দেশের তিন পার্বত্য জেলা এবং বৃহত্তর সিলেটের অনুচ্চ টিলাগুলোতে বুনো ঝোপঝাড়ের ভেতর রূপান্তরিত পাতার একধরনের গুল্ম চোখে পড়ে। সবুজের পরিবর্তে হঠাৎ সাদা রঙের দু–এক গুচ্ছ পাতাভরা ডালপালা দেখে ফুলও মনে হতে পারে। প্রথম দিকে আমারও তাই মনে হয়েছে।
১৯৮৭ সালে প্রথম রাঙ্গামাটি গিয়ে এ গাছ দেখে বারবার ভেবেছি, সাদা রঙের এই ফুলগুলোর নাম–পরিচয় কী? কিন্তু গাছগুলো পাহাড়ের ঢালে থাকায় কাছে গিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য ভুল ভাঙে। এটা আসলে গাছটির রূপান্তরিত পাতা। বইপুস্তক ঘেঁটে নিশ্চিত হই এটিও ম্যুসেন্ডা বা নাগবল্লীরই আত্মীয়া। তবে পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া খুব একটা দেখা যায় না। প্রচলিত ইংরেজি নাম ডোয়ার্ফ ম্যুসেন্ডা, হোয়াইট উইং ইত্যাদি। স্থানীয়ভাবে চাত্তরি-চাউনরি, শিলচাঔনরি, শিলচাওরি, শিরদাউরা, রানীরাতাক, পাত্তো মরমইজ্জা, শেওদিমা (চাকমা), রানীতাগো গাছ (ত্রিপুরা), রানীর্তাক (তঞ্চঙ্গ্যা), শিচাম্বা (মারমা) ইত্যাদি নামে পরিচিত। আমাদের বন-পাহাড়ে ম্যুসেন্ডা বা নাগবল্লীর যে কটি রকমফের দেখা যায়, এটি তার মধ্যে অন্যতম। এ গাছ সংখ্যায় বেশি এবং সহজলভ্য।
চাওরি বা শিলচাওরি (Mussaenda roxburghii) খাড়া ধরনের গুল্ম। কখনো কখনো অর্ধখাড়াও হতে পারে। পাতা উপপত্রযুক্ত এবং বৃন্তক, উপপত্র প্রশস্তভাবে ত্রিকোণাকার থেকে বল্লমাকার, শীর্ষ দ্বিখণ্ডিত, খণ্ডক সোজা, রোমশ, পত্রবৃন্ত বলিষ্ঠ, ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাতার ফলক উপবৃত্তাকার বা আয়তাকার। পুষ্পবিন্যাস ঘন ও ডালের আগায়। সাধারণত গোড়া থেকে তিন শাখাবিশিষ্ট, পৃথক করা নয়, ফুলের সংখ্যা অনেক। ফুলের বৃতি দন্তকসহ ফল পাকা পর্যন্ত স্থায়ীভাবে থেকে যায়। পাপড়ি নল ৩ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, সরু, বাইরের দিক সরু রেশমি রোমে আবৃত। ফল আয়তাকার বা উপবৃত্তীয়, ১০ মিলিমিটার পর্যন্ত চওড়া হতে পারে। ফুল ও ফলের মৌসুম মে থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিস্তৃত।
বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারে এই গাছ সহজলভ্য। দেশের সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজার জেলায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাতজ্বর ও অন্যান্য জ্বরের চিকিৎসায় এই গাছ ব্যবহার করেন।
হলুদ ফুলের ম্যুসেন্ডাআশির দশকে সাভারে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক বছর ক্যালেন্ডারের পাতায় এই স্মৃতিসৌধটির ছবি ছাপা হয়েছিল। তখন স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের লালচে রঙের সুদৃশ্য কিছু পুষ্পঝাড়ের ছবি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। একসঙ্গে অনেকগুলো সারিবদ্ধ পুষ্পস্তবক সত্যিই যেন সেখানে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছিল। পরে জেনেছি, সিঁদুরে লাল বৃত্যংশের এ ফুলগুলোর নাম ম্যুসেন্ডা অ্যারিথ্রোফাইলা। দেশি গাছ নয়। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য আলংকারিক হিসেবে আমদানি করা হয়। আদি আবাস আফ্রিকা। আলংকারিক গুল্ম হিসেবেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আগে খুব একটা দেখা যেত না। দীর্ঘদিন বিভিন্ন পার্ক, উদ্যান এবং পথপাশে রূপান্তরিত পাতার সিঁদুরে লাল ও সাদা রঙের ম্যুসেন্ডা দেখেই সন্তুষ্ট থেকেছি। প্রায় একদশক আগে ঢাকায় রমনা পার্ক নার্সারিতে দাঁতরাঙার পাশে আরেকটি গাছ দেখে ধাঁধায় পড়ি। পাতার বর্ণগত বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হলেও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য প্রায় অভিন্ন। আবার ম্যুসেন্ডা নিয়ে মনোযোগী হই। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ও রাঙ্গামাটিতে দেখা গাছগুলোর কথা মনে পড়ে। রমনা পার্কের গাছটির পরিচয় চিহ্নিত করি। আগে উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ছিল ম্যুসেন্ডা লুটিয়া। এখন পরিবর্তিত উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Pseudomussaenda flava। এই প্রজাতির ফুলের রং হলুদ।
হলুদ রঙের ম্যুসেন্ডা। রাজধানীর রমনা পার্ক নার্সারি থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি।.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ট র পর
এছাড়াও পড়ুন:
শোভাময় দুই ম্যুসেন্ডা
দেশের তিন পার্বত্য জেলা এবং বৃহত্তর সিলেটের অনুচ্চ টিলাগুলোতে বুনো ঝোপঝাড়ের ভেতর রূপান্তরিত পাতার একধরনের গুল্ম চোখে পড়ে। সবুজের পরিবর্তে হঠাৎ সাদা রঙের দু–এক গুচ্ছ পাতাভরা ডালপালা দেখে ফুলও মনে হতে পারে। প্রথম দিকে আমারও তাই মনে হয়েছে।
১৯৮৭ সালে প্রথম রাঙ্গামাটি গিয়ে এ গাছ দেখে বারবার ভেবেছি, সাদা রঙের এই ফুলগুলোর নাম–পরিচয় কী? কিন্তু গাছগুলো পাহাড়ের ঢালে থাকায় কাছে গিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য ভুল ভাঙে। এটা আসলে গাছটির রূপান্তরিত পাতা। বইপুস্তক ঘেঁটে নিশ্চিত হই এটিও ম্যুসেন্ডা বা নাগবল্লীরই আত্মীয়া। তবে পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া খুব একটা দেখা যায় না। প্রচলিত ইংরেজি নাম ডোয়ার্ফ ম্যুসেন্ডা, হোয়াইট উইং ইত্যাদি। স্থানীয়ভাবে চাত্তরি-চাউনরি, শিলচাঔনরি, শিলচাওরি, শিরদাউরা, রানীরাতাক, পাত্তো মরমইজ্জা, শেওদিমা (চাকমা), রানীতাগো গাছ (ত্রিপুরা), রানীর্তাক (তঞ্চঙ্গ্যা), শিচাম্বা (মারমা) ইত্যাদি নামে পরিচিত। আমাদের বন-পাহাড়ে ম্যুসেন্ডা বা নাগবল্লীর যে কটি রকমফের দেখা যায়, এটি তার মধ্যে অন্যতম। এ গাছ সংখ্যায় বেশি এবং সহজলভ্য।
চাওরি বা শিলচাওরি (Mussaenda roxburghii) খাড়া ধরনের গুল্ম। কখনো কখনো অর্ধখাড়াও হতে পারে। পাতা উপপত্রযুক্ত এবং বৃন্তক, উপপত্র প্রশস্তভাবে ত্রিকোণাকার থেকে বল্লমাকার, শীর্ষ দ্বিখণ্ডিত, খণ্ডক সোজা, রোমশ, পত্রবৃন্ত বলিষ্ঠ, ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাতার ফলক উপবৃত্তাকার বা আয়তাকার। পুষ্পবিন্যাস ঘন ও ডালের আগায়। সাধারণত গোড়া থেকে তিন শাখাবিশিষ্ট, পৃথক করা নয়, ফুলের সংখ্যা অনেক। ফুলের বৃতি দন্তকসহ ফল পাকা পর্যন্ত স্থায়ীভাবে থেকে যায়। পাপড়ি নল ৩ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, সরু, বাইরের দিক সরু রেশমি রোমে আবৃত। ফল আয়তাকার বা উপবৃত্তীয়, ১০ মিলিমিটার পর্যন্ত চওড়া হতে পারে। ফুল ও ফলের মৌসুম মে থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিস্তৃত।
বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারে এই গাছ সহজলভ্য। দেশের সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজার জেলায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাতজ্বর ও অন্যান্য জ্বরের চিকিৎসায় এই গাছ ব্যবহার করেন।
হলুদ ফুলের ম্যুসেন্ডাআশির দশকে সাভারে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক বছর ক্যালেন্ডারের পাতায় এই স্মৃতিসৌধটির ছবি ছাপা হয়েছিল। তখন স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের লালচে রঙের সুদৃশ্য কিছু পুষ্পঝাড়ের ছবি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। একসঙ্গে অনেকগুলো সারিবদ্ধ পুষ্পস্তবক সত্যিই যেন সেখানে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছিল। পরে জেনেছি, সিঁদুরে লাল বৃত্যংশের এ ফুলগুলোর নাম ম্যুসেন্ডা অ্যারিথ্রোফাইলা। দেশি গাছ নয়। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য আলংকারিক হিসেবে আমদানি করা হয়। আদি আবাস আফ্রিকা। আলংকারিক গুল্ম হিসেবেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আগে খুব একটা দেখা যেত না। দীর্ঘদিন বিভিন্ন পার্ক, উদ্যান এবং পথপাশে রূপান্তরিত পাতার সিঁদুরে লাল ও সাদা রঙের ম্যুসেন্ডা দেখেই সন্তুষ্ট থেকেছি। প্রায় একদশক আগে ঢাকায় রমনা পার্ক নার্সারিতে দাঁতরাঙার পাশে আরেকটি গাছ দেখে ধাঁধায় পড়ি। পাতার বর্ণগত বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হলেও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য প্রায় অভিন্ন। আবার ম্যুসেন্ডা নিয়ে মনোযোগী হই। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ও রাঙ্গামাটিতে দেখা গাছগুলোর কথা মনে পড়ে। রমনা পার্কের গাছটির পরিচয় চিহ্নিত করি। আগে উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ছিল ম্যুসেন্ডা লুটিয়া। এখন পরিবর্তিত উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Pseudomussaenda flava। এই প্রজাতির ফুলের রং হলুদ।
হলুদ রঙের ম্যুসেন্ডা। রাজধানীর রমনা পার্ক নার্সারি থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি।