বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র কী পেতে যাচ্ছে
Published: 4th, August 2025 GMT
পাল্টা শুল্কের ঘোষিত হার ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শুল্ক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাসম্পদ, আমদানি, সেবা খাত, পরিবেশ ও শ্রম অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ছাড় দিতে রাজি হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার পাল্টা শুল্কের এই হার ঘোষণার পর উভয় পক্ষ এখন চুক্তি করার দিকে এগোচ্ছে। চুক্তির সম্ভাব্য নাম ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ পারস্পরিক বাণিজ্যচুক্তি।’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্যগুলো জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সব চাওয়া বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গত রাতে ওয়াশিংটন থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘না। সব মেনে নেওয়া সম্ভব না বলেই আমরা লম্বা সময় ধরে দর-কষাকষি করলাম।’
সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করবে, সেগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক (সিডি), সম্পূরক শুল্ক (এসডি) এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) কমাবে বাংলাদেশ। তবে এ ব্যাপারে আইন সংশোধন করতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিডি ও এসডি কমানোর ক্ষেত্রে আইন সংশোধনের প্রশ্ন এসে যায়। তবে সেই পর্যায় এখনো আসেনি। দেখা যাক।’
জানা গেছে, কিছু খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের ওপর বাংলাদেশের যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা বাংলাদেশ বাদ দেবে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জন্য অনাপত্তিপত্রও সহজ করা হবে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধন যাতে সহজে আসতে পারে এবং বাংলাদেশ থেকে সে দেশে যেতে পারে, তার অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ করতে বাংলাদেশ নির্দেশিকা প্রণয়ন করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান কোম্পানিগুলোর বকেয়া পাওনা দ্রুত পরিশোধ করবে।
সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক পণ্য, বেসামরিক উড়োজাহাজ ও যন্ত্রাংশ আমদানি বাড়াবে বাংলাদেশ এবং জ্বালানি তেল ও ভোজ্যতেল, গম ও তুলা আমদানি বাড়ানো এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ অবৈধ রপ্তানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ তদন্ত করবে। বাংলাদেশ এতে রাজি। এ ছাড়া জনমত গ্রহণের সুযোগ নিতে বাংলাদেশ আইন ও বিধিমালা অনলাইনে সহজলভ্য করার পাশাপাশি প্রস্তাবিত আইন ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করবে।
সূত্রমতে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ বার্ষিক আমদানি লাইসেন্সিং প্রতিবেদন ডব্লিউটিওতে জমা দেবে। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য বা কৃষিপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি অনুমতিপত্র বাধ্যতামূলক করবে না। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রনিক বিল অব লেডিংয়ের বৈধতা অস্বীকার করবে না এবং দেশটি থেকে আসা স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য দ্রুত ছাড় করবে।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাসম্পদ, আমদানি, সেবা খাত, পরিবেশ ও শ্রম অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ছাড় দিচ্ছে। ছাড় দিতে রাজি হওয়ার ফলেই বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে ২০% করেছে যুক্তরাষ্ট্র।জানা গেছে, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) যে অনুমোদন দেবে, তা বাংলাদেশ মেনে নেবে। এফডিএর ইলেকট্রনিক সনদকেও গ্রহণ করবে বাংলাদেশ। এ জন্য সংস্থাটি থেকে হার্ড কপি, মূল কপি, সত্যায়িত কপি বা হাতে লেখা কপি দাবি করবে না। আন্তর্জাতিক মেডিকেল ডিভাইস রেগুলেটরস ফোরামের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করবে বাংলাদেশ।
সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের দুগ্ধ নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং মাংস ও পোলট্রি, প্রক্রিয়াজাত মাংস ও ডিমজাত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে স্বীকৃতি এবং দেশটির গরু, ভেড়া বা ছাগলের দুগ্ধজাত পণ্য আমদানির অনুমতি দেবে বাংলাদেশ। যদি কোনো মার্কিন পণ্যে সমস্যা দেখা দেয়, তবে বাংলাদেশ দেরি না করে যুক্তরাষ্ট্র বা তৃতীয় দেশের ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও অনুমোদন বিবেচনায় নেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেবে।
মারাত্মক সংক্রামক বার্ড ফ্লু রোধে বাংলাদেশ বিশ্ব পশু স্বাস্থ্য সংস্থার বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো বিধান আরোপ তো করবেই না, বজায়ও রাখবে না—এমন শর্ত বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে বলে জানা গেছে। চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশাধিকারের জন্য আবেদন জমা দিলে ১৮ মাসের মধ্যে তা অনুমোদন করবে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া হচ্ছে, এখনো যদি না করে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করবে। এগুলো হচ্ছে বার্ন কনভেনশন, ব্রাসেলস কনভেনশন, বুদাপেস্ট চুক্তি, হেগ চুক্তি, মাদ্রিদ প্রটোকল, মারাকেশ চুক্তি, প্যারিস কনভেনশন, পেটেন্ট কো–অপারেশন চুক্তি, সিঙ্গাপুর চুক্তি, নতুন জাতের উদ্ভিদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন (ইউপিওভি) ১৯৯১, বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার কপিরাইট চুক্তি এবং ডব্লিউআইপিও পারফরম্যান্স ও ফোনোগ্রাম চুক্তি।
এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং দুর্নীতিবিরোধী পরিকল্পনা ও বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কথা অনলাইনে প্রকাশ করবে। ডব্লিউটিওর মৎস্য ভর্তুকি চুক্তি মেনে চলবে বাংলাদেশ, অবৈধ মাছ ধরায় ভর্তুকি দেবে না এবং দীর্ঘ মেয়াদে সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষণে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা নীতিমালায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মতামত বিবেচনায় নেওয়া, সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা এবং ২০২১ সালের সোশ্যাল মিডিয়া ও ওভার দ্য টপ (ওটিটি) আইন সংশোধন বা বাতিল করার প্রতিশ্রুতিও দেয় বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সাধারণ বিমা করপোরেশনের সঙ্গে বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর যে ৫০ শতাংশ পুনর্বিমা করার বাধ্যবাধকতা আছে, এ বিধানের বাতিল চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ নিয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে বলেন, পুনর্বিমার বিষয়ে আইন সংশোধন দরকার এবং ইতিমধ্যে সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল দ শ য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র র স ত রগ ল ব যবস থ আমদ ন র র জন য স রক ষ প রক শ র ওপর ন করব হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
কলকাতায় এনআরসি আতঙ্কে আত্মহত্যা
এনআরসি আতঙ্কে কলকাতায় আত্মহত্যা করেছেন এক ব্যক্তি। রবিবার (৩ আগস্ট) সকালে রিজেন্ট পার্ক এলাকার আনন্দপল্লী পশ্চিমের বাসিন্দা দিলীপ সাহা নামে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়।
পরিবারের সদস্যদের দাবি, সম্প্রতি বিজেপি সরকার এসআরআর করার মাধ্যমে ঘুরপথে এনআরসি কার্যকর করবে এমন আশঙ্কায় আতঙ্কে ভুগছিলেন ওই ব্যক্তি। ১৯৭২ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে কলকাতায় আসেন তিনি। কলকাতা বেসরকারি স্কুলে চাকরি করতেন তিনি। তাকে আবার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এই আতঙ্কেই নিজেকে শেষ করেছেন বলে দাবি পরিবারের ।
পরিবারের লোকজন দাবি করছেন, এনআরসি আতঙ্কে আট বছর ধরে আতঙ্কিত ছিলেন। সম্প্রতি এসআইআর ও বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলাদেশিদের ধরপাকড় নিয়ে তার আতঙ্ক চরমে পৌঁছায়। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সবসময় ভয়ে থাকতেন এবং এনআরসি আতঙ্কের কথা তিনি সকলকেই বলতেন। টিভিতে এনআরসি সংক্রান্ত ইস্যুতে খবর দেখে তার আতঙ্ক আরো চেপে বসে। পরিবারসহ তাকে যেকোনো সময় বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে এই আতঙ্ক তাকে তাড়া করত। এই আতঙ্ক তাকে এতটাই গ্রাস করে ফেলে যে, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
আরো পড়ুন:
বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলায় ক্ষুব্ধ মমতা
১২৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে জিততে পারবে কি ইংল্যান্ড?
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অন্তত ৩০ বছর ধরে সপরিবারে রিজেন্ট পার্ক এলাকায় থাকতেন দিলীপ কুমার সাহা। স্ত্রী-ছেলে-পুত্রবধূ নাতনি সকলকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতেন। একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করতেন তিনি। ছয় বোনের একমাত্র ভাই তিনি। সকলেই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। কলকাতায় এসে বিয়ে, সংসার ইত্যাদি হয় তাদের। এনআরসি ইস্যু এবং পুশব্যাক করে দেওয়ার আতঙ্ক তাড়া করত। এর জেরে তার শরীর খারাপ হয়েছিল।
রবিবার সকালে তাঁর স্ত্রী বেশ কয়েকবার দিলীপ সাহাকে ডেকেছিলেন। কিন্তু বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাননি। এরপর তিনি পাশের একটি বাড়ি থেকে তার ভাগ্নিকে ডাকেন। এরপর তারা দরজা ভেঙে তাকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান।
এরপরই পরিবারের এক সদস্যের ভিডিওসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। সেখানে আক্রমণ করা হয় বিজেপি সরকারকে।
পোস্টে রাজ্যের শাসক দলের তরফে লেখা হয়, “বিজেপির আতঙ্কে আত্মহত্যা কলকাতার টালিগঞ্জের এক বাসিন্দার। বিজেপি দেশজুড়ে যেভাবে বাঙালি জাতির ওপর আক্রমণ শুরু করেছে, বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও এনআরসির নোটিশ পাঠাচ্ছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, এসআইআর করে ভোটাধিকার কেড়ে নিচ্ছে- এই সব কিছুর আতঙ্কে দিন গুজরান করতে করতে শেষমেষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন এক বাসিন্দা। একটা জনবিরোধী, বাংলা-বিরোধী দল কীভাবে বাঙালিকে শেষ করে দিতে চাইছে নিজের চোখেই দেখুন, ছিঃ বিজেপি ছিঃ।”
এদিকে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, “কেউ কোথাও আত্মহত্যা করলেই এনআরসি আতঙ্ক বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে শাসক দলের এত নেতা-কর্মী রোজ মারা যায় তাও কী আতঙ্কে মারা যাচ্ছেন?”
ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ