ফিলিস্তিনিদের ওপর নিষ্ঠুর অমানবিকতার শেষ কোথায়?
Published: 11th, July 2025 GMT
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, অনেক সমাজ বা সভ্যতায় কিছু নির্দিষ্ট জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী নিষ্ঠুর অত্যাচার ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এমনকি অনেককে পূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়নি।
এক সময় কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ হিসাবে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হত না। ১৬০০ থেকে ১৯০০ শতক পর্যন্ত আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে জোর করে ধরে এনে ইউরোপ, আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে দাস হিসেবে বিক্রি করা হত। তবে এর পূর্বেও পৃথিবীতে দাস প্রথা বিদ্যমান ছিল। তাদের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না, মালিকের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হত।
আমেরিকার সংবিধান রচনার সময় ১৭৮৭ সালে একটি আইন পাস হয় যেখানে বলা হয়, ৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ থাকলে তিন জন মানুষ বা ভোটার হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও এক সময় এই আইন বাতিল হয়ে ছিল।
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলের সমালোচনা করায় জাতিসংঘের বিশেষ দূতের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
গাজায় গণহত্যার প্রতিক্রিয়া দেখাতে বিশ্বকে লুলার আহ্বান
এক সময় এমন ধারণা ছিল কৃষ্ণাঙ্গরা ক্ষুধা, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা অনুভব করে না। শারীরিক পরিশ্রমে ক্লান্ত হয় না, তাই তাদেরকে দিয়ে কষ্টের ও আমানবিক কাজ করা হত। এই ভুল ধারণাটি চিকিৎসাশাস্ত্রেও ছিল। যে কারণে কৃষ্ণাঙ্গ রোগীদের ব্যথানাশক দেওয়া হত না। কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহারের ইতিহাসও আছে। কৃষ্ণাঙ্গ নারী দাসদের ওপর যন্ত্রণা-দায়ক অস্ত্রোপচার চালানো হয়েছে কোনো ধরনের অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই। অথচ শ্বেতাঙ্গ নারীদের অস্ত্রোপচার করা হতো যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে এবং অবশ্যই অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করা হতো।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা স্থানীয় আদিবাসীদের (নেটিভ আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান আবোরিজিনাল, ইত্যাদি) মানুষ হিসেবে না দেখে ‘বনের মানুষ’ হিসেবে অপমান করার কথা জানা যায়।
আজ যারা নিজেদের কে সভ্য মনে করে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে তারা ১৯২০ সালের আগে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি।
এমনকি আফ্রিকা ও এশীয়দেরকেও এক প্রকার অবজ্ঞা ও বর্ণবাদী মনোভাবের চোখে দেখত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয়দের ক্ষেত্রে যেমনটা ছিল। ১৯৪৩ সালের বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল যেসব মন্তব্য করেছিলেন, তা আজও ইতিহাসে বিতর্কিত এবং সমালোচিত।তিনি বলেছিলেন, “If food is so scarce, why isn’t Gandhi dead yet?” “It is their own fault for breeding like rabbits.
তিনি আরো বলেছিলেন, “I hate Indians. They are a beastly people with a beastly religion.” (আমি ভারতীয়দের ঘৃণা করি। তারা পশুর মতো জাতি এবং পশুসুলভ ধর্ম অনুসরণ করে।)
ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবসহ অনেক ক্লাবে লেখা থাকত “Indians (locals) and dogs are not allowed”। যে কারণে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে ঐ ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা চালানো হয়ে ছিল।
বর্তমানে আইনি ও সামাজিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্যদের মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা দেওয়া হলেও, অনেক মানুষ এখনো বর্ণবাদী মনোভাব বা ব্যবস্থাগত বৈষম্য থেকে ফিরে আসতে পারেনি।
ইতিহাসের এমন জাতি, সম্প্রদায় বা ধর্মের নিষ্ঠুর অত্যাচার ও বৈষম্যের শিকার ফিলিস্তিনি জনগণ। সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় পৃথিবীর কথিত সভ্য সমাজ, নিয়ন্ত্রক ও ক্ষমতাধরদের কাছে ফিলিস্তিনিরা যেন এখনও মানুষ হতে পারিনি।
ফিলিস্তিনিরাও মানুষের মতো ব্যথা পায়, কষ্ট পায়, আপনজন হারানোর বেদনা উপলব্ধি করে, ভালোবাসে, স্বপ্ন দেখে, ক্ষুধার্ত হয়। পৃথিবীর অনেকে এখন বিষয়গুলো ভুলে যেতে বসেছে।
পৃথিবীর অনেকে বন্দুক দিয়ে মানুষ হত্যা শুনেছে, পড়েছে কিন্তু চোখে দেখিনি। ইসরায়েলের বাহিনী প্রকাশ্যে এই কাজ প্রতিদিন করে যাচ্ছে। নির্মম বুলেট ক্রমাগত বিদ্ধ করে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। বিবেকবান মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এভাবে মানুষ পাখিদেরকেও মারতে পারে! ইসরায়েলের বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের গণমাধ্যমে ভিডিও ও ছবি দেখে মানুষ বাকরুদ্ধ, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
রাস্তায় গুলি, ট্যাঙ্ক, আকাশ থেকে হামলা, মানুষের মধ্যে শুধু মৃত্যু আতঙ্ক। মৃত্যুর মিছিল যেন বেড়েই চলেছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে জানাজার নামাজে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। দেখা দিয়েছে কবরস্থানের সংকট। পুরনো কবর খনন করে নতুন দাফনের জায়গা তৈরি হচ্ছে। অনেক সময় একাধিক মৃতদেহ একসাথে বা দ্রুত সমাধিস্থ করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে এক লাখ পৌঁছেছে (ইসরাইলের পত্রিকা হারেৎজ এর খবর অনুযায়ী)। আহত বা পঙ্গু হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ।
গাজায় ছোটবড় কোন বাড়ি, দোকানপাট ও অবকাঠামো আর অবশিষ্ট নেই। ইসরায়েলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় সবই বিধ্বস্ত, মাটির সাথে মিশে গেছে।
গাজায় নিহত বেশির ভাগ শিশু ও নারী। অথচ এই শিশুরা বোঝে না মুসলমান আর ইহুদির পার্থক্য। হামলা হচ্ছে হচ্ছে স্কুল, হাসপাতাল, শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রসহ, সর্বত্র।
ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না, মায়েদের অসহায়ত্ব, বয়স্কদের নিস্তব্ধতা যেন গাজার বাস্তবতা। অনাহার, অর্ধাহার যেন গাজা উপত্যকার মানুষদের নিত্যসঙ্গী।ক্রমাগত হামালায় জমিতে চাষাবাদ বন্ধ। দীর্ঘকাল থেকে গাজা উপত্যকা কঠোর ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে রয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির প্রবেশ প্রায় অসম্ভব।আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কিছু পাঠাতে চাইলেও, অবরোধ ও নিরাপত্তার অজুহাতে অনেক সময় এই সাহায্য আটকে থাকে। কিছুটা সাহায্য ঢুকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।
বাজারে দ্রব্য পাওয়া যায় না বললেই চলে।কিছু পাওয়া গেলেও চড়া দামের কারণে মানুষের নাগালের বাইরে। খাদ্য সংকট এতটাই তীব্র যে অনেক পরিবার গাছের পাতা, পশুর খাদ্য, এমনকি ঘাস সেদ্ধ করে খাওয়ার খবর গণমাধ্যমে পাওয়া যায়।
অনেক শিশু দিন কাটায় শুধু পানি বা এক টুকরো শুকনো রুটি খেয়ে। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিলিস্তিনি শিশুদের সবচেয়ে বড় অংশ অপুষ্টিতে ভুগছে।
গাজাবাসীর খাবার পাওয়ার একমাত্র উৎস হলো ত্রাণকেন্দ্রগুলো।খাবার না পাওয়ার অর্থ হলো ফিলিস্তিনি শিশুদের অনাহারে থাকা।অথচ এই সামান্য ত্রাণের বিনিময়ে তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বুলেট। ত্রাণকেন্দ্রগুলো যেন ‘কিলিং ফিল্ড' বা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের শিশু শৈশব এখন বিপণ্ন। প্রতিদিনের গোলাবর্ষণ, বিমান হামলা, বা সামরিক অভিযানের মাঝে বড় হয় ফিলিস্তিনের শিশুরা। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের শিশুরা খেলাধুলা, শিক্ষা ও নির্ভয়ে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পায়, সেখানে ফিলিস্তিনের শিশুরা বেঁচে থাকার সংগ্রামেই দিন কাটায়।তারা চোখের সামনে হারায় বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধু কিংবা নিজের ঘরবাড়ি। অনেক শিশুই বোমার আঘাতে পঙ্গু হয়ে যায় বা চিরতরে হারায় দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি কিংবা কথা বলার সামর্থ্য।
স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে, শিক্ষার পরিবেশ নেই, নেই শিক্ষক বা বই-খাতা। আবার অনেক শিশু প্রিয়জন-বিচ্ছিন্নতার টানাপোড়েন, মৃত্যু, শোক, ধ্বংস, ভয়, উদ্বেগ ও হতাশা থেকে নানা মানসিক সমস্যায় পড়ছে। আবার ইসরায়েলের সেনা দ্বারা ধর্ষিতও হয় শিশু ও নারীরা যাদেরকে আজীবন বয়ে চলতে হয় এই ক্ষত।
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের এই অমানবিকতা যেন পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। ১৯৯৩ সালে শান্তি চুক্তি ও ১৯৯৮ সালে ভূমির বিনিময়ে শান্তি চুক্তি হলেও সেগুলো লঙ্ঘন করে বার বার আগ্রাসী হয়ে উঠছে। ইসরায়েল কোন আন্তর্জাতিক আইন, মানবতা কিছুই মানে না। খোড়া যুক্তি বা অজুহাত দেখায়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর একের পর এক নিপীড়নের খড়গ চালিয়ে আসছে।
জাতিসংঘের ব্যানারে পরাশক্তিগুলোর তত্বাবধানে ১৯৪৭/৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমি দখল করে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরায়েল সৃষ্টি হয়। সেই সময় পাশে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল কিন্তু সেটা কাগজে-কলমেই থেকে যায়। কয়েক প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিদের একটা বড় অংশ কাম্পে বসবাস করে যাচ্ছে।
সূচনাটা অনেক আগে থেকে শুরু হয় যখন ১৮৯৭ ইহুদি কংগ্রেসে তাদের নেতা থিওডর হার্জেল ফিলিস্তিনিদের এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। একই সালে ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া ও আমিরিকা এই ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। শুরু হয় ইহুদি বসতি স্থাপন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন আরবীয়দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ১৯১৯ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর ইহুদি আগমন ব্যাপকহারে শুরু হয়। ১৯২১ সালে আরব-ইহুদি দাঙ্গায় প্রায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি মারা যায়।১৯২২ সালে লীগ অব নেশনস ইহুদিদের বসতি স্থাপনের বৈধতা দিয়ে দেয়।
ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, নাইল (মিশর) নদী থেকে ইউফ্রেটিস (ইরাক) নদী পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে গ্রেটার ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের শত বছরের পরিকল্পনা নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েল সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছেই। ২০২৩ সালে ১৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে ২৮ বিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালে (প্রাক্কলন) ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার নামে ইসরায়েল যেন ফিলিস্তিনিদের নির্ধনে নেমেছে। এক ইহুদি এনজিও প্রধান দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেন তিনি যদি মার্কিন সিনেটে একটি সাদা রুমাল পাঠান তবে তাতে অন্তত ৭০ জন সিনেটর স্বাক্ষর করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ ইহুদি সম্প্রদায়ের অথচ তারা সে দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৩০ শতাংশের মালিক। তেমনি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২ শতাংশ ইহুদি তবে তারা বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মালিক। বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ধনী ব্যক্তির মধ্যে কয়েকজন ইহুদি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, গণমাধ্যম, হলিউড, ধর্মসহ অনেক কিছু ইহুদি লবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় পৃথিবীর আরো কয়েকটি প্রভাবশালী দেশও ইহুদি-ইসরায়েল লবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা সবসময় ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার কাজ করে চলেছে। যেসব কারণে ইসরায়েল বর্তমানে সারা বিশ্বে ধরা কে সরাজ্ঞান করতে চায়। বার বার অপরাধ করার পরও তারা সবসময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।এমনও কথা প্রচলিত আছে ইসরায়েল বা ইহুদিদের স্বার্থ না দেখলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জয়লাভ করা বা টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ পর্যন্ত আরব-ইসরাইল ৪টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে। কতিপয় পরাশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রতিটা যুদ্ধে তারা জয় পায় ইসরায়েল।১৯৬৭ সালের যুদ্ধ স্থায়ী হয়ে ছিল মাত্র ছয় দিন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরাইল প্রতিবেশী মিশরের সিনাই ও গাজা উপত্যকা, জর্ডানের পশ্চিম তীর ও জেরুসালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়।
১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে আগ্রাসন চালায় এবং সেখানে নির্বিচার হাজার হাজার নাগরিক হত্যা করে। ১৯৮৬ ও ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত লিবিয়ায় হামলা হয়। ২০০৩ সালে তথাকথিত ‘ঐচ্ছিক জোট’ পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। নারী, শিশুসহ লাখ লাখ ইরাকি প্রাণ হারায়।তাদের দাবি ছিল, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, যদিও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আর এসব কাজে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল ইসরায়েল।
১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েল বিমান হামলা করে ধ্বংস করে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আল-তুয়াতিয়াহতে নির্মাণাধীন ওসিরাক পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রের গোলাকার গম্বুজ।
অপারেশন ব্যাবিলনের ২৬ বছর পর ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল একই রকম হামলা চালিয়ে সিরিয়ার কথিত আণবিক কর্মসূচি স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। তবে সিরিয়ার সরকার কখনোই স্বীকার করেনি যে কোনো ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি তারা নিয়েছিল। এমনকি, পাকিস্তানের কাহুতায় অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার পরিকল্পনাও করেছিল।
১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েল ধ্বংসের হুমকি দিয়ে আসছে। ১৯৯২ সাল থেকেই তারা দাবি করে আসছে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বার প্রান্তে।
গত ১৩ জুন কোনোরকম বিনা উসকানিতে ও কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই গভীর রাতে ইসরায়েল স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ ইরানের ওপর ২০০ জঙ্গি বিমান নিয়ে হামলা শুরু করে। ১২ দিনের এই হামলায় ইরানে অন্তত ১০০০ জন নিহত এবং ৬০০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। এক ডজনের ও বেশি শীর্ষ সামরিক ও পরমাণু বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামোসহ তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা চালিয়েছে।
আসল উদ্বেগের জায়গা হলো, একটি দ্বিমুখী নীতিমালা বলবৎ রাখা হয়েছে যেন ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে, অন্য কেউ নয়। বিশেষ করে এই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব। ইসরায়েল যেন পশ্চিমাদের একটি ঘাঁটি, কোন দেশ নয়।
ইসরায়েল অনেক আগেই পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছে অথচ পশ্চিমা বিশ্ব, জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা’ (আইএইএ) সব কিছু দেখে না দেখার ভান করেছে।
বর্তমান বিশ্বে শক্তি বা বল প্রয়োগের নীতি এখন শান্তির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলদার ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শান্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে। যার কাছে পারমাণবিক অস্ত্রসহ অন্যান্য মারণাস্ত্র, অত্যাধুনিক ফাইটার জেট, ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাবমেরিন, শক্তিশালী সেনাবাহিনী আছে সেই শান্তিপ্রিয়। আর যাদের এসব কিছু নেই তারাই অশান্তিপ্রিয়, সন্ত্রাসবাদী ও বিশ্ব নিরপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যারা যুদ্ধ বাঁধায়, অস্ত্র সরবরাহ করে, মানুষ হত্যা করে, মানুষের আবাসস্থল গুঁড়িয়ে দেয় তারাই আবার নোবেল শান্তি পুরষ্কারের দাবি তোলে।
বিশ্বের অনেকে ইসরায়েলের অব্যাহত গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একটি মামলা চলছে, যা দক্ষিণ আফ্রিকা দায়ের করেছে। ইতালির আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী ফ্রানচেস্কা আলবানিজ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে এই বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। এতকিছুর পরেও ইসরায়েলের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দাম্ভিকতা অব্যাহত আছে। কারণ ইসরায়েল জানে প্রবাবশালী বিশ্ব মোড়ালরা তার পকেটে।
ইসরায়েলকে থামানোর জন্য এক্ষণই পদক্ষেপের প্রয়োজন। তা না হলে বিশ্ব বিবেককে যে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় উঠতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
ঢাকা/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম র ক ন য ক তর ষ ট র র ষ ট র গঠন র ইসর য় ল র র ইসর য় ল ব র অন ক দ র ওপর ন কর ছ আম র ক ব স কর ব যবস ইউর প ক সময়
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত কেন ৮ কোটি মানুষের ভোটাধিকার যাচাই করছে?
ভারতে এবার প্রায় ৮ কোটিরও বেশি ভোটারের নথি পুনরায় যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন (ইসিআই)। দেশ থেকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ বিতাড়নের উদ্যোগের অংশ হিসেবে এ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। নথি দাখিলের মাধ্যমে তাদের পরিচয় নতুন করে প্রমাণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই ৮ কোটি মানুষকে ভোটবঞ্চিত করার এবং দেশ থেকে বের করে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিশ্বের কথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশটিতে।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, এই উদ্যোগ দেশজুড়ে ব্যাপক বিতর্ক ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। গত ২৪ জুন ইসিআই ঘোষণা দেয়, বিহার রাজ্যে ৮ কোটির কাছাকাছি সব ভোটারকেই আগামী ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে নতুন করে ভোটার হিসেবে নাম নিবন্ধন করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে তারা ভোটাধিকার হারাবেন এবং ইসিআইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের ‘সন্দেহভাজন বিদেশি নাগরিক’ হিসেবে গণ্য করা হবে। এমনকি তাদের জেল বা দেশ থেকে বহিষ্কারাদেশের মুখেও পড়তে হতে পারে। আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
এই পদক্ষেপকে অনেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনকে (এনআরসি) পেছনের দরজা দিয়ে বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে দেখছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার অতীতে ‘অবৈধ অভিবাসী’ শনাক্ত ও বহিষ্কারের অজুহাতে এনআরসি চালুর প্রস্তাব দিয়েছিল।
বিতর্কটা কী নিয়ে?
মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এখানকার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। তবে তৃতীয় বৃহত্তম জনবহুল হওয়ায় রাজ্যটি রাজনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সাল থেকে রাজ্যটিতে বিজেপি ও আঞ্চলিক জনতা দলের (ইউনাইটেড) জোট বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় রয়েছে।
বিরোধী রাজনীতিবিদ ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলো বলছে, এই অল্প সময়ে এত বিশালসংখ্যক মানুষের নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল সম্ভব নয়। ফলে বহু বৈধ ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এবং তাদের বিহার মিত্র রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) রোববার বিহারে বন্ধের ডাক দিয়েছে। পাশাপাশি তারা সুপ্রিম কোর্টে এই উদ্যোগ বাতিলের আবেদন জানিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক মুসলিম অভিবাসী ভারতে ঢুকছে বলে দাবি করে আসছে। দলটি চাচ্ছে, দেশজুড়ে একইভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হোক।
নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপের যৌক্তিকতা কী?
২৪ জুনের আদেশে ইসিআই বলেছে, ‘কোনো অযোগ্য ব্যক্তি যেন ভোটার তালিকায় না থাকে’ তা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ। দ্রুত নগরায়ণ, অভিবাসন, নতুন ভোটার, মৃত ভোটার এবং বিদেশি অবৈধ অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলো এই পদক্ষেপের পেছনে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এর আগে ২০০৩ সালে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা সংশোধন হয়েছিল। এর পর থেকে নিয়মিতই তালিকা হালনাগাদ হয়েছে, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগেও তা করা হয়েছিল। ইসিআই জানিয়েছে, যারা ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় ছিলেন, তাদের শুধু পুনরায় ফরম জমা দিলেই চলবে। তবে ২০০৩ সালের পর যারা তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের বয়স ও জন্মস্থান প্রমাণের জন্য নথিপত্র, এমনকি বাবা-মায়ের প্রমাণপত্রও জমা দিতে হবে।
ইসিআইয়ের হিসাবে, প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি নাগরিককে যাচাই করতে হবে। কিন্তু স্বাধীন বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটিরও বেশি হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় ইসিআইয়ের কর্মকর্তারা ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের একটি ফরম দেবেন। এরপর ভোটারদের সেই ফরমে প্রয়োজনীয় নথি সংযুক্ত করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে। ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে। ১ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং বাদ পড়া ব্যক্তিদের আপত্তি জানানোর জন্য আরও এক মাস সময় দেওয়া হবে।
ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মসের প্রতিষ্ঠাতা জগদীপ চোকার বলেন, ২০০৩ সালের পর যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখায় এই পদক্ষেপ। তাহলে কি ইসিআই বলছে, বিহারে ২০০৩ সালের পর যত নির্বাচন হয়েছে, সবই প্রশ্নবিদ্ধ?
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, লাখ লাখ বৈধ ভোটার নথি দেখাতে না পারায় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। এতে ভারতের গণতন্ত্র বড়সড় এক সংকটে পড়বে বলেই মনে করছেন তারা। এ নিয়ে জগদীপ চোকারের সংস্থাই প্রথম এই উদ্যোগ বন্ধ করতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। তিনি বলেন, এর ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। এভাবে চললে রাজ্যের অর্ধেক মানুষের ভোটাধিকারই বাতিল হয়ে যেতে পারে।