জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী নাজমুন মুনিরা ন্যানসি বাংলা গানের ভুবনে দীর্ঘদিন ধরে আপন দক্ষতায় শ্রোতা মন জয় করে আসছেন। একের পর এক হিট গান উপহার দিয়ে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য স্বীকৃতি। তারই পথ ধরে সংগীতে সম্ভাবনার জানান দিয়েছেন তার কন্যা রোদেলা। এরইমধ্যে তার কণ্ঠে একাধিক গান শ্রোতামহলে প্রশংসিত হয়েছে।
এইবার মা-মেয়ে একসঙ্গে গান গেয়ে হাজির হচ্ছেন নতুন চমক নিয়ে। ‘কেন’ শিরোনামের এই গানটি প্রথমবারের মতো একসঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন তারা। গানটির কথা লিখেছেন ফয়সাল রাব্বিকীন, সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন প্রত্যয় খান। গানটি স্যাড-রোমান্টিক ধাঁচের এবং এর ভিডিওচিত্রেও অংশ নিয়েছেন ন্যানসি ও রোদেলা—দুজনেই।
আগামী ১০ জুলাই গানটি প্রকাশ পাবে রোদেলার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে। গান প্রসঙ্গে ন্যানসি বলেন, “প্রথমে গানটি আমি একাই গাওয়ার কথা ভাবছিলাম। পরে মনে হলো, রোদেলাকে যুক্ত করলে আরও ভালো হবে। তার কণ্ঠে কিছু অংশ গাইয়ে দেখলাম, ভালোই লাগলো। প্রথমবার আমার সঙ্গে মেয়ের গান— গর্বের এবং আবেগের বিষয়।”
রোদেলার নিজের অনুভব প্রকাশ করে বলেন, “মায়ের সঙ্গে গান গাওয়া এক ধরনের দুঃসাহস! তার গায়কী, কণ্ঠের ইউনিকনেস সবারই জানা। কিন্তু তার সাহস ও অনুপ্রেরণাতেই গানটি গেয়েছি।”
ঢাকা/রাহাত//
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
শতাব্দীর বিবর্তনের গল্প বলে লুভর মিউজিয়াম
প্যারিস– নামটি উচ্চারণ করলেই যেন এক মোহময় ধ্বনি বয়ে যায় হৃদয়ের ভেতর দিয়ে। এ শহর প্রেমের, শিল্পের, সভ্যতার। প্যারিসের ঠিক মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ইতিহাসের পাহারাদার– লুভর মিউজিয়াম। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বৃহৎ জাদুঘর এটি। যার প্রতিটি প্রাচীর যেন সময়ের পাতায় অক্ষরে অক্ষরে লেখা একেকটি গল্প। সেই গল্পের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে আমি যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েক শতাব্দী পেছনের কোনো পৃথিবীতে। লিখেছেন -অনিন্দ্য মামুন
সময়টা গ্রীষ্মকাল। তবে প্যারিসের আবহাওয়া তখন না গরম না ঠান্ডা। সেদিন প্যারিসের আকাশ ছিল নীলচে ধূসর। হালকা ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসছিল একটা অলৌকিক আমন্ত্রণ– চলো সময়কে ছুঁয়ে দেখা যাক। সে আমন্ত্রণেই প্যারিসের মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা মেট্রো ধরে ছুটে চলা। কখনও হেঁটে, কখনও-বা মেট্রোতে চলার দারুণ অনুভূতি সামনে এসে দাঁড়ালাম লুভর পিরামিডের কাচ দিয়ে নির্মিত সেই জ্যামিতিক অলংকারের সামনে। যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া আর প্রাচীনতার বিশালতা একসঙ্গে মিলেমিশে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞান সৃষ্টি করেছে। পিরামিডের নিচের প্রবেশপথ দিয়ে যখন মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকি, মনে হয় কোনো সুড়ঙ্গপথে ঢুকেছি; যা আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল অতীতের মহাকাব্যে।
লুভর মিউজিয়াম যেন বহু শতাব্দীর বিবর্তনের গল্প। ১১৯০ সালে রাজা ফিলিপ অগাস্টাস এটি নির্মাণ করেন একটি সামরিক দুর্গ হিসেবে, প্যারিস শহরকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে। তখন শহরের সীমানা ছিল অনেক ছোট আর লুভর ছিল সেই প্রাচীরঘেরা শহরের রক্ষাকবচ। ১৫৪৬ সালে রাজা ফ্রাঁসোয়া প্রথম এ দুর্গকে রূপান্তর করেন রাজপ্রাসাদে। তিনিই প্রথম শুরু করেন শিল্প সংগ্রহ। ঠিক সেখান থেকেই জন্ম নেয় লুভরের ভবিষ্যৎ পরিচয়। এ রাজাই লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে ফ্রান্সে আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করেন মোনালিসা। পরে ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের উত্তাল সময়ে লুভর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তখন এর সংগ্রহ ছিল মাত্র ৫০০টির মতো; যা আজ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজারেরও বেশি শিল্পকর্মে।
ভেতরে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া। চারপাশে শুধু ছবি, মূর্তি, দেয়ালচিত্র, শিল্পকর্ম। মিসরের শবাধার, গ্রিক দেবতাদের ভাস্কর্য, রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্ম, ইসলামী ক্যালিগ্রাফি, ভারতীয় মূর্তি– পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের শিল্প যেন এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যেদিন দা ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনালিসা’র সামনে দাঁড়ালাম, মনে হলো আমি সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। ওই রহস্যময় হাসি আমাকে চুপ করিয়ে দিল। শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও যে ছবি লাখো-কোটি দর্শককে একসঙ্গে স্তব্ধ করে দিতে পারে– তা তো কেবল মোনালিসাই।
মোনালিসার পাশে হেঁটে গেলে আপনি দেখতে পাবেন আরেক বিস্ময়– ভেনাস দে মিলো। দুই হাত ভাঙা, তবু অপূর্ব নারীত্বে পূর্ণ এই গ্রিক দেবীর মূর্তি যেন এক শাশ্বত সৌন্দর্যের চিহ্ন। আবার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ‘উইংড ভিক্টরি অব সামোথ্রেস’, ডানাওয়ালা এক দেবী, যিনি যেন বিজয়ের অঙ্গভঙ্গিতে হাঁটছেন সময়ের বুকে।
একটি হলঘরে দেখলাম মিসরের এক ফেরাউনের মমি সংরক্ষিত আছে। তার চোখ দুটো বন্ধ, অথচ মনে হলো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। পাশেই এক প্রাচীন স্ফিংক্স– মিসরের মরুভূমি পেরিয়ে এসে যেন এখানে বসে আছে ক্লান্ত হয়ে।
আরেক করিডোরে দেখি জ্যাক-লুই ডেভিডের বিশাল ক্যানভাস– ‘দ্য করোনেশন অব নেপোলিয়ন’, যেখানে সম্রাট নিজেই নিজের মুকুট পরাচ্ছেন। এ ছবির প্রতিটি চরিত্র যেন জীবন্ত, প্রতিটি দৃষ্টির ভঙ্গিতে গল্প।
লুভরের সবচেয়ে মোহময় দিকটি ছিল এর স্থাপত্য। দৃষ্টিনন্দন দেয়াল, উঁচু ছাদ, ধ্রুপদি কারুকাজে পূর্ণ প্রতিটি করিডোর– প্রতিটি কোণেই যেন একেকটা জীবন্ত উপন্যাস। মিউজিয়ামের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই যেন ইতিহাসের নানা চরিত্র সামনে এসে দাঁড়ায়। কারও হাতে রংতুলি, কেউ বর্ম পরে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে, কেউবা চুপচাপ বসে জীবনের দুর্বোধ্যতা আঁকছে ক্যানভাসে।
এই জাদুঘর শুধু জ্ঞান নয়, এক গভীর আবেগের আধার। শিল্পের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা এখানে এসে যেন আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে শুরু করে আধুনিক বিমূর্ত চিত্র পর্যন্ত– সবকিছুই মানুষ রেখে গেছে ভবিষ্যতের জন্য।
লুভরে হাঁটতে হাঁটতে একটা অদ্ভুত বিষণ্নতা গ্রাস করেছিল আমাকে। কারণ এত সৌন্দর্য, এত ইতিহাস দেখে প্রশ্ন জাগে– আমরা কী রেখে যাচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য? এই বিশ্ব কি এখনও শিল্পের প্রতি ততটাই শ্রদ্ধাশীল আছে, যতটা ছিল দা ভিঞ্চির যুগে?তবে পরক্ষণেই মনে হলো, শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় প্রমাণই তো হলো দর্শক।
লুভর শুধু একটি মিউজিয়াম নয়, এটি এক চলমান ইতিহাসের মহাকাব্য। এখানে একটি ছবি মানে কেবল রং নয়, একটি মূর্তি মানে শুধু পাথর নয়, বরং একটি জাতির আত্মা, একটি সভ্যতার কল্পনা, একটি মানুষের অশ্রু, আনন্দ, ভালোবাসা।
ফিরে আসার সময় আমি আবার দাঁড়ালাম পিরামিডের নিচে। তখন সন্ধ্যা নামছে প্যারিসে। লুভরের চারপাশে হালকা হলুদ আলো জ্বলে উঠেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি– শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ বসে আছে চুপচাপ, কেউ হয়তো ভালোবাসায় মুখ ডুবিয়েছে। আমি ভাবছি– লুভর হয়তো কোনোদিন আমায় ভুলে যাবে, কিন্তু আমি? আমি তো চিরকাল এ অভিজ্ঞতা বহন করব। কারণ, শিল্প একবার হৃদয়ে বাসা বাঁধলে তা আর কোনোদিন চলে যায় না।