গাজা উপত্যকায় গড়ে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন মানুষ নিহত হয়। এটা অবশ্য সাধারণ দিনের কথা। আশীর্বাদপুষ্ট দিনগুলোতে ‘ফলন’বেশিই হয়— ১০০ থেকে ১৫০জন মারা পড়ে! দুনিয়ার আর কোনো কসাইখানায় এত বিপুল পরিমাণ মরদেহ মেলে না। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুসারে ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ থেকে মানে সাময়িক যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল যেদিন থেকে আবার আক্রমণ শুরু করল সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত (২২ জুলাই, ২০২৫) উপত্যকায় অন্তত ৮,২৬৮ জন নিহত হয়েছ আর এর তিনগুণ আহত হয়েছে।

স্বীকৃত সংজ্ঞা [হিব্রু বাইবেলের আদি পুস্তক] অনুসারে, গাজার ভুক্তভোগীরা অন্য সব মানুষের মতোই জন্ম নিয়েছে এবং তা ‘তাঁর প্রতিমূর্তি’ হিসেবে। এটা এক বিরাট সমস্যা। কারণ, যারা ‘তাঁর প্রতিমূর্তি’ হিসেবে জন্ম নিয়েছে, তাদের হত্যা করা জঘন্য পাপ। যদি ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি ধ্বংস করা হয়, তাহলেতো ঈশ্বর খুনিদের হৃদয় পরিত্যাগ করবেন।

বিষয়টা তাহলে উভয়সংকট তৈরি করেছে। আমি অবশ্য ধারণা করি যা সময়ের পরিক্রমায় তা কেটে যাবে। তার আগে অবশ্য এক চাতুর্যপূর্ণ ব্যবধানের তত্ত্ব হাজির করা হবে এই ব্যাখ্যা দিয়ে যে সকল মানুষ ঠিক ‘তাঁর প্রতিমূর্তি’ হিসেবে জন্ম নেয়নি; কিছু মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে জন্ম নিয়েছে, আর বাকিদের জন্ম হয়েছে কোনো দানবের প্রতিমূর্তিতে।

এখানে অবশ্য একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে যে আমালেক জাতির মানুষেরা কার প্রতিমূর্তিতে জন্ম নিয়েছিল? [আমালেক হচ্ছে মুসা নবীর সময় কেনানে (আজকের ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্ডানের কিছু এলাকা) বসবাসকারী এক শক্তিধর জনগোষ্ঠী যাদের হিব্রু বাইবেলে ইহুদির অন্যতম শত্রু হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।]

বলতে গেলে উল্লিখিত উভয়সংকট উত্তরণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। নতুন ইসরায়েলি অভিধানে ঈশ্বরকে তাঁর প্রতিমূর্তি থেকে আলাদা করার জন্য একের পর এক পরিভাষা যোগ করা হয়েছে। এসব নতুন সংজ্ঞা অনুসারে, ফিলিস্তিনিরা তো ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি হওয়া থেকে অনেক দূরে; তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ’সন্ত্রাসী’, ’জঙ্গি’, ‘গাজায় নিরীহ কেউ নেই’ ইত্যাদি হিসেবে। বেশি দিন আগের কথা নয়, ফিলিস্তিনিদের ‘দু’পেয়ে জানোয়ার’ হিসেবেও পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কারণ, জৈবগত এক মারাত্মক ভুলে তাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে!

হিব্রু ভাষা বিকশিত হচ্ছে। আর ফিলিস্তিনি জনগণকে বিবর্ণ ও কলঙ্কিত করার গতিও বেড়ে চলেছে। ইসরায়েল সরকারের অনানুষ্ঠানিক মুখপত্র হিসেবে পরিচিত চ্যানেল ফোরটিন দেখলেই যে কেউ বুঝবে যে ঘটনাটা কী ঘটছে।

তারপর এখানে-সেখানে সমস্যা লেগেই আছে। গাজার কসাইখানায় এত বিপুল সংখ্যক জবাই করা দেহ সামাল দেওয়ার মতো কোনো সুব্যবস্থা নেই। ফলে  স্বাস্থ্য বিধিগত ও পরিচ্ছন্নতাজনিত বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে।

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে কুকুররা ফিলিস্তিনিদের মরদেহ ভক্ষণ করছে। একটি আধুনিক রাষ্ট্র হোক বা তৃতীয় বিশ্বের দেশ হোক, আজকে এ ধরনের ঘটনা কি লজ্জাজনক নয়? পশু অধিকার রক্ষায় সোচ্চার সংগঠনগুলো আজ কোথায়? কীভাবে আমরা এমন একপর্যায়ে পৌঁছালাম যে কুকুরের মানুষের মরদেহের স্তূপে খাবার খুঁজে বেড়ায়?

কিন্তু আমাদেরতো উচিত মূল বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া। খবরে একশজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার বিষয়টি শোনা তাদের পরিণতি দেখার বিকল্প হতে পারে না। ঘটনার সত্যিকার গভীরতা উপলব্ধির জন্য স্বচক্ষে দেখাও যথেষ্ট নয়। ‘একশজন নিহত হয়েছে’ বলার মানে হলো মুখ থেকে কানে পৌঁছাতে কথাটি বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়ার পর দ্রুত তা উবে যাওয়া।

একটি ভিডিও হয়তো [জনমানসে] শক্তিশালী ছাপ ফেলতে পারে। কিন্তু নরকের বিবরণ নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে হলে সেখানে আসলে সাংবাদিকদের যেতে হবে এবং দেখতে হবে ক্ষতবিক্ষত দেহ, প্রবহমান রক্ত আর দেয়ালে ঝুলে থাকা একটি হাত। এটি কার হাত? বা কার ছিন্নভিন্ন পা? দেখতে হবে যে মাথাতো আর মাথা নেই, নিজ কানে শুনতে হবে অসহনীয় যন্ত্রণার কাতর আর্তনাদ। দেখতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত-বিকৃত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রদর্শনীর মাঝে প্রাণের স্পন্দন আর লক্ষ্য করতে হবে কীভাবে তাদের নিচে বালু রক্ত শুষে নেওয়া থামিয়ে দিয়েছে। এটাই প্রতীয়মান হবে যে সোনার বালু এহেন নিষ্ঠুর কাজের জন্য জন্ম নেয়নি।

আরেকটি প্রশ্ন হলো: কীভাবে কেউ এই শ খানেক মৃত ও আহতদের সামাল দেবে? আমরা কি নিশ্চিত যে একটি দেহ সত্যিই প্রাণহীন হয়ে পড়েছে? অথবা এটি আহত কোনো ব্যক্তির যে অজ্ঞান হয়ে পড়লের প্রাণের স্পন্দন ফুরিয়ে যায়নি? তাছাড়া গাজাতো বিশ্বের সবচেয়ে গরম স্থানগুলোর একটি। তাহলে এটা ভাবা যে এহেন উত্তাপ মরদেহগুলোর, জমাট বাধা রক্তের এবং মশা ও মাছি ঘিরে ধরা আহতদের কী অবস্থা করেছে? ঠিক এখানেইতো নরক।

গাজায় হত্যার ময়দানগুলো এবং সারা দুনিয়া আচ্ছন্ন হয়ে আছে এক রহস্যদাঘটন আবহে। [১৯৯৮ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী] পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগো তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস বালতাসার অ্যান্ড ব্লিমুডা-তে লিখেছিলেন: ‘কেউ স্বর্গ ও নরক আবিষ্কার করতে চাইলে তাকে অবশ্যই মানবদেহ সম্পর্কে জানতে হবে।’ গাজা উপত্যকায় নরক তার জায়গা খুঁজে পেয়েছে; আর স্বর্গ এই এলাকা থেকে অনেক দূরে রয়েছে।

ওদেহ বিশারাত আরব-ইসরায়েলি লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজে  প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছন আসজাদুল কিবরিয়া

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন ম ন য় ছ ইসর য় ল মরদ হ অবশ য

এছাড়াও পড়ুন:

চট্টগ্রামে অঝোরে বৃষ্টি, রাস্তায় পানি, আশঙ্কা পাহাড়ধসের

চট্টগ্রাম নগরে আজ বৃহস্পতিবার ভোর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে নগরের কয়েকটি এলাকায় পানি জমে গেছে। ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

ভোর পাঁচটার দিকে চট্টগ্রামে বৃষ্টি শুরু হয়। সকাল ৯টা নাগাদ বৃষ্টির তীব্রতা বেড়ে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৃষ্টি ঝরছে।

টানা বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম নগরের সড়কগুলোয় যানবাহনের সংখ্যা বেশ কম দেখা গেছে। ব্যস্ততম মোড়গুলোয় যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা সিএনজিচালিত অটোরিকশা আর রিকশাও ছিল কম। এতে ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামী মানুষজন। এ ছাড়া সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে যেসব অভিভাবক বাইরে বের হয়েছেন, তাঁদেরও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা যায়। দীর্ঘ সময় পর যানবাহন পেলেও অনেকে বাড়তি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে ছোটেন।

আবহাওয়ায় অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পতেঙ্গা কার্যালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা) চট্টগ্রামে ৫৭ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আরও দুই থেকে তিন দিন বৃষ্টি হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রামে পাহাড় ও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।

টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কে পানি জমেছে। এ কে খান সি–গেট এলাকা, চট্টগ্রাম, ৩১ জুলাই, সকাল সাড়ে ১০টায় তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ