে সহযোগীদের নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেন খাঁজা। যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরেই ২৮ আগস্ট দেশীয় অস্ত্রসহ খাঁজা ও তার ৪ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী নেতা আব্দুর রহমানের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রকাশ্যে আসেন খাঁজা। তার ছত্রছায়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কানাইপুরে যুবলীগ নেতা পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে নিজেকে জানান দিতো খাঁজা।
তবে জেলা জিয়া মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম আলী জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের আমলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। এছাড়া খায়রুজ্জামান খাঁজাকে বিএনপির ত্যাগী নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে তিনি জানান। ইব্রাহিম আলী বলেন, ‘খাঁজা কানাইপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ রোষানলে তাকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এছাড়া ওবায়দুর হত্যা মামলায় আদালতে এখনো দোষী সব্যস্ত করেনি এবং ঘটনাস্থলেও ছিল না। ত্যাগী নেতা হিসেবে দলে নেওয়া হয়েছে।
ফরিদপুর কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদউজ্জামান বলেন, ওবায়দুর হত্যার মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তদন্তাধীন রয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রতি সে উচ্চ আদালত থেকে কয়েক সপ্তাহের জামিনে রয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর প রক শ য র হত য কম ট র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রেন থেকে পড়ে ৮ দিন ধরে হাসপাতালে ছেলে, ফেসবুকে ছবি দেখে ছুটে এলেন মা
প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে গতকাল সোমবার বাসায় ফিরছিলেন নাজমা বেগম। ঢাকার টঙ্গী এলাকায় থাকেন তিনি। পরিচিত এক ব্যক্তি তাঁকে হঠাৎ ফোন করে জানান, তাঁর নিখোঁজ ছেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। দ্রুত ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন নাজমা। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একটি ভিডিও দেখান নাজমাকে। সে ভিডিওতে দেখতে পান, তাঁর ১০ দিন ধরে নিখোঁজ ছেলে আবদুল্লাহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।
ছেলের খোঁজ পেয়ে আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ছুটে আসেন তিনি। রেলস্টেশন থেকে সরাসরি চলে আসেন চমেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে। এখানেই ৮ দিন ধরে ভর্তি আবদুল্লাহ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৮ সেপ্টেম্বর আহত অবস্থায় আবদুল্লাহকে হাসপাতালে আনা হয়। সে সময় তার নাম-ঠিকানা কিছুই জানা যায়নি। অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে নেওয়া হয় তাকে। পরদিন তার অস্ত্রোপচার হয়। গত শনিবার আবদুল্লাহর জ্ঞান ফেরে। এরপর নিজের ও বাবা-মায়ের নাম আর বাসার ঠিকানা জানায় সে।
চিকিৎসকেরা সেই সূত্রে ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানাভাবে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। ফেসবুকে আবদুল্লাহর ছবি দিয়ে খোঁজ চাওয়া হয় বাবা-মায়ের। সেই ছবি পরিচিতদের মাধ্যমে দেখেন নাজমা বেগম। এরপর ছুটে আসেন চট্টগ্রামে। হাসপাতালে এসেই নার্সদের সহায়তায় যান নিউরোসার্জারি বিভাগে। সেখানে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)চিকিৎসাধীন আবদুল্লাহকে দেখেন।
আজ বিকেলে হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের সামনে কথা হয় আবদুল্লাহর মা নাজমা বেগমের সঙ্গে। সকালেই চট্টগ্রাম পৌঁছেছেন তিনি। জানালেন, তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ১০ বছর বয়সী আবদুল্লাহ সবার বড়। ছোট মেয়ের বয়স পাঁচ ও আরেক ছেলের বয়স দুই। আবদুল্লাহ সুস্থ আছে জেনে স্বস্তি পেলেও দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। কারণ, এটিই প্রথমবার নয়, এর আগেও কয়েকবার ঘর থেকে কিছু না বলে বেরিয়ে যায় সে।
নাজমা বেগম বলেন, প্রায়ই আবদুল্লাহ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এদিক–সেদিক চলে যায়। পরে আবার ফিরে আসে। এর আগেও ঢাকার আশপাশে এদিক-সেদিক চলে গিয়েছিল সে। ৬ সেপ্টেম্বর সে ভাত খাওয়া থেকে উঠে হঠাৎ চলে যায়। সে ফিরে আসবে এই আশায় থানায় যাননি। কিন্তু ১০ দিন হয়ে যাওয়ায় এদিক–সেদিক খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। ঢাকায় বিভিন্ন স্টেশনে ছেলের খোঁজে গেছেন বলে জানান নাজমা।
চমেক হাসপাতালে চিকিৎসকেরা আবদুল্লাহর বরাত দিয়ে জানান, বাসা থেকে বেরিয়ে সে কক্সবাজার যাচ্ছিল। পথে চট্টগ্রামে ট্রেন থামলে সে ট্রেন থেকে পড়ে যায়। চিকিৎসার পর এখন সুস্থ হয়ে উঠছে সে।
চিকিৎসকেরা জানান, আবদুল্লাহকে যখন আনা হয় তার মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল। তার মাথার এক পাশের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। ট্রেন থেকে পড়ার কারণে মাথায় আঘাত লাগে। হাড়ের কিছু অংশ মস্তিষ্কের ভেতরে গেঁথে যায়। অস্ত্রোপচারও সফল হয়েছে। তবে জ্ঞান না ফেরায় তার পরিচয় জানা যায়নি। জ্ঞান ফেরার পর তার তথ্য নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়।
শুরু থেকে আবদুল্লাহর অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক মু. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘তার হাড় ভেঙে মস্তিষ্কের ভেতরে চলে গিয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর স্বাভাবিকভাবে সেটি জোড়া দেওয়া হয়েছে। এখন সে পুরোপুরি সুস্থ। তাকে আমরা আজ-কালের মধ্যে ডিসচার্জ করে দেব। শিশুকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতে পেরে আমরাও আনন্দিত।’