গত বছরের ২ আগস্ট অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণে দ্রোহযাত্রা হয়। সেখানে আমি বলেছিলাম, ‘কেবল হাসিনার পতন বাংলাদেশের মুক্তি আনবে না। পুনঃ পুনঃ স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বেড়ে ওঠা বন্ধ করবে না।...মুক্তিযুদ্ধকে দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।...মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের হাতে ফেরত নিয়ে আসতে হবে।...লুটপাট, অন্যায়, দুর্নীতি, প্রাণপ্রকৃতিবিধ্বংসী ‘উন্নয়নের’ নামে স্বৈরতন্ত্র দিয়ে জনগণের ওপর আক্রমণ আর চলবে না।.
এক বছরের মাথায় মনে হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এই গতিমুখ তৈরিতেই আমাদের দুর্বলতা প্রকট। সে জন্য উল্টো বাড়ছে বৈষম্যবাদী অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর দাপট, হুংকার।
গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্য ও বৈশিষ্ট্য
তবে এ কারণে শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার অসাধারণ অভ্যুত্থানের গুরুত্ব খর্ব করে দেখা যাবে না। এর সাফল্যকে ধরেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সাফল্য প্রধানত তিনটি: এক. আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, অত্যাচারী, জোর করে ক্ষমতায় বসে থাকা প্রবল পরাক্রমশালী সরকারের পতন হয়েছে। দুই. এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিদিনের নির্যাতন, হুমকি এবং রাষ্ট্রীয় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে। যদিও আবারও এগুলোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। তিন. বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আলোচনা, বিতর্কের উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। সবারই যেন কিছু বলার আছে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা আছে, মত-ভিন্নমত আছে। বড় পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি হওয়া, এর জন্য সরব হওয়া একটি বড় সাফল্য। এর মধ্যে এখন যে নানা পিছুটান, সংশয় ও ভয় তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করা আমাদের দায়িত্ব।
সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য এই গণ-অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্যগুলোও খেয়াল রাখতে হবে: প্রথমত, আগের মতোই তরুণেরা এই আন্দোলনেরও শীর্ষ ভূমিকায় থেকেছেন। এতে বাম-ডান বিভিন্ন দল, শিক্ষার্থী-নারী-পেশাজীবী সংগঠনসহ অসংখ্য মানুষের ভূমিকা থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছিল না। দ্বিতীয়ত, এবারের আন্দোলনে সক্রিয় সংবেদনশীল ভূমিকা ছিল নারী, শ্রমজীবী মানুষ, লিঙ্গীয়-ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষসহ দলীয় পরিচয়ের বাইরে সমাজের বিভিন্ন অংশের। তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ডিজিটাল প্রযুক্তির, যার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে দ্রুত খবর গেছে, নৃশংসতা ও প্রতিরোধের ভিডিও চিত্র মানুষকে জমায়েত করেছে, আন্দোলনকারীরা পরস্পর সংযুক্ত থেকেছে। চতুর্থত, এবারের আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের স্পষ্ট অবস্থান না থাকায় অসংখ্য কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পঞ্চমত, দেয়ালে দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা আঁকায় বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে বহু গান, তথ্যচিত্র, লেখা, কার্টুনসহ সৃজনশীল কাজ। সেখানে সব ধর্ম, জাতি, শ্রেণি ও লিঙ্গীয় বৈষম্য দূর করে সমতার বাংলাদেশের স্বপ্ন উঠে এসেছে।
বৈষম্যের বিভিন্ন মুখ
এই স্বপ্নপূরণের জন্য বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো নির্দিষ্ট করা দরকার। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির দৃষ্টিগ্রাহ্য বিকাশ ঘটেছে, আকার বেড়েছে অনেক, অবকাঠামোর বিস্তার ঘটেছে, জিডিপি বেড়েছে বহুগুণ, আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু একই সময়ে শ্রেণিবৈষম্য বেড়েছে প্রকটভাবে। স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পরিশ্রমের দেশ চলে গেছে মুষ্টিমেয়র হাতে, শ্রেণি-আধিপত্য প্রবল হয়েছে। জিডিপিতে নিচের ৯০ শতাংশের অংশীদারত্ব কমে শীর্ষ ১০ শতাংশের হাতে দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যার সিংহভাগ আরও শীর্ষ ১ শতাংশের দখলে। এদের কারণে দেশের বিপুল সম্পদ লুণ্ঠিত ও পাচার হয়েছে, দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে, বারবার স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে আটকে গেছে দেশ। দেশের নদী-বন-পাহাড়-বাতাস তথা প্রাণপ্রকৃতি বিপর্যস্ত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা, জুলুম অব্যাহত আছে। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান শ্রেণিবৈষম্যের অন্যতম চিহ্ন। এগুলোর ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ জনসংখ্যার একটি বড় অংশের প্রকৃত আয় কমিয়েছে। চিকিৎসা বা সন্তানদের শিক্ষিত করাতে গিয়ে তাদের অনেকে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ: লেখক; সম্পাদক, সর্বজনকথাউৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে বইমেলায় বিক্রি কম, এখনো আশায় আছেন প্রকাশকেরা
রাজশাহী বিভাগীয় বইমেলার প্রথম তিন দিনে লোকজনের ভিড় থাকলেও বেচাকেনা তেমন হয়নি। এতে অনেক প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকেরা ও আয়োজক কর্তৃপক্ষ।
গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা কালেক্টরেট মাঠে ৯ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে এবং রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ মেলা চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০টি বেসরকারি প্রকাশনাসহ মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে মেলা চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়।
উদ্বোধনের আগের দিন বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। সেই কর্দমাক্ত পরিবেশেই মেলার উদ্বোধন হয়। দর্শনার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পরে প্রতিটি স্টলের সামনে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বিক্রির খরা কাটেনি বলে জানালেন বিক্রেতারা।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন অংশে তখনো পানি জমে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলেও কাদা। সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। স্টলের সামনে ইটের সলিংয়ের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন অনেকে। অনেকে বই দেখছেন।
সূর্যোদয় প্রকাশনীর বিক্রেতা রিপন আলী বলেন, প্রথম দিন তো কাদাপানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো মানুষ ছিলেন। এখন ইট বিছানোর পর আরও বেশি মানুষ আসছেন, ভিড়ও করছেন, কিন্তু বই কিনছেন খুব কম।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে কাদার ওপর চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল বিক্রয়কর্মী ও চিত্রশিল্পী অর্ণব পাল সন্তুকে। তিনি বলেন, মানুষ আসছেন, ঘুরে দেখছেন, কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। মেলার ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতে পারত। আরেক বিক্রেতা আবদুল্লাহ হীল বাকি জানালেন, এমনও স্টল আছে, যেখানে সারা দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বইও বিক্রি হচ্ছে না।
তবে হতাশার ভিড়ে আশার কথাও শোনালেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম থেকে আসা নন্দন বইঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, বেচাবিক্রি আজ না হোক কাল হবে। মানুষ যে মেলায় এসে বই হাতে নিয়ে দেখছেন, এটাই বড় পাওয়া। এতে তাঁদের মধ্যে বই কেনার আগ্রহ তৈরি হবে।
মেলায় আসা পাঠকদের মধ্যে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। দুই সন্তানের জন্য শিশুতোষ বই কিনে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম।
মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের বই কিনেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় একসঙ্গে অনেক বই পাওয়া যায়, যা বই কেনার জন্য দারুণ সুযোগ।