সারাদেশে শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৫১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়াল সাত হাজার ৭৭ জন। এদের মধ্যে ৩ হাজার ২৮০ জনই বরিশাল বিভাগের; মোট রোগীর হিসাবে এখানে আক্রান্তের হার ৪৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লায় ডেঙ্গুতে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এই মৃত্যুর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যুক্ত করা হয়নি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৮৬ জন, চট্রগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৫, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৭, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৮ ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১০, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) তিন এবং রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) দু'জন রয়েছেন। গত একদিনে ১১১ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে এ বছর মোট ছয় হাজার ২১৪ জন রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন সাত হাজার ৭৭ জন। এর মধ্যে ৫৯ দশমিক তিন শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক সাত শতাংশ নারী। এই সময়ে ডেঙ্গুতে ৩০ জন মারা গেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঢাকা বিভাগে, ১৭ জন। এ ছাড়া বরিশালে সাত, চট্টগ্রামে তিন, খুলনায় দুই ও ময়মনসিংহে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

২০২৪ সালে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হন একলাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনে। এর আগে ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন; আর এক হাজার ৭০৫ জন মারা যান।

কুমিল্লায় এক নারীর মৃত্যু
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে কুমিল্লা নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় লিমা আক্তার (২৪) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। লিমা জেলার বরুড়া উপজেলার আরিফপুর গ্রামের মৃত মোবারক হোসেন ভূঁইয়ার ছোট মেয়ে। তিনি দাউদকান্দির গৌরিপুর পালপাড়া গ্রামের সৌদি প্রবাসী আরিফ হোসেনের স্ত্রী। তার এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে।

ওই নারীর বড় ভাই ফয়সাল আহমেদ ভূঁইয়া জানান, গত ১৩ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে লিমাকে প্রথমে দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করা হয়। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কুমিল্লা নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

আমানত রক্ষা করা ইসলামের সামাজিকতার সৌন্দর্য

আধুনিক বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামের একটি মৌলিক মূল্যবোধ—‘আমানত’—চিন্তা ও চর্চা থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।

অথচ আমানত শুধু একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক ধারণা নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত আত্মিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের ওপর অর্পণ করেছেন।

পবিত্র কোরআনে এই আমানতের গুরুত্ব অত্যন্ত জোরালোভাবে বর্ণিত হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয়ই সে ছিল অত্যন্ত জুলুমকারী ও মূর্খ।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২)

এই আয়াতে আমানতের মর্যাদা ও এর ওজনের গভীরতা প্রকাশ পায়। আল্লাহর এই দায়িত্ব মানুষের ওপর অর্পিত হওয়া তার বিশেষত্বের প্রমাণ, তবে এটি একই সঙ্গে তার জন্য একটি বড় পরীক্ষা।

নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল।সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২আমানতের ব্যাপকতা

‘আমানত’ শব্দটির অর্থ শুধু আর্থিক বা সামাজিক বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ব্যাপক ধারণা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমানতের মধ্যে রয়েছে:

ব্যক্তিগত আচরণে সততা: কথায়, কাজে ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সত্যবাদিতা।

সামাজিক দায়িত্ব: পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন।

পরিবেশের প্রতি যত্ন: আল্লাহর সৃষ্টির খিলাফা হিসেবে প্রকৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।

আধ্যাত্মিক আনুগত্য: আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ও তাঁর আদেশ পালন।

আমানত একটি ইবাদতের অংশ, যা শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতের জবাবদিহির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।

আরও পড়ুনইসলামে আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব২২ জুলাই ২০২২নবী–যুগে আমানতের উদাহরণ

ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবীজি (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদিনার সমাজ আমানতের একটি জীবন্ত উদাহরণ। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।

এই সম্পর্ক শুধু সম্পদের বণ্টন নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ব ও বিশ্বাসের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমনকি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর আনসারি ভাই সা’দ ইবনে রাবী (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক এবং এমনকি তাঁর স্ত্রীদের একজনকে তালাক দিয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ত্যাগ ও বিশ্বাস আমানতের প্রকৃত চিত্র। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৭৮০)

মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।

এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে মদিনার সমাজে একতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, যা আজও মুসলিম সমাজের জন্য একটি আদর্শ।

আধুনিক সমাজে আমানতের অবক্ষয়

দুর্ভাগ্যবশত, আজকের সমাজে আমানতের চর্চা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, গোষ্ঠীবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মসজিদগুলোতে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভেদ, পারিবারিক স্বার্থপরতা এবং একে অপরের প্রতি সন্দেহ সমাজের ঐক্যকে ভঙ্গ করছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও প্রায়ই দেখা যায়, অসৎ আচরণ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসের অপব্যবহার।

এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও ‘নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা’ একটি নতুন সামাজিক আদর্শ হয়ে উঠেছে। মানুষ অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটি শুধু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ: আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই পৃথিবীর খলিফা বানিয়েছেন, যার মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বও অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু আজকের উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস, নদী ও বাতাসের দূষণ এবং প্রাণপ্রবাহের ক্ষতি আমানতের এই দিকটিকে উপেক্ষা করছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীতে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)

প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো এটিকে সংরক্ষণ করা, অপচয় রোধ করা এবং সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা।

আরও পড়ুনপ্রলোভনের এই যুগে নিজেকে রক্ষার উপায়০২ আগস্ট ২০২৫আমানতের নষ্টের ভবিষ্যদ্বাণী

নবীজি (সা.) আমানতের অবক্ষয় সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন: ‘মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৫)

এই হাদিসটি একটি গভীর সতর্কবাণী। এটি ইঙ্গিত করে যে একটি সময় আসবে যখন বিশ্বস্ততা এতটাই বিরল হয়ে পড়বে যে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করা হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী আধুনিক সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬আমানতের পুনর্জাগরণের উপায়

আমানতের মূল্যবোধকে পুনরায় জীবন্ত করতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:

সত্যবাদিতা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা: কথা ও কাজে সততা বজায় রাখা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।

দায়িত্বশীলতা ও সততা: পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ।

ন্যায়পরায়ণ আর্থিক আচরণ: ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততা।

প্রকৃতির প্রতি যত্ন: পরিবেশ সংরক্ষণ, অপচয় রোধ ও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা।

পারস্পরিক সহযোগিতা: সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য গড়ে তোলা।

আমানত শুধু একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ইবাদত, যা আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্যের প্রকাশ। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। আমানতের চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে আমরা একটি দয়ালু, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এটি আমাদের দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করবে।

আরও পড়ুনআখিরাতে বিশ্বাস সত্কর্মের অনুপ্রেরণা০৪ মে ২০১৮

সম্পর্কিত নিবন্ধ