চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল, তা গত দুই দশকে ধীরে ধীরে বৈরিতায় পরিণত হয়েছে। মার্কিন গণমাধ্যম ও সে দেশের রাজনীতিবিদেরা নিয়মিতভাবে চীনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং চীনের আশপাশে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। ওয়াশিংটন চায়, বিশ্ববাসী বিশ্বাস করুক, চীন বিশ্বের জন্য একটা হুমকি।

চীনের উত্থান নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত করছে; কিন্তু সেই আঘাত ঠিক ততটা গভীর নয়, যতটা মার্কিন নেতৃত্ব তার জনগণের সামনে তুলে ধরছে।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বুঝতে হলে আমাদের বৈশ্বিক অর্থনীতির বড় চিত্রটা দেখতে হবে। ধনী দেশগুলো (যাদের ‘গ্লোবাল নর্থ’ বলা হয়) মূলত গরিব বা মাঝারি আয়ের দেশগুলো থেকে (যাদের বলা হয় ‘গ্লোবাল সাউথ’) সস্তায় শ্রমিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ নেয়, যাতে নিজেদের ব্যবসা থেকে বেশি মুনাফা করতে পারে।

এ ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি, যাতে সারা বিশ্বের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি অনেক বেশি লাভ করতে পারে। ধনী দেশগুলো (মূল) ও গরিব দেশগুলোর (প্রান্ত) মধ্যে দাম ও মূল্য নির্ধারণে একধরনের স্থায়ী বৈষম্য থাকে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গরিব দেশগুলো কম দামে পণ্য দেয়; আর ধনী দেশগুলো সেখান থেকে অনেক বেশি সম্পদ নিয়ে নেয়।

১৯৮০ সালের পর থেকে চীন যখন পশ্চিমা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য নিজেকে উন্মুক্ত করেছিল, তখন থেকে চীন এই বৈশ্বিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। তারা পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর জন্য এক বিশাল শ্রমবাজার তৈরি করে দেয়। এই শ্রম ছিল সস্তা, কিন্তু দক্ষ ও উৎপাদনশীল। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল কোম্পানির উৎপাদনের বড় একটা অংশ চীনের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল।

অর্থনীতিবিদ ডোনাল্ড এ ক্লেল্যান্ডের গবেষণা অনুযায়ী, যদি অ্যাপলকে চীনা ও পূর্ব এশীয় শ্রমিকদের মার্কিন শ্রমিকদের হারে বেতন দিতে হতো, তাহলে ২০১১ সালে প্রতিটি আইপ্যাডে অতিরিক্ত ৫৭২ ডলার খরচ হতো।

কিন্তু গত দুই দশকে চীনের শ্রমিকদের মজুরি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০০৫ সালের দিকে চীনে প্রতি ঘণ্টার শ্রমমূল্য ছিল ১ ডলারের নিচে, যা নাকি ভারতের চেয়েও কম। এখন চীনে প্রতি ঘণ্টার মজুরি ৮ ডলারের বেশি, আর ভারতে সেই মজুরি এখন মাত্র ২ ডলার। আসলে এখন চীন পুরো এশিয়ার সব উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি মজুরি দেয়।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে এমনটা ঘটেছে। প্রথমত, চীনে অতিরিক্ত শ্রমশক্তিকে ধীর ধীরে মজুরিভিত্তিক অর্থনীতির মধ্যে যুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে শ্রমিকদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীন সরকার রাষ্ট্রীয় খাতে হস্তক্ষেপ ও বিনিয়োগ বাড়িয়েছে (যেমন জনস্বাস্থ্য ও আবাসনের মতো সেবা বিস্তৃত করেছে)। এর ফলে শ্রমিকদের অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে।

চীনের জন্য, বিশেষ করে চীনা শ্রমিকদের জন্য, এসব উন্নতি অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু পশ্চিমা পুঁজির জন্য এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, উচ্চ মজুরি পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর লাভে আঘাত হানছে। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি চীনে কাজ করছে বা চীন থেকে যন্ত্রাংশ নিচ্ছে, তাদের জন্য এটি হুমকি হয়ে উঠছে।

চীনকে সামরিক হুমকি হিসেবে তুলে ধরার প্রচারণা আসলে বাস্তবতাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা। বাস্তব হলো চীনের প্রতিজনের সামরিক ব্যয় বিশ্বের গড়ের চেয়েও কম, আর যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ১০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যাও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৮ গুণ কম।

আরেকটি সমস্যা হলো, চীনের পণ্যের দাম ও মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন আগের মতো অসম বিনিময়ের শিকার হচ্ছে না। ১৯৯০-এর দশকে যখন মজুরি খুব কম ছিল, তখন চীনকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার জন্য প্রচুর রপ্তানি করতে হতো। এখন এই অনুপাতে অনেকটাই ভারসাম্য এসেছে। এতে চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অনেকটাই সমতাভিত্তিক হয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো চীন থেকে যেভাবে সম্পদ আহরণ করত, সেটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা পুঁজিবাদী শ্রেণি বিপাকে পড়েছে। তারা আবার সস্তা শ্রম ও সম্পদের নাগাল পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। একটি বিকল্প হলো—উৎপাদন খাতকে চীন থেকে সরিয়ে এমন দেশে নিয়ে যাওয়া, যেখানে মজুরি কম (যেমন বাংলাদেশ বা ভিয়েতনাম)। কিন্তু এতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়, নতুন কর্মী নিয়োগে সময় লাগে এবং সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটে। আরেকটি বিকল্প হলো চীনের মজুরি কমিয়ে দেওয়া। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের সরকারকে দুর্বল করতে চায়, যুদ্ধের হুমকি দিয়ে ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে অস্থির করতে চায়।

বিরোধিতা করার সময় পশ্চিমা দেশগুলো মাঝেমধ্যে বলে, চীনের পণ্য খুব সস্তা। অনেকে অভিযোগ করে, চীন মুদ্রার (রেনমিনবি) মান ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে রাখে। কিন্তু এ অভিযোগও পুরোনো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থনীতিবিদ হোসে আন্তোনিও অকাম্পো ২০১৭ সালে বলেছিলেন, ‘চীন বেশ কয়েক বছর ধরে রেনমিনবির মান কমাতে নয়, বরং তা ধরে রাখতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করেছে। বরং বলা যায়, এখন রেনমিনবির মান কিছুটা অতিমূল্যায়িত।’

২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের চাপ বাড়লে চীন মুদ্রার মান কিছুটা কমায়। কিন্তু সেটা বাজার পরিস্থিতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

চীনের মুদ্রা যখন আসলেই কম মূল্যায়িত ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়া তা সমর্থন করেছিল। এমনকি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে তারা সেটিকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু যখন চীন দাম বাড়াতে ও নিজেকে প্রান্ত থেকে বের করে আনতে শুরু করল, তখন থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

আরেকটি বড় কারণ প্রযুক্তি। চীন গত এক দশকে কৌশলগত খাতে প্রযুক্তি উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলাফলও চোখে পড়ার মতো: বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাইস্পিড রেল নেটওয়ার্ক, নিজস্ব বাণিজ্যিক বিমান তৈরি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক গাড়িতে বিশ্বে নেতৃত্ব, উন্নত চিকিৎসা ও মোবাইল প্রযুক্তি, মাইক্রোচিপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—সবকিছুতেই বিশাল অগ্রগতি পেয়েছে চীন। অথচ চীনের মাথাপিছু আয় উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ৮০ শতাংশ কম।

পশ্চিমা দেশগুলো চায়, কেবল তারাই উচ্চ প্রযুক্তির একচেটিয়া অধিকার রাখবে। চিকিৎসা, বিমান, কম্পিউটার, শিল্প–যন্ত্রপাতি ইত্যাদি খাতে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য চায়। এই আধিপত্য ধরে রাখতে পারলে গ্লোবাল সাউথ তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং সস্তায় সম্পদ রপ্তানি করে এই পশ্চিমা প্রযুক্তি কিনতে বাধ্য হয়। এতে উন্নত দেশগুলো অসম বাণিজ্য থেকে যে লাভ করে, তা অব্যাহত থাকে।

চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এই একচেটিয়া অধিকারকে ভেঙে ফেলছে এবং গ্লোবাল সাউথের জন্য বিকল্প উৎস তৈরি করছে। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর কর্তৃত্ব দুর্বল হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র তাই চীনের প্রযুক্তিকে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। তবে এখন পর্যন্ত এতে চীনের অগ্রগতিতে হোঁচট খাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; উল্টো চীন আরও বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে।

তাই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য অস্ত্র ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ-উসকানির নীতিতে যাচ্ছে। লক্ষ্য হলো চীনের শিল্পকাঠামো ধ্বংস করা, তাদের বিনিয়োগ প্রতিরক্ষায় ঘোরানো এবং অর্থনীতিকে দুর্বল করা।

চীনকে সামরিক হুমকি হিসেবে তুলে ধরার প্রচারণা আসলে বাস্তবতাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা। বাস্তব হলো চীনের প্রতিজনের সামরিক ব্যয় বিশ্বের গড়ের চেয়েও কম, আর যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ১০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যাও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৮ গুণ কম।

হ্যাঁ, চীনের জনসংখ্যা বিশাল, কিন্তু সামগ্রিক সামরিক ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চীনের তুলনায় ৭ গুণ বেশি ব্যয় করে।

বরং বিপরীত দৃশ্যটাই সত্যি। যুক্তরাষ্ট্রের শত শত সামরিক ঘাঁটি রয়েছে সারা বিশ্বে। তার অনেকগুলোই চীনের চারপাশে (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া) আছে। বাইরে চীনের মাত্র একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, সেটাও জিবুতি নামক আফ্রিকান একটি দেশে।

গত ৪০ বছরে চীন কোনো যুদ্ধ শুরু করেনি। অথচ এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এক ডজনের বেশি গ্লোবাল সাউথ দেশে হামলা চালিয়েছে, সরকার উৎখাত করেছে।

সত্য কথা হলো, চীন আজ যে ধরনের স্বশাসিত উন্নয়ন করছে, তা পশ্চিমা পুঁজিবাদের ভিত্তিমূলক কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা এ উন্নয়নকে সহ্য করতে পারছে না। তাই তারা চীনকে থামাতে মরিয়া।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জেসন হিকেল লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ভিজিটিং ফেলো এবং রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সদস্য।

ডিলান সুলিভান ম্যাককোয়ারি ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ফেলো

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ দ র বল র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্বে ছাত্রদের নেতৃত্বে শীর্ষ ১০টি আন্দোলন

ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সব সময়ই শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন। হোক সরকার উচ্ছেদ কিংবা বড় সংস্কার, ছাত্ররা প্রায়ই থেকেছে পরিবর্তনশীল বিভিন্ন আন্দোলনের অগ্রভাগে। বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলন এই তালিকার সর্বশেষ বড় উদাহরণ। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাই। বিশ্বজুড়ে পরিবর্তন আনা ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ ধরনের ১০টি ঐতিহাসিক আন্দোলনের কথা জেনে নেওয়া যাক।

১. জুলাই গণ–অভ্যুত্থান (বাংলাদেশ, ২০২৪)জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রতিবাদ মুখর শিক্ষার্থীরা, ঢাকা, জুলাই ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ