পাল্টা শুল্কের ঘোষিত হার ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শুল্ক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাসম্পদ, আমদানি, সেবা খাত, পরিবেশ ও শ্রম অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ছাড় দিতে রাজি হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার পাল্টা শুল্কের এই হার ঘোষণার পর উভয় পক্ষ এখন চুক্তি করার দিকে এগোচ্ছে। চুক্তির সম্ভাব্য নাম ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ পারস্পরিক বাণিজ্যচুক্তি।’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্যগুলো জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সব চাওয়া বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গত রাতে ওয়াশিংটন থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘না। সব মেনে নেওয়া সম্ভব না বলেই আমরা লম্বা সময় ধরে দর-কষাকষি করলাম।’

সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করবে, সেগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক (সিডি), সম্পূরক শুল্ক (এসডি) এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) কমাবে বাংলাদেশ। তবে এ ব্যাপারে আইন সংশোধন করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিডি ও এসডি কমানোর ক্ষেত্রে আইন সংশোধনের প্রশ্ন এসে যায়। তবে সেই পর্যায় এখনো আসেনি। দেখা যাক।’

জানা গেছে, কিছু খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের ওপর বাংলাদেশের যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা বাংলাদেশ বাদ দেবে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জন্য অনাপত্তিপত্রও সহজ করা হবে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধন যাতে সহজে আসতে পারে এবং বাংলাদেশ থেকে সে দেশে যেতে পারে, তার অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ করতে বাংলাদেশ নির্দেশিকা প্রণয়ন করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান কোম্পানিগুলোর বকেয়া পাওনা দ্রুত পরিশোধ করবে।

সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক পণ্য, বেসামরিক উড়োজাহাজ ও যন্ত্রাংশ আমদানি বাড়াবে বাংলাদেশ এবং জ্বালানি তেল ও ভোজ্যতেল, গম ও তুলা আমদানি বাড়ানো এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ অবৈধ রপ্তানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ তদন্ত করবে। বাংলাদেশ এতে রাজি। এ ছাড়া জনমত গ্রহণের সুযোগ নিতে বাংলাদেশ আইন ও বিধিমালা অনলাইনে সহজলভ্য করার পাশাপাশি প্রস্তাবিত আইন ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করবে।

সূত্রমতে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ বার্ষিক আমদানি লাইসেন্সিং প্রতিবেদন ডব্লিউটিওতে জমা দেবে। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য বা কৃষিপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি অনুমতিপত্র বাধ্যতামূলক করবে না। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রনিক বিল অব লেডিংয়ের বৈধতা অস্বীকার করবে না এবং দেশটি থেকে আসা স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য দ্রুত ছাড় করবে।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাসম্পদ, আমদানি, সেবা খাত, পরিবেশ ও শ্রম অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ছাড় দিচ্ছে। ছাড় দিতে রাজি হওয়ার ফলেই বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে ২০% করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

জানা গেছে, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) যে অনুমোদন দেবে, তা বাংলাদেশ মেনে নেবে। এফডিএর ইলেকট্রনিক সনদকেও গ্রহণ করবে বাংলাদেশ। এ জন্য সংস্থাটি থেকে হার্ড কপি, মূল কপি, সত্যায়িত কপি বা হাতে লেখা কপি দাবি করবে না। আন্তর্জাতিক মেডিকেল ডিভাইস রেগুলেটরস ফোরামের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করবে বাংলাদেশ।

সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের দুগ্ধ নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং মাংস ও পোলট্রি, প্রক্রিয়াজাত মাংস ও ডিমজাত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে স্বীকৃতি এবং দেশটির গরু, ভেড়া বা ছাগলের দুগ্ধজাত পণ্য আমদানির অনুমতি দেবে বাংলাদেশ। যদি কোনো মার্কিন পণ্যে সমস্যা দেখা দেয়, তবে বাংলাদেশ দেরি না করে যুক্তরাষ্ট্র বা তৃতীয় দেশের ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও অনুমোদন বিবেচনায় নেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেবে।

মারাত্মক সংক্রামক বার্ড ফ্লু রোধে বাংলাদেশ বিশ্ব পশু স্বাস্থ্য সংস্থার বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো বিধান আরোপ তো করবেই না, বজায়ও রাখবে না—এমন শর্ত বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে বলে জানা গেছে। চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশাধিকারের জন্য আবেদন জমা দিলে ১৮ মাসের মধ্যে তা অনুমোদন করবে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া হচ্ছে, এখনো যদি না করে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করবে। এগুলো হচ্ছে বার্ন কনভেনশন, ব্রাসেলস কনভেনশন, বুদাপেস্ট চুক্তি, হেগ চুক্তি, মাদ্রিদ প্রটোকল, মারাকেশ চুক্তি, প্যারিস কনভেনশন, পেটেন্ট কো–অপারেশন চুক্তি, সিঙ্গাপুর চুক্তি, নতুন জাতের উদ্ভিদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন (ইউপিওভি) ১৯৯১, বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার কপিরাইট চুক্তি এবং ডব্লিউআইপিও পারফরম্যান্স ও ফোনোগ্রাম চুক্তি।

এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং দুর্নীতিবিরোধী পরিকল্পনা ও বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কথা অনলাইনে প্রকাশ করবে। ডব্লিউটিওর মৎস্য ভর্তুকি চুক্তি মেনে চলবে বাংলাদেশ, অবৈধ মাছ ধরায় ভর্তুকি দেবে না এবং দীর্ঘ মেয়াদে সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষণে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।

ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা নীতিমালায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মতামত বিবেচনায় নেওয়া, সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা এবং ২০২১ সালের সোশ্যাল মিডিয়া ও ওভার দ্য টপ (ওটিটি) আইন সংশোধন বা বাতিল করার প্রতিশ্রুতিও দেয় বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সাধারণ বিমা করপোরেশনের সঙ্গে বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর যে ৫০ শতাংশ পুনর্বিমা করার বাধ্যবাধকতা আছে, এ বিধানের বাতিল চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ নিয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে বলেন, পুনর্বিমার বিষয়ে আইন সংশোধন দরকার এবং ইতিমধ্যে সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল দ শ য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র র স ত রগ ল ব যবস থ আমদ ন র র জন য স রক ষ প রক শ র ওপর ন করব হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে বইমেলায় বিক্রি কম, এখনো আশায় আছেন প্রকাশকেরা

রাজশাহী বিভাগীয় বইমেলার প্রথম তিন দিনে লোকজনের ভিড় থাকলেও বেচাকেনা তেমন হয়নি। এতে অনেক প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকেরা ও আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা কালেক্টরেট মাঠে ৯ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে এবং রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ মেলা চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০টি বেসরকারি প্রকাশনাসহ মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে মেলা চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়।

উদ্বোধনের আগের দিন বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। সেই কর্দমাক্ত পরিবেশেই মেলার উদ্বোধন হয়। দর্শনার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পরে প্রতিটি স্টলের সামনে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বিক্রির খরা কাটেনি বলে জানালেন বিক্রেতারা।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন অংশে তখনো পানি জমে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলেও কাদা। সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। স্টলের সামনে ইটের সলিংয়ের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন অনেকে। অনেকে বই দেখছেন।

সূর্যোদয় প্রকাশনীর বিক্রেতা রিপন আলী বলেন, প্রথম দিন তো কাদাপানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো মানুষ ছিলেন। এখন ইট বিছানোর পর আরও বেশি মানুষ আসছেন, ভিড়ও করছেন, কিন্তু বই কিনছেন খুব কম।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে কাদার ওপর চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল বিক্রয়কর্মী ও চিত্রশিল্পী অর্ণব পাল সন্তুকে। তিনি বলেন, মানুষ আসছেন, ঘুরে দেখছেন, কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। মেলার ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতে পারত। আরেক বিক্রেতা আবদুল্লাহ হীল বাকি জানালেন, এমনও স্টল আছে, যেখানে সারা দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বইও বিক্রি হচ্ছে না।

তবে হতাশার ভিড়ে আশার কথাও শোনালেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম থেকে আসা নন্দন বইঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, বেচাবিক্রি আজ না হোক কাল হবে। মানুষ যে মেলায় এসে বই হাতে নিয়ে দেখছেন, এটাই বড় পাওয়া। এতে তাঁদের মধ্যে বই কেনার আগ্রহ তৈরি হবে।

মেলায় আসা পাঠকদের মধ্যে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। দুই সন্তানের জন্য শিশুতোষ বই কিনে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম।
মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের বই কিনেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় একসঙ্গে অনেক বই পাওয়া যায়, যা বই কেনার জন্য দারুণ সুযোগ।

রাজশাহী কালেক্টরেট মাঠে বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ