যে কারণে জাপানেও মাথাচাড়া দিচ্ছে জনতুষ্টিবাদ
Published: 4th, August 2025 GMT
১৯৩০-এর দশকে ইউরোপে যেভাবে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল, সেভাবে আজ ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদও ভাইরাসের মতো দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির প্রতিটি ধরন একেক দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাস অনুযায়ী একেক চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে।
এর ধারাবাহিকতায় জাপানেও এখন তাদের নিজস্ব ঘরানার ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। সানসেইতো নামে একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে এর প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি জাপানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে নির্বাচনের আগে দলটি ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকার স্বার্থ আগে’ স্লোগানটির মতো ‘জাপানিজ ফার্স্ট’ বা ‘জাপানি স্বার্থ আগে’ বলে একটি স্লোগানে প্রচার চালায়।
সানসেইতো প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা কামিয়া সোহেই নামের এক তরুণ রাজনীতিক। তিনি একবার বলেছিলেন, তিনি ‘জাপানকে ইহুদি পুঁজির কাছে বিক্রি’ করবেন না। তিনি লিঙ্গসমতার ধারণাকে কমিউনিজমের রূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। একেবারে নবীন ও কট্টর রক্ষণশীল ডানপন্থী দল হওয়া সত্ত্বেও দলটি ২৪৮ আসনের উচ্চকক্ষে ১৪টি আসন পায়। ফলে জাপানের পার্লামেন্টে এখন তাদের মোট আসনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫টিতে। এ সংখ্যা খুব বড় না হলেও এটি জাপানের মূলধারার রক্ষণশীল রাজনীতিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। কারণ, তাঁরা আশঙ্কা করছেন, আরও ভোট ডানপন্থী চরমপন্থার দিকে চলে যেতে পারে।
সানসেইতো প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা কামিয়া সোহেই নামের এক তরুণ রাজনীতিক। তিনি একবার বলেছিলেন, তিনি ‘জাপানকে ইহুদি পুঁজির কাছে বিক্রি’ করবেন না। তিনি লিঙ্গ সমতার ধারণাকে কমিউনিজমের রূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। এই দলের আরেক সদস্য মাতসুদা মনাবু কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে ‘হত্যার অস্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এই নির্বাচনে সানসেইতোকে অন্যতম বিজয়ী দল বলা যেতে পারে। একেবারে নবীন ও কট্টর রক্ষণশীল ডানপন্থী দল হওয়া সত্ত্বেও তারা ২৪৮ আসনের উচ্চকক্ষে ১৪টি আসন পায়। ফলে জাপানের পার্লামেন্টে এখন তাদের মোট আসনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫টিতে। এ সংখ্যাটি খুব বড় না হলেও এটি জাপানের মূলধারার রক্ষণশীল রাজনীতিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। কারণ তাঁরা আশঙ্কা করছেন, আরও ভোট ডানপন্থী চরমপন্থার দিকে চলে যেতে পারে।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, শাসক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এই নির্বাচনে উচ্চকক্ষে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।
সানসেইতো যদিও ভ্যাকসিন, অভিবাসী, বৈচিত্র্য, লিঙ্গ ও জাতীয়তাবাদের মতো সাধারণ কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলে, তবে জাপানের এই জনতুষ্টিবাদীরা অন্যান্য দেশের চরম ডানপন্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা। এমনকি জাপানের পুরোনো চরম ডানপন্থীদের থেকেও তারা আলাদা।
জাপানের বিভিন্ন শহরে বহু বছর ধরে আমরা চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর এমনসব সাউন্ড সিস্টেম বহনকারী ট্রাক দেখেছি, যেগুলোতে চড়ে সামরিক পোশাক পরা জাতীয়তাবাদী যুবকেরা ঘোরেন। সেসব ট্রাক থেকে দেশাত্মবোধক রণসংগীত বাজানো হয়।
মূলত জাপানের সাম্রাজ্যবাদী অতীতকে গৌরবময় সময় হিসেবে দেখানোর জন্য ট্রাকগুলো পথে পথে নামানো হয়। তাঁরা জাপানিদের সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফিরিয়ে আনতে চান। তাঁরা বিশ্বাস করেন, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো অন্যায় করেনি; বরং তারা ‘বীরের মতো’ যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের বামপন্থীরা এবং কমিউনিস্ট চীন মিলে জাপানকে ‘দোষী’ বানিয়েছে। ফলে আজকের জাপানিরা তাঁদের অতীত নিয়ে গর্ব করার বদলে লজ্জা পাচ্ছেন। এই চরমপন্থীরা এ অবস্থা পরিবর্তন করতে চান।
এই প্রান্তবর্তী কিন্তু প্রচণ্ড উচ্চকিত গোষ্ঠীগুলোর অনেক দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ মূলধারার রক্ষণশীল রাজনীতিতেও ঢুকে পড়েছে। এদের মূল আপত্তি ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিপূর্ণ সংবিধান নিয়ে। এদের বক্তব্য হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের ‘শান্তিপূর্ণ’ সংবিধান আমেরিকানরা লিখে দিয়েছিলেন। আমেরিকানদের লিখে দেওয়া সেই সংবিধানের মাধ্যমে বিদেশে জাপানের সামরিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয়।
জাপানের অনেক পর্যটক ও নতুন বাসিন্দাই চীনা। এটি একটি বড় পরিবর্তন। বিংশ শতকের শুরু থেকে জাপানের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদ মূলত ছিল পশ্চিমবিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তারা আমেরিকানদের দোষারোপ করত। কারণ, তারা জাপানি সংস্কৃতিকে বাণিজ্যিকভাবে দূষিত করছে এবং এশিয়ায় জাপানের প্রাধান্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যুদ্ধের পর তাদের বিরাগভাজন ছিল সেই ‘শান্তি সংবিধান’।সানসেইতোর প্রতিষ্ঠাতা কামিয়া নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কোনো ভুল স্বীকার করেন না। তবে সানসেইতো ও ‘জাপানি ফার্স্ট’ সমর্থকদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো—জাপানে বিদেশিদের বাড়তি উপস্থিতি। অভিবাসী, শ্রমিক, এমনকি পর্যটক—সবাই এই ‘বিদেশি’র অন্তর্ভুক্ত।
অন্য অনেক দেশের তুলনায় জাপানে বরাবরই বিদেশিদের সংখ্যা ছিল খুব কম। যেসব বিদেশি ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই জাতিগত কোরিয়ান। তাঁরা শুধুই জাপানি ভাষায় কথা বলতেন। আশ্রয়প্রার্থীদের প্রায় সব সময়ই ফিরিয়ে দেওয়া হতো। আশির দশকে যাঁরা এসেছিলেন (যেমন ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় পালিয়ে আসা ইরানিরা), তাঁরা পরে আবার নিজেদের দেশে চলে যান।
কিন্তু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এখন জাপানে ৩৮ লাখ বিদেশি বাসিন্দা রয়েছেন এবং ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ২ কোটির বেশি পর্যটক সস্তা ইয়েনের সুবিধা নিয়ে জাপান ভ্রমণ করেছেন। এই সংখ্যাকে বিপুল বলা যাবে না। কারণ, বিদেশিরা জাপানের জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ, যেখানে ফ্রান্সে আছে ১০ শতাংশ। ২০২৪ সালে ইতালিতে ৬ দশমিক ৫ কোটি আন্তর্জাতিক পর্যটক এসেছিলেন।
জাপান সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য ও দ্রুত বুড়ো হয়ে যাওয়া সমাজে শ্রমিক ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে পর্যটন ও অভিবাসন উৎসাহিত করছে। কিন্তু এর ফলে অনেকে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আর সেই ক্ষোভ কাজে লাগিয়েই সানসেইতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তারা মূল্যস্ফীতি, খরচ বেড়ে যাওয়া, মজুরি স্থবির হয়ে থাকা, এমনকি চালের সংকটের জন্যও বিদেশিদের দোষারোপ করছে।
জাপানের অনেক পর্যটক ও নতুন বাসিন্দাই চীনা। এটি একটি বড় পরিবর্তন। বিংশ শতকের শুরু থেকে জাপানের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদ মূলত ছিল পশ্চিমবিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তারা আমেরিকানদের দোষারোপ করত। কারণ, তারা জাপানি সংস্কৃতিকে বাণিজ্যিকভাবে দূষিত করছে এবং এশিয়ায় জাপানের প্রাধান্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যুদ্ধের পর তাদের বিরাগভাজন ছিল সেই ‘শান্তি সংবিধান’।
এখন অবশ্য চীনের শক্তি বৃদ্ধিকে জাপানের মানুষ ভয় পাচ্ছে। ইউরোপীয়রা ১৯৫০-এর দশকে ‘কুৎসিত আমেরিকান’ পর্যটকদের যে চোখে দেখতেন, এখন অনেক জাপানি ধনী চীনা পর্যটকদের ঠিক সেই চোখে দেখেন। ধনী চীনাদের উদ্ধত আচরণ, স্থানীয় নিয়ম মানতে অনীহা এবং নতুন নতুন বড়লোক হয়ে বড়াই করা দেখে জাপানিদের একটি বড় অংশ বিরক্ত।
জাপানের স্থানীয় মানুষ যখন নিজেরা অর্থনৈতিক কষ্টে থাকেন, তখন তাঁদের আরও বেশি খারাপ লাগে। আগে এশীয় শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে চীনারা, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ছিলেন। এখন ধনী চীনারা জাপানকে নিরাপদ ও আরামদায়ক ভেবে এখানে বসতি গড়ছেন। তাঁরা টোকিওর অভিজাত সম্পত্তিগুলো কিনে নিচ্ছেন।
এসবেও তেমন সমস্যা হতো না, যদি চীনকে শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ শক্তি হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জাপানিদের আশঙ্কা, চীন তার সামরিক ক্ষমতা বাড়াতে চায় এবং প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদী চেহারা ফেরাতে চায়।
আজকের পরিস্থিতিতে একটি বড় রকমের পরিহাস বা ‘বিপরীতমুখী ফলাফল’ তৈরি হয়েছে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রই জাপানকে ‘শান্তি সংবিধান’ দিয়েছিল এবং সামরিক শক্তি সীমিত রেখেছিল, যাতে চীনের মতো কমিউনিস্ট শক্তির হুমকি থেকে জাপানকে রক্ষা করা যায়।
কিন্তু আজ ট্রাম্প (যিনি ‘জাপানি ফার্স্ট’দের কাছে একধরনের নায়ক) এমন এক আমেরিকা সৃষ্টি করেছেন, যার ওপর আর জাপানের নিরাপত্তা নির্ভর করতে পারে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ইয়ান বুরুমা বিখ্যাত ডাচ লেখক, ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনত ষ ট ব দ য দ ধ র পর চরমপন থ আম র ক ন র জন ত ক ড নপন থ পর যটক আসন র
এছাড়াও পড়ুন:
যে কারণে জাপানেও মাথাচাড়া দিচ্ছে জনতুষ্টিবাদ
১৯৩০-এর দশকে ইউরোপে যেভাবে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল, সেভাবে আজ ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদও ভাইরাসের মতো দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির প্রতিটি ধরন একেক দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাস অনুযায়ী একেক চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে।
এর ধারাবাহিকতায় জাপানেও এখন তাদের নিজস্ব ঘরানার ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। সানসেইতো নামে একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে এর প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি জাপানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে নির্বাচনের আগে দলটি ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকার স্বার্থ আগে’ স্লোগানটির মতো ‘জাপানিজ ফার্স্ট’ বা ‘জাপানি স্বার্থ আগে’ বলে একটি স্লোগানে প্রচার চালায়।
সানসেইতো প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা কামিয়া সোহেই নামের এক তরুণ রাজনীতিক। তিনি একবার বলেছিলেন, তিনি ‘জাপানকে ইহুদি পুঁজির কাছে বিক্রি’ করবেন না। তিনি লিঙ্গসমতার ধারণাকে কমিউনিজমের রূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। একেবারে নবীন ও কট্টর রক্ষণশীল ডানপন্থী দল হওয়া সত্ত্বেও দলটি ২৪৮ আসনের উচ্চকক্ষে ১৪টি আসন পায়। ফলে জাপানের পার্লামেন্টে এখন তাদের মোট আসনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫টিতে। এ সংখ্যা খুব বড় না হলেও এটি জাপানের মূলধারার রক্ষণশীল রাজনীতিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। কারণ, তাঁরা আশঙ্কা করছেন, আরও ভোট ডানপন্থী চরমপন্থার দিকে চলে যেতে পারে।
সানসেইতো প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা কামিয়া সোহেই নামের এক তরুণ রাজনীতিক। তিনি একবার বলেছিলেন, তিনি ‘জাপানকে ইহুদি পুঁজির কাছে বিক্রি’ করবেন না। তিনি লিঙ্গ সমতার ধারণাকে কমিউনিজমের রূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। এই দলের আরেক সদস্য মাতসুদা মনাবু কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে ‘হত্যার অস্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এই নির্বাচনে সানসেইতোকে অন্যতম বিজয়ী দল বলা যেতে পারে। একেবারে নবীন ও কট্টর রক্ষণশীল ডানপন্থী দল হওয়া সত্ত্বেও তারা ২৪৮ আসনের উচ্চকক্ষে ১৪টি আসন পায়। ফলে জাপানের পার্লামেন্টে এখন তাদের মোট আসনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫টিতে। এ সংখ্যাটি খুব বড় না হলেও এটি জাপানের মূলধারার রক্ষণশীল রাজনীতিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। কারণ তাঁরা আশঙ্কা করছেন, আরও ভোট ডানপন্থী চরমপন্থার দিকে চলে যেতে পারে।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, শাসক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এই নির্বাচনে উচ্চকক্ষে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।
সানসেইতো যদিও ভ্যাকসিন, অভিবাসী, বৈচিত্র্য, লিঙ্গ ও জাতীয়তাবাদের মতো সাধারণ কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলে, তবে জাপানের এই জনতুষ্টিবাদীরা অন্যান্য দেশের চরম ডানপন্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা। এমনকি জাপানের পুরোনো চরম ডানপন্থীদের থেকেও তারা আলাদা।
জাপানের বিভিন্ন শহরে বহু বছর ধরে আমরা চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর এমনসব সাউন্ড সিস্টেম বহনকারী ট্রাক দেখেছি, যেগুলোতে চড়ে সামরিক পোশাক পরা জাতীয়তাবাদী যুবকেরা ঘোরেন। সেসব ট্রাক থেকে দেশাত্মবোধক রণসংগীত বাজানো হয়।
মূলত জাপানের সাম্রাজ্যবাদী অতীতকে গৌরবময় সময় হিসেবে দেখানোর জন্য ট্রাকগুলো পথে পথে নামানো হয়। তাঁরা জাপানিদের সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফিরিয়ে আনতে চান। তাঁরা বিশ্বাস করেন, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো অন্যায় করেনি; বরং তারা ‘বীরের মতো’ যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের বামপন্থীরা এবং কমিউনিস্ট চীন মিলে জাপানকে ‘দোষী’ বানিয়েছে। ফলে আজকের জাপানিরা তাঁদের অতীত নিয়ে গর্ব করার বদলে লজ্জা পাচ্ছেন। এই চরমপন্থীরা এ অবস্থা পরিবর্তন করতে চান।
এই প্রান্তবর্তী কিন্তু প্রচণ্ড উচ্চকিত গোষ্ঠীগুলোর অনেক দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ মূলধারার রক্ষণশীল রাজনীতিতেও ঢুকে পড়েছে। এদের মূল আপত্তি ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিপূর্ণ সংবিধান নিয়ে। এদের বক্তব্য হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের ‘শান্তিপূর্ণ’ সংবিধান আমেরিকানরা লিখে দিয়েছিলেন। আমেরিকানদের লিখে দেওয়া সেই সংবিধানের মাধ্যমে বিদেশে জাপানের সামরিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয়।
জাপানের অনেক পর্যটক ও নতুন বাসিন্দাই চীনা। এটি একটি বড় পরিবর্তন। বিংশ শতকের শুরু থেকে জাপানের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদ মূলত ছিল পশ্চিমবিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তারা আমেরিকানদের দোষারোপ করত। কারণ, তারা জাপানি সংস্কৃতিকে বাণিজ্যিকভাবে দূষিত করছে এবং এশিয়ায় জাপানের প্রাধান্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যুদ্ধের পর তাদের বিরাগভাজন ছিল সেই ‘শান্তি সংবিধান’।সানসেইতোর প্রতিষ্ঠাতা কামিয়া নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কোনো ভুল স্বীকার করেন না। তবে সানসেইতো ও ‘জাপানি ফার্স্ট’ সমর্থকদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো—জাপানে বিদেশিদের বাড়তি উপস্থিতি। অভিবাসী, শ্রমিক, এমনকি পর্যটক—সবাই এই ‘বিদেশি’র অন্তর্ভুক্ত।
অন্য অনেক দেশের তুলনায় জাপানে বরাবরই বিদেশিদের সংখ্যা ছিল খুব কম। যেসব বিদেশি ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই জাতিগত কোরিয়ান। তাঁরা শুধুই জাপানি ভাষায় কথা বলতেন। আশ্রয়প্রার্থীদের প্রায় সব সময়ই ফিরিয়ে দেওয়া হতো। আশির দশকে যাঁরা এসেছিলেন (যেমন ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় পালিয়ে আসা ইরানিরা), তাঁরা পরে আবার নিজেদের দেশে চলে যান।
কিন্তু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এখন জাপানে ৩৮ লাখ বিদেশি বাসিন্দা রয়েছেন এবং ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ২ কোটির বেশি পর্যটক সস্তা ইয়েনের সুবিধা নিয়ে জাপান ভ্রমণ করেছেন। এই সংখ্যাকে বিপুল বলা যাবে না। কারণ, বিদেশিরা জাপানের জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ, যেখানে ফ্রান্সে আছে ১০ শতাংশ। ২০২৪ সালে ইতালিতে ৬ দশমিক ৫ কোটি আন্তর্জাতিক পর্যটক এসেছিলেন।
জাপান সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য ও দ্রুত বুড়ো হয়ে যাওয়া সমাজে শ্রমিক ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে পর্যটন ও অভিবাসন উৎসাহিত করছে। কিন্তু এর ফলে অনেকে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আর সেই ক্ষোভ কাজে লাগিয়েই সানসেইতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তারা মূল্যস্ফীতি, খরচ বেড়ে যাওয়া, মজুরি স্থবির হয়ে থাকা, এমনকি চালের সংকটের জন্যও বিদেশিদের দোষারোপ করছে।
জাপানের অনেক পর্যটক ও নতুন বাসিন্দাই চীনা। এটি একটি বড় পরিবর্তন। বিংশ শতকের শুরু থেকে জাপানের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদ মূলত ছিল পশ্চিমবিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তারা আমেরিকানদের দোষারোপ করত। কারণ, তারা জাপানি সংস্কৃতিকে বাণিজ্যিকভাবে দূষিত করছে এবং এশিয়ায় জাপানের প্রাধান্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যুদ্ধের পর তাদের বিরাগভাজন ছিল সেই ‘শান্তি সংবিধান’।
এখন অবশ্য চীনের শক্তি বৃদ্ধিকে জাপানের মানুষ ভয় পাচ্ছে। ইউরোপীয়রা ১৯৫০-এর দশকে ‘কুৎসিত আমেরিকান’ পর্যটকদের যে চোখে দেখতেন, এখন অনেক জাপানি ধনী চীনা পর্যটকদের ঠিক সেই চোখে দেখেন। ধনী চীনাদের উদ্ধত আচরণ, স্থানীয় নিয়ম মানতে অনীহা এবং নতুন নতুন বড়লোক হয়ে বড়াই করা দেখে জাপানিদের একটি বড় অংশ বিরক্ত।
জাপানের স্থানীয় মানুষ যখন নিজেরা অর্থনৈতিক কষ্টে থাকেন, তখন তাঁদের আরও বেশি খারাপ লাগে। আগে এশীয় শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে চীনারা, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ছিলেন। এখন ধনী চীনারা জাপানকে নিরাপদ ও আরামদায়ক ভেবে এখানে বসতি গড়ছেন। তাঁরা টোকিওর অভিজাত সম্পত্তিগুলো কিনে নিচ্ছেন।
এসবেও তেমন সমস্যা হতো না, যদি চীনকে শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ শক্তি হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জাপানিদের আশঙ্কা, চীন তার সামরিক ক্ষমতা বাড়াতে চায় এবং প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদী চেহারা ফেরাতে চায়।
আজকের পরিস্থিতিতে একটি বড় রকমের পরিহাস বা ‘বিপরীতমুখী ফলাফল’ তৈরি হয়েছে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রই জাপানকে ‘শান্তি সংবিধান’ দিয়েছিল এবং সামরিক শক্তি সীমিত রেখেছিল, যাতে চীনের মতো কমিউনিস্ট শক্তির হুমকি থেকে জাপানকে রক্ষা করা যায়।
কিন্তু আজ ট্রাম্প (যিনি ‘জাপানি ফার্স্ট’দের কাছে একধরনের নায়ক) এমন এক আমেরিকা সৃষ্টি করেছেন, যার ওপর আর জাপানের নিরাপত্তা নির্ভর করতে পারে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ইয়ান বুরুমা বিখ্যাত ডাচ লেখক, ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার।