আজকের বৈশ্বিক রাজনীতিতে আবার জোরালোভাবে ফিরে এসেছে ‘হার্ড পাওয়ার’ বা বলপ্রয়োগের কৌশল; যদিও এই শক্তির গুরুত্ব কখনো পুরোপুরি কমে যায়নি এবং ভবিষ্যতেও কমবে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সামরিক শক্তি সব সময়ই একটি প্রধান অস্ত্র হিসেবে থেকে যাবে।

একসময় আশা করা হয়েছিল, যুদ্ধ আর হবে না; বিশেষ করে রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ মেটানোর উপায় হিসেবে যুদ্ধকে আর আগের মতো বেছে নেওয়া হবে না। তখন ভাবা হয়েছিল, জোরপ্রয়োগ বা যুদ্ধ হবে কেবল শেষ উপায়। তখন আশা ছিল, সামরিক বা অর্থনৈতিক চাপ নয়, বরং সংলাপ ও কূটনীতি হবে দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান মাধ্যম। তখন মনে করা হচ্ছিল, ‘সফট পাওয়ার’ বা বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার হবে পরাশক্তিগুলোর বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ানোর মূল কৌশল।

আরও পড়ুনট্রাম্প কি বিশ্বের সব ডানপন্থী নিয়ে জোট গড়তে চান১৭ জুলাই ২০২৫

কিন্তু আজকের বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। বড় বড় দেশ ও আঞ্চলিক শক্তি এখন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্য দেশগুলোকে নিজেদের ইচ্ছার অধীন করার চেষ্টা করছে। এখন বলপ্রয়োগ প্রথম অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে, শেষ অস্ত্র নয়। বিরোধ নিষ্পত্তি ও অন্যের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রধান কৌশল হয়ে উঠেছে বলপ্রয়োগ।

আজকের পৃথিবীতে এর অনেক উদাহরণ আছে। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ; ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে তাদের হামলা; রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসন; যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে বোমাবর্ষণ; ভারতের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান—সবই এ প্রবণতার প্রমাণ।

অনেকে বলছেন, সফট পাওয়ার এখন পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু এর উত্তর হলো—না। সফট পাওয়ার এখনো আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এসবই আন্তর্জাতিক আইন ও বলপ্রয়োগের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে হয়েছে। যারা এটি করেছে, তারা দায়মুক্তি ভোগ করেছে। এতে বিশ্বব্যবস্থা আরও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও নিয়মনীতি দুর্বল হয়েছে। বলপ্রয়োগ কমানোর জন্য যে বৈশ্বিক নিয়ম ছিল, তা আজ ইচ্ছাকৃতভাবে অমান্য করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনট্রাম্প কেন উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞানসাধনাকে শত্রু ভাবছেন০৯ জুন ২০২৫

শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করেও হার্ড পাওয়ারের ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন তার একটি উদাহরণ। ট্রাম্প সারা দুনিয়ার দেশগুলোর ওপর উচ্চ শুল্ক বসিয়ে একরকম বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন। ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হলো ভয় দেখিয়ে ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে অন্যদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা। এ ক্ষেত্রে মিত্র আর প্রতিপক্ষ—কাউকেই তিনি ছাড় দিচ্ছেন না। সবাইকে আবার বাণিজ্য চুক্তি করতে বাধ্য করা হয়েছে।

এভাবে যুক্তরাষ্ট্র বার্তা দিচ্ছে, তাদের দাবিতে রাজি না হলে বড় মূল্য দিতে হবে। এর ফলাফল হলো, কেবল বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থা নয়, বরং দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্কের প্রচলিত নিয়মগুলোও ভেঙে পড়ছে। তবে কি এর মানে ‘সফট পাওয়ার’ এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়? কূটনীতি কি মূল্য হারাচ্ছে? অন্যদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে সম্পর্ক গড়া কি এখন বাতিল হয়ে গেছে? অনেকে বলছেন, সফট পাওয়ার এখন পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু এর উত্তর হলো—না। সফট পাওয়ার এখনো আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি দেশগুলোর জন্য অন্যদের প্রভাবিত করার এবং ভাবমূর্তি গড়ার বড় অস্ত্র।

এমনকি যখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ হার্ড পাওয়ার ব্যবহার করছে, তখন চীন সফট পাওয়ারের কৌশলকে আরও জোর দিচ্ছে। এটা তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। এর ফলে তারা বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াতে পারছে, অন্যান্য দেশের আস্থা অর্জন করছে এবং আরও বেশি সহযোগিতা পাচ্ছে। এ কারণে চীন এখন বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ‘গ্লোবাল সফট পাওয়ার ইনডেক্স’-এ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

এই র‍্যাঙ্কিং তৈরি করেছে লন্ডনের ব্র্যান্ড ফাইন্যান্স নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। চীনের বড় কূটনৈতিক কৃতিত্ব হলো সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে মধ্যস্থতা করা। এটিও তাদের সফট পাওয়ার বাড়িয়েছে।

যিনি সফট পাওয়ার ধারণাটি প্রথম পরিচিত করেছিলেন, সেই জোসেফ নাই কিছুদিন আগে রবার্ট কিওহানের সঙ্গে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ট্রাম্প সফট পাওয়ারের গুরুত্ব বুঝতেন না। তিনি কেবল বলপ্রয়োগে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এটা দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর নয়। কারণ, যদি কোনো দেশ আকর্ষণীয় হয়, তাহলে তাকে অন্যদের প্রভাবিত করতে শাস্তি বা লোভ দেখানোর খুব বেশি দরকার পড়ে না। যদি মিত্রদেশগুলো তাকে বিশ্বস্ত ও নিরীহ মনে করে, তাহলে তারা সহজেই তার নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে।

মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ক র জন ত এখন ব

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।

সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।

ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ