চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা যুদ্ধোন্মত্ততার আসল কারণ
Published: 5th, August 2025 GMT
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল, তা গত দুই দশকে ধীরে ধীরে বৈরিতায় পরিণত হয়েছে। মার্কিন গণমাধ্যম ও সে দেশের রাজনীতিবিদেরা নিয়মিতভাবে চীনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং চীনের আশপাশে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। ওয়াশিংটন চায়, বিশ্ববাসী বিশ্বাস করুক, চীন বিশ্বের জন্য একটা হুমকি।
চীনের উত্থান নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত করছে; কিন্তু সেই আঘাত ঠিক ততটা গভীর নয়, যতটা মার্কিন নেতৃত্ব তার জনগণের সামনে তুলে ধরছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বুঝতে হলে আমাদের বৈশ্বিক অর্থনীতির বড় চিত্রটা দেখতে হবে। ধনী দেশগুলো (যাদের ‘গ্লোবাল নর্থ’ বলা হয়) মূলত গরিব বা মাঝারি আয়ের দেশগুলো থেকে (যাদের বলা হয় ‘গ্লোবাল সাউথ’) সস্তায় শ্রমিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ নেয়, যাতে নিজেদের ব্যবসা থেকে বেশি মুনাফা করতে পারে।
এ ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি, যাতে সারা বিশ্বের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি অনেক বেশি লাভ করতে পারে। ধনী দেশগুলো (মূল) ও গরিব দেশগুলোর (প্রান্ত) মধ্যে দাম ও মূল্য নির্ধারণে একধরনের স্থায়ী বৈষম্য থাকে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গরিব দেশগুলো কম দামে পণ্য দেয়; আর ধনী দেশগুলো সেখান থেকে অনেক বেশি সম্পদ নিয়ে নেয়।
১৯৮০ সালের পর থেকে চীন যখন পশ্চিমা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য নিজেকে উন্মুক্ত করেছিল, তখন থেকে চীন এই বৈশ্বিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। তারা পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর জন্য এক বিশাল শ্রমবাজার তৈরি করে দেয়। এই শ্রম ছিল সস্তা, কিন্তু দক্ষ ও উৎপাদনশীল। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল কোম্পানির উৎপাদনের বড় একটা অংশ চীনের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল।
অর্থনীতিবিদ ডোনাল্ড এ ক্লেল্যান্ডের গবেষণা অনুযায়ী, যদি অ্যাপলকে চীনা ও পূর্ব এশীয় শ্রমিকদের মার্কিন শ্রমিকদের হারে বেতন দিতে হতো, তাহলে ২০১১ সালে প্রতিটি আইপ্যাডে অতিরিক্ত ৫৭২ ডলার খরচ হতো।
কিন্তু গত দুই দশকে চীনের শ্রমিকদের মজুরি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০০৫ সালের দিকে চীনে প্রতি ঘণ্টার শ্রমমূল্য ছিল ১ ডলারের নিচে, যা নাকি ভারতের চেয়েও কম। এখন চীনে প্রতি ঘণ্টার মজুরি ৮ ডলারের বেশি, আর ভারতে সেই মজুরি এখন মাত্র ২ ডলার। আসলে এখন চীন পুরো এশিয়ার সব উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি মজুরি দেয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে এমনটা ঘটেছে। প্রথমত, চীনে অতিরিক্ত শ্রমশক্তিকে ধীর ধীরে মজুরিভিত্তিক অর্থনীতির মধ্যে যুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে শ্রমিকদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীন সরকার রাষ্ট্রীয় খাতে হস্তক্ষেপ ও বিনিয়োগ বাড়িয়েছে (যেমন জনস্বাস্থ্য ও আবাসনের মতো সেবা বিস্তৃত করেছে)। এর ফলে শ্রমিকদের অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে।
চীনের জন্য, বিশেষ করে চীনা শ্রমিকদের জন্য, এসব উন্নতি অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু পশ্চিমা পুঁজির জন্য এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, উচ্চ মজুরি পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর লাভে আঘাত হানছে। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি চীনে কাজ করছে বা চীন থেকে যন্ত্রাংশ নিচ্ছে, তাদের জন্য এটি হুমকি হয়ে উঠছে।
চীনকে সামরিক হুমকি হিসেবে তুলে ধরার প্রচারণা আসলে বাস্তবতাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা। বাস্তব হলো চীনের প্রতিজনের সামরিক ব্যয় বিশ্বের গড়ের চেয়েও কম, আর যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ১০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যাও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৮ গুণ কম।আরেকটি সমস্যা হলো, চীনের পণ্যের দাম ও মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন আগের মতো অসম বিনিময়ের শিকার হচ্ছে না। ১৯৯০-এর দশকে যখন মজুরি খুব কম ছিল, তখন চীনকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার জন্য প্রচুর রপ্তানি করতে হতো। এখন এই অনুপাতে অনেকটাই ভারসাম্য এসেছে। এতে চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অনেকটাই সমতাভিত্তিক হয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো চীন থেকে যেভাবে সম্পদ আহরণ করত, সেটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা পুঁজিবাদী শ্রেণি বিপাকে পড়েছে। তারা আবার সস্তা শ্রম ও সম্পদের নাগাল পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। একটি বিকল্প হলো—উৎপাদন খাতকে চীন থেকে সরিয়ে এমন দেশে নিয়ে যাওয়া, যেখানে মজুরি কম (যেমন বাংলাদেশ বা ভিয়েতনাম)। কিন্তু এতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়, নতুন কর্মী নিয়োগে সময় লাগে এবং সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটে। আরেকটি বিকল্প হলো চীনের মজুরি কমিয়ে দেওয়া। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের সরকারকে দুর্বল করতে চায়, যুদ্ধের হুমকি দিয়ে ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে অস্থির করতে চায়।
বিরোধিতা করার সময় পশ্চিমা দেশগুলো মাঝেমধ্যে বলে, চীনের পণ্য খুব সস্তা। অনেকে অভিযোগ করে, চীন মুদ্রার (রেনমিনবি) মান ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে রাখে। কিন্তু এ অভিযোগও পুরোনো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থনীতিবিদ হোসে আন্তোনিও অকাম্পো ২০১৭ সালে বলেছিলেন, ‘চীন বেশ কয়েক বছর ধরে রেনমিনবির মান কমাতে নয়, বরং তা ধরে রাখতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করেছে। বরং বলা যায়, এখন রেনমিনবির মান কিছুটা অতিমূল্যায়িত।’
২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের চাপ বাড়লে চীন মুদ্রার মান কিছুটা কমায়। কিন্তু সেটা বাজার পরিস্থিতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
চীনের মুদ্রা যখন আসলেই কম মূল্যায়িত ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়া তা সমর্থন করেছিল। এমনকি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে তারা সেটিকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু যখন চীন দাম বাড়াতে ও নিজেকে প্রান্ত থেকে বের করে আনতে শুরু করল, তখন থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
আরেকটি বড় কারণ প্রযুক্তি। চীন গত এক দশকে কৌশলগত খাতে প্রযুক্তি উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলাফলও চোখে পড়ার মতো: বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাইস্পিড রেল নেটওয়ার্ক, নিজস্ব বাণিজ্যিক বিমান তৈরি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক গাড়িতে বিশ্বে নেতৃত্ব, উন্নত চিকিৎসা ও মোবাইল প্রযুক্তি, মাইক্রোচিপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—সবকিছুতেই বিশাল অগ্রগতি পেয়েছে চীন। অথচ চীনের মাথাপিছু আয় উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ৮০ শতাংশ কম।
পশ্চিমা দেশগুলো চায়, কেবল তারাই উচ্চ প্রযুক্তির একচেটিয়া অধিকার রাখবে। চিকিৎসা, বিমান, কম্পিউটার, শিল্প–যন্ত্রপাতি ইত্যাদি খাতে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য চায়। এই আধিপত্য ধরে রাখতে পারলে গ্লোবাল সাউথ তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং সস্তায় সম্পদ রপ্তানি করে এই পশ্চিমা প্রযুক্তি কিনতে বাধ্য হয়। এতে উন্নত দেশগুলো অসম বাণিজ্য থেকে যে লাভ করে, তা অব্যাহত থাকে।
চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এই একচেটিয়া অধিকারকে ভেঙে ফেলছে এবং গ্লোবাল সাউথের জন্য বিকল্প উৎস তৈরি করছে। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর কর্তৃত্ব দুর্বল হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র তাই চীনের প্রযুক্তিকে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। তবে এখন পর্যন্ত এতে চীনের অগ্রগতিতে হোঁচট খাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; উল্টো চীন আরও বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে।
তাই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য অস্ত্র ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ-উসকানির নীতিতে যাচ্ছে। লক্ষ্য হলো চীনের শিল্পকাঠামো ধ্বংস করা, তাদের বিনিয়োগ প্রতিরক্ষায় ঘোরানো এবং অর্থনীতিকে দুর্বল করা।
চীনকে সামরিক হুমকি হিসেবে তুলে ধরার প্রচারণা আসলে বাস্তবতাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা। বাস্তব হলো চীনের প্রতিজনের সামরিক ব্যয় বিশ্বের গড়ের চেয়েও কম, আর যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ১০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যাও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৮ গুণ কম।
হ্যাঁ, চীনের জনসংখ্যা বিশাল, কিন্তু সামগ্রিক সামরিক ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চীনের তুলনায় ৭ গুণ বেশি ব্যয় করে।
বরং বিপরীত দৃশ্যটাই সত্যি। যুক্তরাষ্ট্রের শত শত সামরিক ঘাঁটি রয়েছে সারা বিশ্বে। তার অনেকগুলোই চীনের চারপাশে (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া) আছে। বাইরে চীনের মাত্র একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, সেটাও জিবুতি নামক আফ্রিকান একটি দেশে।
গত ৪০ বছরে চীন কোনো যুদ্ধ শুরু করেনি। অথচ এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এক ডজনের বেশি গ্লোবাল সাউথ দেশে হামলা চালিয়েছে, সরকার উৎখাত করেছে।
সত্য কথা হলো, চীন আজ যে ধরনের স্বশাসিত উন্নয়ন করছে, তা পশ্চিমা পুঁজিবাদের ভিত্তিমূলক কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা এ উন্নয়নকে সহ্য করতে পারছে না। তাই তারা চীনকে থামাতে মরিয়া।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জেসন হিকেল লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ভিজিটিং ফেলো এবং রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সদস্য।
ডিলান সুলিভান ম্যাককোয়ারি ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ফেলো
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ দ র বল র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধের ভয়ে পিআর ঠেকাতে চায়
জুলাই সনদের ভিত্তিতে এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনের দাবিতে রাজধানীর পর গতকাল শুক্রবার বিভাগীয় শহরগুলোতে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল। সমাবেশে দলগুলোর নেতারা বলেন, মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, এই ভয়ে কোনো কোনো দল পিআর পদ্ধতি ঠেকাতে চায়।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল ঢাকার বাইরে রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে এসব দল।
এর মধ্যে রংপুরের পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, গায়ের জোরে দেশ শাসনের দিন শেষ হয়ে গেছে। তাঁর দাবি, নির্বাচনে যারা কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন-বাণিজ্য করতে পারবে না, তারাই পিআর পদ্ধতি ঠেকাতে চায়।
গোলাম পরওয়ার বলেন, বিএনপি পিআর মানতে চায় না। সাংবিধানিক পদগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছামাফিক নিয়োগ বাদ দিতে আলাদা নিয়োগ কর্তৃপক্ষ হবে, সব জায়গায় এটা তারা মানতে চায় না। এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারা আপত্তি করছে। পিআর তারা এই জন্য মানতে চায় না, কারণ যখন দলকে নির্বাচিত করা হয়, তখন ব্যক্তির কোনো স্বার্থ থাকে না। এতে কোনো ব্যক্তি কালোটাকা, মাস্তানি, পেশিশক্তি দেখিয়ে নির্বাচনে কারচুপি করতে কেন যাবে?
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন না করে যদি বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোতে আবার নির্বাচন হয়, আরেকটি হাসিনার জন্ম হবে। আরেকটি ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে। বাংলার মানুষ তা হতে দেবে না।
রংপুর মহানগর জামায়াতের আমির এ টি এম আজম খানের সভাপতিত্বে সমাবেশ আরও বক্তব্য দেন মহানগরের সাবেক আমির মাহবুবার রহমান, জেলা জামায়াতের আমির গোলাম রব্বানী প্রমুখ।
জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনসহ কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) তিন দিনের বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো আগামী নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; ফ্যাসিবাদী সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। এসব দাবিতে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় কর্মসূচির পর গতকাল বিভাগীয় শহরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর সারা দেশের সব জেলা-উপজেলায় এই কর্মসূচি হবে।
গতকাল জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করলেও বাকি পাঁচটি দলের সবাইকে সব জায়গায় কর্মসূচি করতে দেখা যায়নি। এর মধ্যে খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কয়েকটি বিভাগে কর্মসূচি পালন করেছে।
৭১ শতাংশ মানুষ পিআরের পক্ষেবরিশাল মহানগর জামায়াত আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ এর পক্ষে রায় দিয়েছে। প্রয়োজন হলে গণভোট দিয়েও পরীক্ষা করতে পারেন।
বরিশাল ফজলুল হক অ্যাভিনিউতে এই সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল করেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।
ইসলামী আন্দোলনের বরিশাল জেলা ও মহানগর শাখা সমাবেশ করে নগরের সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে। পরে তারা মিছিল বের করে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি মো. লোকমান হাকীম।
দেশকে বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছেচট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাবেশ করে জামায়াত। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব একটি রাজনৈতিক দলের পকেটে ঢুকে গেছেন। এটা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। তবে আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর আশপাশের লোকজন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তাঁরা এ দেশকে বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।’
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জামায়াতের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুহাম্মাদ শাহজাহান ডাকসু নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠনের মতো আসনে বিজয়ী হবে। জামায়াতে ইসলামী সরকারি দল হবে। বিএনপিকে বিরোধী দলে যেতে হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুহাম্মদ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলটির নগর শাখার সেক্রেটারি মুহাম্মদ নুরুল আমিন, সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান হেলালী প্রমুখ। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
জনগণ তাদের পিআর বোঝাবেময়মনসিংহে পৃথক সমাবেশ ও মিছিল করে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
শহরের রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে জামায়াতের সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, একটি দল কথায় কথায় বলে, পিআর বোঝে না। আগেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝত না। জনগণ তাদের বুঝিয়েছে। জনগণ এবারও তাদের পিআর বোঝাবে। পিআর ছাড়া নির্বাচন হবে না।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ময়মনসিংহ মহানগর জামায়াতের আমির কামরুল আহসান। আরও বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, জেলা জামায়াতের আমির আবদুল করিম প্রমুখ।
জুমার নামাজের পর ময়মনসিংহের বড় মসজিদের সামনে সমাবেশের পর বিক্ষোভ মিছিল করে ইসলামী আন্দোলন। একই সময়ে টাউন হল মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে খেলাফত মজলিস। বাদ আসর নগরের বড় মসজিদের সামনে থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
প্রয়োজনে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানগতকাল দুপুরে রাজশাহীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে পথসভা করে ইসলামী আন্দোলন। বিকেলে বড় মসজিদের সামনে সমাবেশ করে জামায়াত।
ইসলামী আন্দোলনের পথসভায় দলের রাজশাহী জেলা সভাপতি মুরশিদ আলম ফারুকীসহ নেতারা বলেন, প্রয়োজনে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান হবে। পিআর ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।
জামায়াতের সমাবেশে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আলোচনায় সমাধান হচ্ছে না বলে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন।
মহানগর জামায়াতের আমির কেরামত আলীর সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন মহানগরের নায়েবে আমির আবু মোহাম্মদ সেলিম, রাজশাহী সদর আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, জেলা আমির আবদুল খালেক প্রমুখ।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিনখুলনা নিউমার্কেট বাইতুন নুর চত্বরে ইসলামী আন্দোলন ও ডাকবাংলা সোনালী ব্যাংক চত্বরে জামায়াত সমাবেশ করে। পরে দুটি দল পৃথক বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
জামায়াতের সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ নির্বাচনের আগে জুলাই হত্যার বিচার দৃশ্যমান করার দাবি জানান। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিন। সাংবিধানিক অর্ডার জারি করুন। গণভোট দিন। ফ্যাসিবাদের কার্যক্রম স্থগিত করুন।
জামায়াতের খুলনা মহানগর আমির মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন দলের খুলনা অঞ্চলের পরিচালক আবদুল খালেক, সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, খুলনা জেলা আমির এমরান হুসাইন প্রমুখ।
ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন দলের খুলনা মহানগর সভাপতি মুফতি আমানুল্লাহ। বক্তব্য দেন জেলা সভাপতি আবদুল্লাহ ইমরানসহ দলের অন্য নেতারা।
কোনো কোনো দল দখল, চাঁদাবাজিতে লিপ্তগতকাল দুপুরে সিলেটের বন্দরবাজার এলাকায় ইসলামী আন্দোলন এবং ধোপাদিঘীরপাড় এলাকায় খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিকেলে নগরের রেজিস্টারি মাঠে সমাবেশ করে জামায়াত।
জামায়াতের সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের শাসনামলে যা ঘটেছে, বর্তমানেও তা ঘটছে। কোনো কোনো দল নিজের দলের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। তারা দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসে লিপ্ত।
সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন জেলা আমির হাবিবুর রহমান, সেক্রেটারি জয়নাল আবেদিন, মহানগর সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহজাহান আলী প্রমুখ। সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।