ফেনীতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তি হলো আজ। গত বছরের ৪ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপাল এলাকায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে সাতজন আন্দোলনকারী নিহত হন। এর এক দিন পর ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের। সরকার পরিবর্তন হলেও গত এক বছরে ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতা হত্যার মূল আসামিদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। সেদিনের ঘটনায় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে অস্ত্র হাতে ছবি ছাপা হয়েছে ও প্রত্যক্ষদর্শীরা গুলি চালাতে দেখেছেন এমন ৩০ জনের মধ্যে কেবল দুজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।

অস্ত্রধারীদের পাশাপাশি ফেনীতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম আসা সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও কেউ গ্রেপ্তার হননি। এ ঘটনায় ব্যবহৃত দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এ অবস্থায় সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা।

কী ঘটেছিল সেদিন

কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৪ আগস্ট সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপাল এলাকায় জড়ো হতে থাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সদস্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। আন্দোলনকারীরা মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে জড়ো হয়ে স্লোগান দেন। একপর্যায়ে বেলা একটায় জোহরের আজান দিলে মহাসড়কে নামাজ আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীরা।

বেলা একটার পর নিজাম উদ্দিন হাজারীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ শুরু করেন। তাঁদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে ঘটনাস্থলেই মারা যান শিক্ষার্থীসহ পাঁচজন। গুলিবিদ্ধ হন শতাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।

ঘণ্টাব্যাপী হামলার পর অস্ত্রধারীরা পিছু হটেন। এরপর গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। এঁদের মধ্যে পাঁচজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। গুলিবিদ্ধ অপর পাঁচজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান আরও দুজন।

ফেনীর ১১ শহীদ

গত ৪ আগস্টের হামলায় ফেনীতেই মারা যান সাতজন। এ ছাড়া ফেনীর আরও চার বাসিন্দা ঢাকা ও চট্টগ্রামে আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিহত হন। ফেনীতে গুলিতে নিহত সাতজন হলেন শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, মো.

মাহবুবুল হাসান, মো. সারোয়ার জাহান, ওয়াকিল আহমেদ, ছাইদুল ইসলাম, জাকির হোসেন, অটোরিকশাচালক মো. সবুজ। এ ছাড়া ঢাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মো. ইকরাম হোসেন কাউসার, মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ও মো. আবদুল গনি। চট্টগ্রামের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাইফুল ইসলাম। ফেনীতে নিহত সাতজনের স্বজনেরা থানায় সাতটি হত্যা মামলা করেছেন।

২২ মামলা দায়ের

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফেনী সদর মডেল থানায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি হয়েছেন ২ হাজার ১৯৯ জন ও অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৪ হাজার জনকে। উল্লেখযোগ্য আসামির মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীসহ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিগত এক বছরে অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাত মিলিয়ে সহস্রাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে গত ৪ আগস্টের হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ১১ জন। তবে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও বেশির ভাগ অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

৩০ অস্ত্রধারী

‘হাজারী-ঘনিষ্ঠ ৩০ জনের কাছে পিস্তল, রাইফেল ও শটগান ছিল’ শিরোনামে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফেনীর অস্ত্রধারীদের নাম উঠে এসেছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী অস্ত্রধারীদের মধ্যে যুবলীগ নেতা লুৎফর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউদ্দিন বাবলু, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রউফ, হারুন মজুমদার, যুবলীগ নেতা দিদারুল কবিরসহ ৩০ জনের নাম উঠে এসেছিল। এঁদের মধ্যে কেবল নূর নবী মেম্বার ও যুবলীগ নেতা সম্রাট গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। বাকিদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। উদ্ধার হয়নি তাঁদের ব্যবহৃত অস্ত্রও।

জানতে চাইলে ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যা মামলাগুলোর মধ্যে কলেজ শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম (২৫) হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গত ৩১ জুলাই ফেনীর আদালতে দিয়েছে পুলিশ। ওই অভিযোগপত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনাসহ ২২১ জনের নাম রয়েছে। হত্যা ও হত্যাচেষ্টায় দায়ের হওয়া অপরাপর মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। এসব মামলায় বিগত এক বছর সহস্রাধিক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অস্ত্রও উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আরও পড়ুনহাজারী–ঘনিষ্ঠ ৩০ জনের কাছে পিস্তল, রাইফেল ও শটগান ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হত য ক ণ ড র ৩০ জন র ৪ আগস ট এক বছর ত র কর আওয় ম স তজন

এছাড়াও পড়ুন:

ম্যাচ চলাকালেই মারা গেলেন ওয়েলালাগের বাবা

এশিয়া কাপের মঞ্চে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন শ্রীলঙ্কার তরুণ অলরাউন্ডার দুনিথ ওয়েলালাগে। মাঠের ভেতর দিনটা যেমন ভালো কাটেনি, মাঠের বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় এক আঘাত। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরই তিনি জানতে পারেন, আর কোনোদিন বাবাকে দেখতে পারবেন না। খেলার উত্তেজনার রেশ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে তার পুরো পৃথিবী।

২২ বছর বয়সী এই স্পিনারের বাবা সুরঙ্গা ওয়েলালাগে মারা যান বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) যেদিন ছেলের দেশের হয়ে এশিয়া কাপে প্রথমবার মাঠে নামার কথা ছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যু সংবাদ তিনি জানতে পারেন ম্যাচ শেষ হওয়ার পর। দেশের হয়ে দায়িত্ব পালন করে তিনি যখন সতীর্থদের সঙ্গে জয় উদযাপনে ছিলেন, তখনই নীরবে নিভে যায় তার পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় মানুষের জীবনপ্রদীপ। সংবাদটি জানার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দেশে ফিরে যান, ফলে এশিয়া কাপের বাকি ম্যাচগুলোতে তার খেলা এখন অনিশ্চিত।

আরো পড়ুন:

সান্ত্বনার জয়ে আফগানিস্তানের সফর শেষ

ব্যাটিং ব্যর্থতায় এক ম্যাচ আগেই সিরিজ হারলো আফগানিস্তান

ম্যাচটিও যেন তার জন্য হয়ে ওঠে এক দুঃস্বপ্ন। শেষ ওভারে বল করতে এসে অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবীর ঝড়ো ব্যাটিংয়ের শিকার হন তিনি। এক ওভারেই পাঁচটি ছক্কা হজম করতে হয় তাকে, সেই সঙ্গে আফগানিস্তান পায় লড়াই করার মতো সংগ্রহ। ওয়েলালাগের বোলিং ফিগার দাঁড়ায় ৪ ওভারে ৪৯ রান খরচে মাত্র ১ উইকেট। শ্রীলঙ্কা অবশ্য লক্ষ্য তাড়া করতে তেমন বেগ পায়নি। নুয়ান তুষারার দুর্দান্ত বোলিং (১৮ রানে ৪ উইকেট) আর কুশল মেন্ডিসের অপরাজিত ৭৪ রানের ইনিংসে ভর করে সহজ জয় পায় তারা।

কিন্তু ক্রিকেটে পাওয়া সেই জয়ের কোনো মূল্যই নেই ওয়েলালাগের চোখে। একদিকে জাতীয় দলের হয়ে প্রথমবার এশিয়া কাপে খেলতে নামার গর্ব, অন্যদিকে বাবাকে হারানোর বেদনা; এই দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়েছেন তিনি। এখন শ্রীলঙ্কা সুপার ফোরে জায়গা করে নিলেও ওয়েলালাগে থাকবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

ক্রিকেটের বাইরেও খেলোয়াড়রা মানুষ, তাদেরও থাকে আবেগ, থাকে শোক আর ক্ষতি। দুনিথ ওয়েলালাগের গল্পটা তাই শুধু ক্রিকেট নয়, বরং এক তরুণ সন্তানের হঠাৎ বাবাকে হারানোর বেদনাময় কাহিনি। মাঠে জয় পেলেও জীবনের এই পরাজয় যে কোনো ক্রীড়াবিদের জন্য অসহনীয়।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ