গাজায় ‘অনাহারের মাধ্যমে জাতিগত নিধন’ চালাচ্ছে ইসরায়েল, দ্রুত মারা যাবে শিশুরা: দুর্ভিক্ষ–বিশেষজ্ঞ ডি ওয়াল
Published: 25th, July 2025 GMT
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল ‘অনাহার সৃষ্টির মাধ্যমে জাতিগত নিধন’ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন খ্যাতনামা দুর্ভিক্ষ–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যালেক্স ডি ওয়াল। উপত্যকাটিতে অবরোধের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর ২১ মাসের বেশি সময়ে গাজায় অন্তত ১২২ ফিলিস্তিনি অনাহার ও অপুষ্টিতে মারা গেছেন, তাঁদের অধিকাংশই শিশু। এ ছাড়া গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের বিতর্কিত একটি সংস্থার ত্রাণকেন্দ্র থেকে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
গাজায় জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। উপত্যকাটিতে টানা ১১ সপ্তাহের অবরোধের পর গত ২৬ মে কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি। শুরু থেকেই সংস্থাটির কার্যক্রমের সমালোচনা করে আসছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। জিএইচএফের দেওয়া খাবারের মান ও পরিমাণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গত মঙ্গলবার মিডল ইস্ট আইয়ের এক অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ডি ওয়াল বলেন, গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করার মতো অবস্থায় নেই জাতিসংঘ। কারণ, ইসরায়েলের বাধার কারণে ত্রাণকর্মী ও অনুসন্ধানকারীরা সেখানে প্রবেশ করতে পারছেন না। এর ফলে ক্ষুধার ভয়াবহতা যাচাই করে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে না।
ডি ওয়াল বলেন, ‘আপনি যদি কোথাও পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে চান, তাহলে তুলনামূলকভাবে সহজ কাজটা হলো, আপনি প্রথমে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করে দেবেন। তারপর বলবেন, দেখুন, কেউ তো দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেনি।’ তিনি আরও বলেন, দুর্ভিক্ষ গোপন করাও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করার একটি কৌশল। গাজায় ঠিক যেভাবে অনুমান করা হয়েছিল, সেভাবেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিচ্ছে।
অ্যালেক্স ডি ওয়াল ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। এই প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে সংযুক্ত। তিনি ‘মাস স্টারভেশন: দ্য হিস্টরি অ্যান্ড ফিউচার অব ফ্যামিন’ বইয়ের লেখক।
বাবার কোলে অপুষ্টিতে ভোগা ১৩ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি শিশু। গাজার বুরেইজ শরণার্থীশিবিরে। ১২ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে।
প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ।
জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন?
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।
● অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক
দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত