শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ
Published: 5th, August 2025 GMT
সংস্কৃতি একটি দেশের গতিপথের নিশ্চিত নির্ধারক। আমরাও ক্ষেত্রবিশেষ বিভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই যেন ভাগ্যের অঘোষিত নির্দেশদাতা। অথচ কেউ জানি না এর পরিচয়। এখানে ‘পরিচয়’ জানাটাই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুদ্ধ জয়ের চেয়েও বেশি কিছু। ব্যক্তির যতক্ষণ নিজস্ব আদর্শ বা আইডোলজি না থাকবে ততক্ষণ সে অন্যের আইডোলজি বাস্তবায়নে লড়াই-সংগ্রামের মাঠে নিমজ্জিত থাকবে, পরিচালিত হবে। যখন নিজস্বতার ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হবে, তখন পূর্বের আইডোলজির বিপক্ষে অবস্থান নেবে- এটাই স্বাভাবিক। ধর্মের প্রধানরা পূর্বের ধর্মবিশ্বাস পরিহার করে নিজস্ব বয়ান বাস্তবায়নে মাঠে-ময়দানে সক্রিয় থেকেছেন, পাশাপাশি অনুসারীদের সক্রিয় রেখেছেন।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রাজ্ঞজনেরা এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের দিয়ে বয়ান তৈরির মাধ্যমে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। ভুল বা শুদ্ধ ইজম বা বাদ যা-ই হোক কারও সামনে মুক্তি এবং স্বাধীনতার বিকল্প কিছুই ছিল না তখন। অনিবার্যতা নিয়ে সাতচল্লিশ সালে ভারত থেকে পাকিস্তান এবং একাত্তরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। বাঙালি সমর ও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ড প্রতিষ্ঠা করল। ভূ-খণ্ড পৃথক হলেও প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের ‘মুক্তি এবং স্বাধীনতা’ বাঙালির কপালে আজও জোটেনি; তা কেবল কিছু ব্যক্তির ভাগ্যরেখার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। যাদের জীবনে মুক্তি এবং স্বাধীনতা অর্থাৎ দুটিই ঘটেছে, তারা ছিল চরম সুবিধাভোগী। যে কোনো কৌশলেই হোক অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে আগে ভেবেছিল তারা। ফলে জমিদারি প্রথার অবসান আজও ঘটেনি এখানে। একইভাবে তাদের অধীনস্ত হয়ে পড়ে আমাদের সংস্কৃতি। অথচ সংস্কৃতি হলো যে কোনো দেশের আত্মা বা প্রাণ। আত্মার হরণ হলে যেভাবে দেহ নিথর, একইভাবে দেহের ভেতরে আত্মার উপস্থিতিতে সবাই সক্রিয়, আত্মা যেদিকে মোড় নেয়, শক্তি ও সামর্থবানরা ওই পক্ষে দাঁড়ায়। এখন নিশ্চিত হওয়া দরকার আমাদের সংস্কৃতি বা আত্মা আসলে কি? সেটা কতটুকু দেহে সচল কিংবা ক্রিয়াশীল।
শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি মূলত একই টবে রাখা তিনটি ভিন্ন বীজ, তারা একই মাটির রস শুষে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে বড় হয়, বলা যেতে পারে পরিপূরক। সংস্কৃতি একটি সমাজের জীবনধারা, যার মধ্যে রীতিনীতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, এবং ঐতিহ্য অন্তর্ভুক্ত। শিল্প হলো চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য যা সংস্কৃতিরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মাধ্যমে সমাজের মানুষের আবেগ, অভিজ্ঞতা, এবং চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করে। আবার সাহিত্য হলো লিখিত বা মৌখিক রূপ। শিল্পকলার এই রূপটি ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে গল্প, কবিতা, নাটক, ইত্যাদি তৈরি করে মানুষের অভিজ্ঞতা ও ভাবনাকে প্রকাশ বা বিকাশ করে।
আরো পড়ুন:
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের পথে সরকার কতটা এগুলো?
ফিরে দেখা আমাদের জুলাই বিপ্লব
মুশকিল হলো এক সময় বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি জমিদারি প্রথা বা পদ্ধতির কাছে বর্গা ছিল। বর্তমানে এর উন্নতির চেয়ে অবনতিই বেশি। অর্থাৎ টবে রাখা তিনটি বীজ এখন ভিন্ন ভিন্ন মাটি ও সার (মালিক) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! যা সত্যিকারার্থে জাতীয় জীবনে অশনি সংকেত। টব সম্ভ্রান্তদের বাসা-বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধন করে। ফলে টবে থাকা গাছেরও সম্ভ্রান্তদের পছন্দ। এভাবেই বীজ থেকে গাছ হয়, গাছ থেকে ফুল। সেই ফুল চারপাশের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ফল ও বীজ দেয়। অর্থাৎ পরিচর্যা করলে তারা সৌন্দর্যের পাশাপাশি ফল ও বীজ দিয়ে আর্থিকভাবেও সুবিধা দিতে পারে। সাধারণের চোখ তখন স্বাভাবিকভাবেই ফুল ও ফলে সৌন্দর্যবর্ধনকারীর বাড়িতে যাবে।
মানুষ শেষ পর্যন্ত সৌন্দর্যপিপাসু ও আরামপ্রিয়। এদিকে সবাই নত ও অবনত। সৌন্দর্যটা ধীরে ধীরে নন্দনে পৌঁছে। আমরা জানি নন্দনতত্বের মূল্য নান্দনিক মানুষের কাছে অনেক। নন্দনজীবীরা ধীরে ধীরে নন্দন নিয়ে বাণিজ্য বাজার সাজায়। আর বাণিজ্য শব্দের ভেতরে রাজনীতিটাও অবধারিতভাবেই প্রবেশ করে। কারণ নন্দনের আগ্রাসন সবসময় ভয়ংকর। এর দ্বারা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যা অনেক সময় স্বয়ং রাষ্ট্রকেই বিপদে ফেলে দেয়। তাই সংস্কৃতি যে কারো হাতেই যেতে পারে, সেই চিন্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এর নিয়ন্ত্রক কে বা কারা? কে টবে পানি দেবে? কে ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে? আর কে ফল সংগ্রহ করে ক্ষুধা নিবারণ করবে? কার কাছে বীজ থাকবে?
তবে অপরিহার্যতা হচ্ছে এদের নিরাপত্তা! সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত এই আশ্বাস না মিলবে ততদিন জাতি ও রাষ্ট্র অনিরাপদ। যদিও সকলে জানি সব কিছুর চেয়ে বড় বা মহান রাষ্ট্র।
০২.
সাধারণের চোখে সংস্কৃতি একদম সাদামাটা এবং অপ্রয়োজন। এর গুরুত্ব, ইচ্ছা বা অনিচ্ছা দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্র মোটেও বিচলিত নয়। নিয়ন্ত্রক যেভাবে পরিচালনা করছে, ঠিক সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ শ্রেণি ঠিক সেভাবেই নেচে অভ্যস্ত। এই অভ্যস্ততা বা অভ্যাসই সাধারণকে আরও বেশি পরাজিতের কোর্টে ঠেলে দেয়। এতে সহজেই পরিবর্তন হয়- রান্না থেকে খাবার, বড় ও ছোটদের আদাব, পোশাকের চরিত্র, প্রতিদিনের আনন্দ ও বিনোদন, একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের ধরন। পরিবর্তিত বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, লোকবিশ্বাস ও কুসংস্কার। এসব পরিচালিত হয়ে আসছে আমাদের রাজনীতির মোড়লীপনায়। একশ্রেণি ভালো খাবে, বিত্তশালী হবে, গাড়ি-বাড়ি হাঁকাবে, তার বা তাদের প্রচলিত আইনে সব কিছু পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হবে। যা দেখেই সাধারণের মধ্যে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি হবে, ধর্মহীন অথবা ধর্ম বিশ্বাসকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে, আবার এভাবেই লোকসংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা, কুসংস্কার শক্তিশালী অথবা দুর্বল হবে। এখানে সাধারণের স্বার্থের চেয়ে সুবিধাবাদের স্বার্থ বেশি বিরাজমান। যা বর্তমানে চলমান। এই হলো আমাদের সংস্কৃতি।
এই সংস্কৃতির পুরোধাদের বলা যেতে পারে কালচারাল কালপ্রিট। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতি এখন কালচারাল কালপ্রিটের দখলে। রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে পরাজিত করা যেতেই পারে, রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো যেতে পারে, কিছু মানুষকে শাসন ও শোষণ করা যেতেই পারে, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু লিখিত ও অলিখিত সুবিধাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাধ্যমে কালচারাল কালপ্রিটদের পরাস্ত করা একপ্রকার অসম্ভব!
কারণ কালচারাল কালপ্রিটরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুবিধাজনক বন্ধন তৈরি করে রেখেছে। মহাসাগর থেকে সাগর, সাগর থেকে নদী, নদী থেকে শাখা নদী, এরপর নাল, খাল, বিল। মহাসাগর আর বিল যেন একই বৃত্তে রচিত। যেখানে নতুনদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। দরজা খোলা তো দূরালাপ, পারলে যে কোনো জয়কে কালচারাল আগ্রাসন দিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে নতুন বয়ান বা ফতোয়া তৈরির মাধ্যমে অন্যায়কে ন্যায় বলে জাহির করে। আর এভাবেই সচেতন কালপ্রিটরা নিষ্পাপ পাখির মুখ দিয়ে নোংরা শব্দ উচ্চারণ করায়, কুকুরের গলায় প্রতীকী ঘণ্টা বাজায়, মঙ্গলশোভা যাত্রার নামে পেঁচা ও পিশাচকে ভাগ্যরেখা ভাবে, মানুষকে জানোয়ার বানিয়ে বাথরুমে ছবি টানায়, আবার সেই ছবিতে মূত্র বিসর্জনও করা হয়!
শুধু তাই নয়, শিল্প ও সংস্কৃতির ছায়াতলে মিশে ইনিয়ে বিনিয়ে সত্যকে মিথ্যা তৈরির ফেনোমেননের সকল কৌশল সাজায়। আর এভাবেই সমাজ থেকে সত্য বিতাড়নে সহযোগিতা করে তারা। মানুষ ভুলে যায়- ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য। এটা কেন কীভাবে সম্ভব? সংস্কৃতির নীতি-নির্ধারক বা কালপ্রিটদের হাতে থাকে অঢেল অর্থ, শিথিল শর্ত, ফাঁদে ফেলার মতো নিশ্চিত সত্য বা মিথ্যা তথ্য, যা দিয়ে ইচ্ছার বাস্তবায়ন দ্রুত করা সম্ভব। কীভাবে? অর্থের মাধ্যমে উপহার-উপঢৌকন পাঠিয়ে, যে কোনো আনন্দ-উৎসবের আয়োজনে, বিষদ বয়ান ও বক্তব্য লিখে দেশী ও বিদেশী জার্নালে প্রকাশের মাধ্যমে, আর্থিকভাবে নন্দনজীবীদের সঙ্গ দিয়ে, দেশের মূলধারার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের চারপাশে সুবিধার ঢেউ তুলে। অর্থাৎ কালচারাল কালপ্রিটদের কাছে অর্থই হলো সাধারণকে দুর্বল করার ভিত্তি। যে অঞ্চলের মানুষ অর্থের বিনিময়ে সাময়িকভাবে ধর্মান্তরিত হতে পারে, সেখানে অর্থের বিনিময়ে কালচারাল হেজিমনি বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য তৈরি জটিল কিছু নয়।
রাজনীতিতে যদি থাকে তেরো প্যাঁচ, কালচারে থাকে চুয়ান্ন প্যাঁচ। সহজভাষায় যাকে বলে মারপ্যাঁচ। এরা কেবল স্বার্থের জন্যই কখনও সামাজে প্রচলিত সংস্কৃতি, কখনও ধর্মের নামে সংস্কৃতি ব্যবহার করে থাকে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাছে রাজনীতিও যে কিছু না, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সেটা অনুধাবন করতে পারে অনেক অনেক বছর পরে। পৃথিবীজুড়ে মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, মাও সে তুংবাদ কেন এতটা জনপ্রিয়? কারণ, এখানে শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সমাজের আগমন বেশি ঘটেছে। এর প্রভাব রাজনীতির চেয়ে শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিকভাবেই বেশি।
০৩.
শিল্প বলতে প্রচলিত ভাষায়, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, অথবা আবেগ, অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাভাবনাকে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একমঞ্চে হাজির করা। অথচ এখানে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত অথবা নৃত্যকে আস্তিক ও নাস্তিকের বলে বিভাজন টানা সহজ। সহজার্থে প্রগতিশীলদের সাহিত্যকে উচ্চমার্গীয় ভাবনায় রাখতে যৌক্তিক মানে একপক্ষ, অন্যপক্ষ আস্তিকদের সাহিত্য, তৃতীয় পক্ষ ভাবে ধর্মীয় সাহিত্য। আর মানুষের জন্য সাহিত্য, সঙ্গীত বা ভাবনাকে একত্রীভূত করতে পারেন কেবল সত্যিকারের শিল্পী। যিনি নিজেই হয়ে ওঠেন সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যের ধারক বা বাহক।
এরপরও কালচারাল কালপ্রিটের আহ্বানে কেউ কেউ ব্যক্তির বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে গর্তে টেনে প্রবেশ করানোটা নেহায়েত বোকামি ছাড়া কিছু নয়। এতে মূলত বিভক্ত হয় জাতি। বিভক্তির রেখাটা টেনে ষোলোকলা পূর্ণ করে কালচারাল কালপ্রিট বা নন্দনজীবীরা। তাইতো জাতি বলতে বাধ্য হয়- রবীন্দ্রনাথের শিল্পসত্তাকে জমিদারি প্রথা, নজরুলের কাব্যপ্রতিভাকে গরিবের বিদ্রোহ, বুদ্ধদেব বসুর সাধনাকে ইউরোপিয়ান ট্রেন্ট, সৈয়দ মুজতবা আলীকে হাস্যরসাত্মক, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাহিত্য মাওলানা-মৌলভীর, ফররুখ আহমেদ ইসলামী ধ্যান ও ধারণার কবি, জসিমউদদীন পল্লীবাংলার চাষাভূষার গায়ক ও পুঁথি লেখক, সুকান্ত পুঁচকে কবি, শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের তকমাটা কেবল সাহিত্যের কালচারাল হেজিমনি ছাড়া কিছু নয়। এতে কেউ কেউ নোংরা সুখ পায়! অথবা নিজের কব্জি বা পকেটের উপর জোর জাহির করে করে রবীন্দ্রনাথকে জমিদার সাহিত্যিক ঘোষণা বলবৎ রাখে। আবার হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম কবি তকমায় বিশাল কিছু হলেও তাঁকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করলে যেন সম্ভ্রান্তদের ইজ্জতে টান পড়বে, মানে অসম্ভব! এমন প্রতিজ্ঞা শিল্পকে শুধু দুর্বল করে না বরং নানান প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়।
এই বয়ানের মাধ্যমেই দুর্বল সিলেকশন হয়ে যায় শক্তিশালী সাহিত্য বা সংস্কৃতি। তথাকথিত শক্তিশালী সাহিত্য দুর্বল সাহিত্যকে ডোমিনেট করবে এই ফর্মুলায় এটাই সত্য। কিন্তু কোনটা শক্তিশালী আর কোনটা দুর্বল এই বিচার যখন কালচারাল কালপ্রিটের হাতে তখন সেখানে আশার কিছু থাকে না। মূলত এর মূল মানদণ্ড অর্থ ও রাজনীতি। বর্তমানে অর্থ যে কোনো কিছুর চালিকা শক্তি। যারা একটা সম্প্রদায়কে শাসন ও শোষণের ভেতর রাখে, আর্থিক সুবিধা, মানসিক স্বাধীনতা, কথা বলার স্পেস, চিন্তার সুযোগ ও সময়কে সীমিত করে দেয় মূলত তারাই আবার বিচারক। কেউ কেউ শত সমস্যা সঙ্গে করে শক্তিশালী সৃজনকর্ম সম্পাদনের পরও অবমূল্যায়িত কিংবা অসাহিত্যিক তকমাটা পেয়ে যায়। এভাবেই যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কর্মে অযোগ্য করে দেওয়া হয়!
বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ এমনটাই দেখেছে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে কেউ কেউ বলছে- এদের পক্ষে ভালো কবি, লেখক, গায়ক, নায়ক, শিল্পী, সাধক, সাংবাদিক কিংবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই বলনেঅলাদের সমীপে কিছু প্রশ্নও থেকে যায়। পরিকল্পনাহীন ব্যাটিং করলে মাঝেমধ্যে এক বা দুটি ছক্কা হাকানো সম্ভব, কিন্তু দল জেতানো অসম্ভব। নিয়মিত রান পেতে হলে বাস্তবতা মানতে হবে, তাহলেই দলে ধারাবাহিক হওয়ার পাশাপাশি দল জেতানোতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখা যাবে। প্রথমেই প্রয়োজন মাঠ, তারপর খেলোয়াড়। সেই খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষিত করতে প্রয়োজন যোগ্য কোচ। কোনোটাই ছাড়া খেলতে নামলে ভয়ংকর পরাজয়ের মুখোমুখি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর এভাবেই হারিয়ে যায় বহুভালোত্ব, হারিয়ে যায় সৌন্দর্য, নন্দনতত্ত্ব, নান্দনিক ব্যক্তিত্ব। হতেও পারতো সেই নান্দনিক জনই বিশ্বসংসারের দারুণ দার্শনিক। পক্ষপাতিত্বের শিল্প, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা যতদিন এখানে বিরাজমান হবে, ততদিন ভালো কিছু হওয়া সত্যিই কঠিন হবে। যদিও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ হলো মূল। মূল সনাক্তকরণে যত বিলম্ব হবে, পরাজিত শক্তির উত্থান হাজারগুণ দ্রুত হবে।
তাহলে এর দায় ও দায়িত্ব কার? দায় দেশের কালচারাল সেন্টার বা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের, মন্ত্রণালয়ের হাব (বাংলোদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি) সহ দেশের অন্যান্য সংস্কৃতিবান্ধব প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে। এমতাবস্থা থেকে মুক্তি চাইলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওয়াজ ও বয়ানবাজ জরুরি। সেটা না করলে বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত চলমান সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কাছে মাথা নোয়াতে হবে, এমন পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে থাকলে আগের মতোই আমাদের সংস্কৃতি নিজস্বতা হারাবে, সিনেমায় তৈরি হবে বিদেশি আগ্রাসন, মঞ্চে থাকবে না নাটক, গ্রামে গ্রামে থাকবে না যাত্রা, পালাগান, শিশুদের মুখে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি, চাইনিজ, হিন্দির আগ্রাসন, বাঙালির পোশাক-সংস্কৃতিতেও পশ্চিমা আগ্রাসন থাকবে, আর এভাবে একদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদও প্রশ্নের মুখে দাঁড়াবে। সেই আমাদেরকে রক্ষা করতে তখন কোনো সুপারম্যানের আগমন ঘটবে না। কারণ, ততদিনে জেগে উঠবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দেশের সত্যিকারের সংস্কৃতিজনেরা। সাংস্কৃতিক বিপ্লব না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদও পরিপূর্ণ হবে না। বিপ্লব অনিবার্যতার কারণ হলো আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ রক্ষা। প্রাণে বাঁচতে কে না চায়? তাই টবে পানি দেওয়া জরুরি। কারণ সেখানেই বাঙালির পরিচয় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই গণঅভ য ত থ ন আম দ র স স ক ত র জন ত ক স ব ধ নত অব শ ব স স ন দর য পর চ ল ত অর থ ৎ ভ বন ক দ র বল হ র কর আর থ ক
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের তরুণদের কী চাওয়া
বাংলাদেশের তরুণেরা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছেন। একদিকে তাঁরা আগের যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে বেশি শিক্ষিত, বেশি সংযুক্ত এবং অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী; অন্যদিকে তাঁরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি—কমে আসা চাকরির সুযোগ, যুগোপযোগী নয় এমন শিক্ষাব্যবস্থা এবং এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো, যা তাঁদের প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে।
এই টানাপোড়েন ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলনের সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যখন তরুণেরা ব্যাপক প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন এবং স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, দীর্ঘস্থায়ী বেকারত্ব ও আর্থিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
প্রায় এক বছর পর, এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) একশনএইড বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে ‘ইয়ুথ সার্ভে ২০২৫’ পরিচালনা করে। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী দুই হাজার তরুণ-তরুণীর ওপর পরিচালিত জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল জরিপটি দেশের আটটি বিভাগের তরুণদের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা তুলে ধরে। ফলাফল একটি কঠিন কিন্তু আশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরে—তরুণেরা হতাশ, কিন্তু তাঁরা হার মানেননি। তাঁরা সংস্কার চান, শুধু প্রতিশ্রুতি নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা চান তাঁদের কথা শোনা হোক।
শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সংযোগহীনতাজরিপে দেখা যায়, শিক্ষার সঙ্গে চাকরির উপযোগিতার একটি বড় ফাঁক রয়েছে। মাত্র ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ মনে করেন, তাঁদের শিক্ষা কর্মজীবনের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি দিয়েছে। চমকে দেওয়ার মতো ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, তাঁদের শিক্ষা চাকরির প্রস্তুতির ওপর কোনো প্রভাবই পড়েনি।
এটি বর্তমান শিক্ষা ও প্রশিক্ষণব্যবস্থার একটি মৌলিক ব্যর্থতা নির্দেশ করে, যা অর্থনীতির পরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় অর্ধেক তরুণ এখনো শিক্ষার্থী হলেও ৩৭ শতাংশের বেশি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ, অর্থনৈতিক সংকট কিংবা পরিবারের আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন।
চাকরিরতদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ সেবা খাতে নিয়োজিত। কিন্তু এই চাকরিগুলো যথেষ্ট নয়—১৩ দশমিক ৭ শতাংশ সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছেন কিন্তু সফল হননি, আর উদ্বেগজনকভাবে ৩৯ শতাংশ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন: না পড়াশোনা করেন, না চাকরি করেন, এমনকি কাজ খোঁজেনও না। এই ‘হতাশাগ্রস্ত’ তরুণদের দল অর্থনীতি ও সমাজের জন্য একধরনের টাইমবোমা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
একটি উপেক্ষিত প্রজন্মএত তরুণ কেন সুযোগ থেকে বঞ্চিত? একটি শব্দই তাঁদের উত্তরের কেন্দ্রে—স্বজনপ্রীতি। ৫৪ শতাংশের বেশি তরুণ এটিকে চাকরির প্রধান বাধা হিসেবে দেখেছেন, যার পরেই রয়েছে দুর্বল আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদার অমিল। অনেকের ক্ষেত্রেই চাকরির আবেদন কোনো ফল দেয় না—যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, গত এক বছরে তাঁরা একটি সাক্ষাৎকারের ডাকও পাননি।
ঢাকার দেয়ালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি।