রক্তক্ষয়ী জুলাই বিপ্লবের পর এক বছর অতিক্রান্ত হলো। এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই সেই উত্তাল দিনগুলো। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কেমন ছিল আমার অংশগ্রহণ, কেমনই-বা ছিল অনুভূতি?
নির্বাচন নিয়ে কারচুপি, বাজারে খাদ্যদ্রব্যসহ প্রতিটি নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের অগ্নিমূল্য, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা, সাংবাদিক সম্মেলনের নামে প্রধানমন্ত্রীকে (সাবেক) চিহ্নিত কয়েকজন সাংবাদিকের তেলবাজির প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার দলীয় ব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্নীতির ঘটনা থেকে অনেক দিন ধরেই মনে ক্ষোভ জমেছিল। তবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন শুরু হলো তখন ভাবতেও পারিনি এই আন্দোলন এমন বিপ্লবে রূপ নেবে।
অফিসে যাতায়াতের পথে চোখে পড়তো শিক্ষার্থীরা রাজপথে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছেন। ফেসবুকে দেখতাম পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম স্ট্যাটাস। জুলাই মাসে এই আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠতে লাগলো। শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল কিন্তু তখনও সরাসরি রাজপথে নেমে তাদের পাশে দাঁড়ানো হয়নি। আমি তখন এমন একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি যেখান থেকে ব্যক্তিগত কোনো ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যাটাস দেওয়া সমর্থনযোগ্য ছিল না।
আরো পড়ুন:
জুলাই গণঅভ্যুত্থান: সিরাজগঞ্জে ৪ আগস্ট নিহত হয় ২৯ জন
রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ
এদিকে পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছিল। ১৬ তারিখে যখন আবু সাঈদের দুই বাহু মেলে দিয়ে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ভিডিও দেখলাম সেই মুহূর্তের অনুভূতি কোনো দিন ভুলবো না। নিরস্ত্র আবু সাঈদের বুকে সরাসরি গুলি বর্ষণ হচ্ছে! সে যেন তখনও বুঝতেই পারছে না তারই দেহে ঢুকছে ঘাতক বুলেট। একটু থমকে সে দুই পা এগিয়ে এলো। তারপর ঠিক যেন ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। সেদিনই আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এই বিপ্লবকে সমর্থন জানালাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এই বীর তরুণদের পাশে যদি না দাঁড়াই তাহলে আমি কোনো মানুষই নই। সেসময় আমি একের পর এক কবিতা লিখেছি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি, রাজপথে দাঁড়িয়েছি।
এরপর মীর মুগ্ধর শহীদ হওয়া। রিকশায় মুমূর্ষু নাফিসকে বহন করার দৃশ্য। ছোট্ট শিশু রিয়া গোপের শহীদ হওয়া। আরও অনেক শিশুর মৃত্যুর কথা শুনছিলাম। উত্তরায় জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও নিহত হওয়ার ভিডিও রেকর্ড করে পাঠালেন এক বন্ধু। সাভারে পুলিশের এপিসি থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য, রাস্তার উপরে তার আহত দেহের সেই আক্ষেপ এবং শহীদ হওয়া- আহারে! কোনো মায়ের আদরের সন্তানকে এমনিভাবে হত্যা করা হলো!
আমি যেন আর সহ্য করতে পারছিলাম না। এরা যে আমারই সন্তানের বয়সী। এরা যেন আমারই সন্তান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপর ছাত্রলীগের নামধারী গুন্ডাদের আক্রমণ, নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর পুলিশের গুলি, টিভিতে দেখলাম কতিপয় দালাল সাংবাদিকের গণহত্যায় উসকানি, মানুষ মরছে আর মেট্রো রেলের জন্য স্বৈরাচারের নাকি কান্না- এসব এমনভাবে সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল যে তখন যদি আমি ছাত্র জনতার আন্দোলনে শরিক না হতাম তাহলে মানুষ হিসেবে আর কখনও আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে পারতাম না। পাশাপাশি দেখছিলাম শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের কতিপয় দালাল তখনও স্বৈরাচারের পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থন দিচ্ছিল। ফেসবুকে যেমন জুলাই বিপ্লবের পক্ষে স্ট্যাটাস দিচ্ছিলাম আমরা, তেমনি আবার স্বৈরাচারের পক্ষ অবলম্বনকারীরাও নানা রকমভাবে জুলাই বিপ্লবের বিরুদ্ধাচারণ করে যাচ্ছিল সব লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে।
আমি বিভিন্ন স্ট্যাটাসে লিখছিলাম, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি, হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ায় বাধাদান– এমন ফ্যাসিস্ট আচরণ দেখেও কোনো মানুষের পক্ষে কি চুপ করে থাকা সম্ভব? যেখানে আমার সন্তানসম ছেলেমেয়েরা গুলিতে শহীদ হচ্ছে সেখানে কি কোনো অভিভাবকের পক্ষে তাদের পাশে না দাঁড়ানো সম্ভব? আমি নিশ্চিত অনেক মানুষই আমার মতো এই অনুভূতি থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে এসেছিলেন।
আমি এখনও মনে করি, যারা নিরস্ত্র জনতার উপর এ ভাবে গুলিবর্ষণ দেখার পর, আয়নাঘরের ছবি দেখার পর, পনেরো বছরের গুম-খুনের ঘটনাগুলো জানার পর, পতিত স্বৈরাচারের দলবলের সীমাহীন দুর্নীতির তথ্য জানার পরও ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সমর্থন করছেন, তার পক্ষে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, তার ক্ষমতা হারানোয় আফশোস করছেন তিনি নিজেই ফ্যাসিস্ট।
একবার স্মরণ করুন জুলাই বিপ্লবের সেই দিনগুলোতে কারফিউ, টিয়ার গ্যাস, গুলি চালানো, ইন্টারনেট বন্ধ করার ঘটনাগুলো। স্মরণ করুন ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট ) বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো ঢাকায় জনতার ঢল। যাত্রাবাড়িতে সেই জনতার উপর ভয়াবহ গুলিবর্ষণ। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার হেলিকপ্টারে চড়ে পলায়ন, জনতার গণভবনে প্রবেশ। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র জনতার বিজয়ের পর পাঁচ দিন দেশে কোনো পুলিশ প্রশাসন কার্যকর ছিল না। সেসময় আমরা নিজেরাই যার যার পাড়ামহল্লা পাহারা দিয়েছি। ডাকাত পড়ার গুজব রটনাকারীরা ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সফলভাবে রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করেছে। আমার মনে হচ্ছিল, এই দিনগুলোতে সমস্ত দেশের শান্তিকামী মানুষ যেন এক হয়ে গিয়েছে। পাড়ায় মহল্লায় প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন ঐক্য এর আগে কখনও দেখিনি। ৩৬ জুলাই রাস্তায় নেমে জনতার সঙ্গে উল্লাস করেছি, প্রেসক্লাবে গিয়েছি। মনে হচ্ছিল যেন আবার নতুন করে স্বাধীন হলাম!
জুলাই বিপ্লবের পর একটি বছর পার হয়েছে। এই এক বছরে আমাদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি অনেক। সেসব হিসেব অবশ্যই হবে। তবে এটি নিশ্চিত,ফ্যাসিস্টবিরোধী এই গণঅভ্যুত্থানে জুলাই বিপ্লবের শহীদদের জাতি কখনও ভুলবে না। জুলাই বিপ্লবে শহীদ সকলের নাম এবং শাহাদাত বরণের বৃত্তান্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন। জুলাই বিপ্লবে যারা আহত হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই এখনও যন্ত্রণা ভোগ করছেন। আহতদের প্রত্যেকের সুচিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। জুলাই বিপ্লব জিন্দাবাদ। শহীদ স্মৃতি অমর হোক।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণঅভ য ত থ ন ছ ত র জনত র জনত র উপর ন রস ত র ত র উপর ফ সব ক করছ ন র জপথ
এছাড়াও পড়ুন:
শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রত্যাগের প্রস্তাব মাওবাদীদের
ভারতীয় যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে সংঘর্ষবিরতির আর্জি জানিয়েছে মাওবাদী ও নকশালবাদীরা। গত ৯ মাসে ২১০ জন সদস্যের মৃত্যুর পর ভারত সরকারের কাছে প্রথমবারের মতো শান্তির দাবি জানাল মাওবাদীরা। সশস্ত্র এই বামপন্থী সংগঠনটির পক্ষে এক প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়েছে, শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে হাতিয়ার ছেড়ে বৈঠকে বসতে রাজি তারা।
মাও-কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়েছে, তারা আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রত্যাগ করতে রাজি। যাতে সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষ সমাধানের পথে আসতে পারে। তবে সেই আলোচনার পথে সরকার যেন কোনোরকম চালাকি না করে।
আরো পড়ুন:
মাদক পাচারে অভিযুক্ত ১৬ হাজার বিদেশিকে বহিষ্কার করবে ভারত
অনুষ্ঠান করে স্ত্রীকে বিয়ে দিলেন স্বামী
জানা গেছে, গত ১৫ অগাস্ট সরকারকে এই প্রস্তাব পাঠিয়েছিল মাওবাদীরা।
১৫ অগাস্ট লেখা চিঠিতে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, একমাস ধরে এই সংঘর্ষবিরতি জারি রাখার আর্জি জানিয়েছিল মাওবাদীরা। তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাতে চায় তারা। মাওবাদীদের সাধারণ সম্পাদক অভয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। তবে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে মাওবাদীদের এই চিঠির কোনো জবাব এখনও দেওয়া হয়নি বলেই খবর।
মাওবাদী নেতা অভয়ের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই সংঘর্ষ যাতে থামে সেটা আমরাও চাই। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত বদল করেছি। তবে এই বিষয়ে আমাদের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানানো উচিত। যদি সরকার সত্যিই আলোচনা চায় তাহলে আমাদের এক মাসের সময় দেওয়া হোক। এই সময়ে জেলবন্দি শীর্ষ মাওবাদী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চায় তারা। তবে এই এক মাস যাতে কোনো অভিযান না চলে সেটাও জানানো হয়েছে মাওবাদীদের তরফে।
মাও সংগঠনের বার্তা, “এই সময়কালে তাদের উপর যেন নিরাপত্তবাহিনী কোনোরকম অভিযান না চালায়। সরকার যদি চায় তবে কাল থেকেই ভিডিও কলের মাধ্যমে আলোচনা চালাতে প্রস্তুত আমরা।”
প্রসঙ্গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে এখনও পর্যন্ত নকশাল বিরোধী অভিযানে কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকারগুলোর যৌথ নিরাপত্তা বাহিনী উল্লেখ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত ৪৯৮ জন মাওবাদী নিকেশ হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৬১৬ জনকে।
২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে মাওবাদমুক্ত ভারত গড়ার বার্তা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছত্তিশগড়ে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাওবিরোধী অভিযান আরো গতি পেয়েছে। এরমধ্যে ২০২৪ সালে বস্তার অঞ্চলে নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানে মৃত্যু হয়েছে ২৮৭ জন মাওবাদীর। পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করেন ১ হাজার ৬৬৬ জন। ২৪-এর পর ২০২৫ সালে অভিযানের ঝাঁজ আরো বেড়েছে। রিপোর্ট বলছে, গত ৯ মাসে এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছে ২১০ জন মাওবাদীর। এদের মধ্যে শুধুমাত্র ছত্তিশগড়ে ১৩ জন শীর্ষ মাওবাদী নেতার মৃত্যু হয়েছে। যাদের মাথার দাম ছিল ন্যূনতম ২০ লাখ থেকে এক কোটি রুপি পর্যন্ত। কেবলমাত্র ছত্তিশগড়েই ৬৫টি নতুন সুরক্ষা ক্যাম্প খোলা হয়েছে।
অনুমান করা হচ্ছে, একের পর এক শীর্ষ কমান্ডারের মৃত্যুর পর নকশালদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। তারা এখন বেশ কিছুটা ব্যাকফুটে। আশঙ্কার আবহও মাওবাদীদের মধ্যে। আর সে কারণেই তাদের পক্ষ থেকে বারবার সংঘর্ষবিরতির আর্জি জানানো হচ্ছে। তবে সরকার মাওবাদীদের সে দাবি মানবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ