এক বছর আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীসহ দেশের নানা শহরের দেয়ালে ফুটে উঠেছিল ‘গ্রাফিতি’ নামের বিপুল এক শৈল্পিক প্রতিবাদ। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাঁচা হাতের আঁকা ও হৃদয়ের গভীর অভিব্যক্তিময় সেই দেয়ালচিত্রে উঠে আসে সংহতির আহ্বান। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ধিক্কার। ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রতিটি তুলির আঁচড়ে, রঙের স্পর্শে, বাক্যে ও প্রতীকে প্রকাশিত হয়েছিল রাষ্ট্র বদলাবে, আমরা বদলাব এমন আশাবাদী প্রত্যয়। সেই দেয়ালচিত্রগুলো এখনো আছে। তবে তা অনেকটাই বিবর্ণ, ধুলো পড়া।
ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড দিয়ে যাতায়াতের সময় এখনো নাগরিকদের চোখে পড়বে দেয়ালের লিখন ‘দেশের কোনো ধর্ম নেই/ দেশের কোনো বর্ণ নেই/ দেশ আমার, দেশ তোমার।’ গত বছর লাল রঙে লেখা এই বার্তা হয়ে উঠেছিল গণ–অভ্যুত্থানের মর্মবাণী। মোহাম্মদপুরে কেউ লিখেছিলেন ‘আমার দেশের ছাত্রছাত্রী পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী’, এমন এক সাহসী সত্য। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে স্বৈরশাসকের পতনের পর ঢাকার ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, ভবনের দেয়ালে দেয়ালে, মেট্রোরেলের স্তম্ভে আঁকা হয়েছিল এমন অসংখ্য গ্রাফিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে লেখা ছিল, ‘ঘুষ চাইলে ঘুষি’। আবার কোথাও লেখা, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে’, গাছের পাতায় পাতায় বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের নাম, নিচে লেখা ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। এসব গ্রাফিতিতে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, প্রিয়, ফায়াজ, তামিমদের মুখ পরিণত হয়েছিল নতুন বাংলাদেশের প্রতীক।
গণ-অভ্যুত্থানকে ঘিরে আঁকা এই গ্রাফিতিগুলো দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসের এক শৈল্পিক নিদর্শন হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এতে লেখা হয়েছে অভ্যুত্থানের মর্মবাণী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান গণ-অভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ছিল প্রেরণার অন্যতম উৎস। তাঁর ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’, ‘মোরা বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন চিত্ত মুক্ত শতদল’—এমন বিভিন্ন পঙ্ক্তি এসেছে গ্রাফিতিতে। বক্তব্য বিষয়ের পাশাপাশি গ্রাফিতির অঙ্কনশৈলী তরুণ প্রজন্মের মনন ও সৃজনশীলতার নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়েছে। সর্বোপরি মানুষের মনে দেশ-সমাজ নিয়ে ভাবনা ও সৌন্দর্যবোধ জাগাতে কাজ করেছে এসব সচিত্র দেয়াললিখন। এভাবেই জুলাইয়ের গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিল্প সমালোচকদের জন্যও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
গত বছর আন্দোলনের সময়ের আলোকচিত্র, গ্রাফিতি, পোস্টার, গ্রাফিকস, কার্টুন নিয়ে একাধিক বই এবং অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলো ‘মুক্ত করো ভয়’ নামে নির্বাচিত ৮৭টি আলোকচিত্র ও গ্রাফিকস নিয়ে ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রকাশ করে ‘জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ফটো জার্নাল’।
গ্রাফিতি নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য বই আর্ট অব ট্রায়াম্ফ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি সম্পর্কে খুব আগ্রহী ছিলেন। পরে ৫৬টি গ্রাফিতির আলোকচিত্র নিয়ে বইটি প্রকাশ করা হয়। বইটিতে রয়েছে লাল-সবুজ পতাকার পটভূমিতে দুই হাত প্রসারিত বীর আবু সাঈদের প্রতিকৃতি, ‘রক্তাক্ত জুলাই’ নামে শহীদের মৃতদেহ বুকে নিয়ে পথে নামা স্বজনদের ছবির গ্রাফিতি।
বিগত সরকারের আমলে কার্টুনিস্টরা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে পারতেন না। অভ্যুত্থানের পরে একটি বড় কার্টুন প্রদর্শনী হয়েছিল দৃক গ্যালারিতে। সেই প্রদর্শনীর নির্বাচিত কার্টুন ও গ্রাফিতির ছবি নিয়ে ‘জুলাই আপরাইজিং: স্যাটায়ার অ্যান্ড রিডিকুল’ নামে একটি অ্যালবাম যৌথভাবে প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, দৃক পিকচার লাইব্রেরি লি.                
      
				
প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে গণ-অভ্যুত্থান ও গ্রাফিতির আলোকচিত্র ধারণ করেছেন। তাঁদের অনেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রাফিতির ছবি সংগ্রহ করে অ্যালবাম বা বইও প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে গত বছর একটি বড় প্রকাশনা ছিল আলোকচিত্রী তানি জেসমিনের অরুণ প্রাতের তরুণ দল: সংগ্রামের শত রঙ বইটি। এতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের গ্রাফিতিগুলোর ছবি আছে।
ম্লান হয়ে আসছে গ্রাফিতি। গত রোববার রাজধানীর বেইলি রোডেউৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।
সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।
ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’