স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গণতান্ত্রিকীকরণ
Published: 13th, January 2025 GMT
গণতন্ত্র অর্থবহ করতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে উপযুক্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। জনগণের প্রতি দায়-দরদহীন এমনকি গুরুতর ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত লোকও স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে চলে আসে। এ ক্ষেত্রে যারা ব্যতিক্রম তারাও সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে ভালো কাজ করতে পারেন না। ফলে জনগণের সঙ্গে শতাব্দীপ্রাচীন ব্যবস্থারই এক প্রকার বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, যা তৃণমূলে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে বাধ্য।
এ ভূখণ্ডে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসকদের হাতে ১৮৭০ সালে। তখন গ্রাম চৌকিদারি আইন পাস হয়, যার অধীনে প্রতিটি এলাকায় একটি ‘ইউনিয়ন’ ও ‘চৌকিদারি পঞ্চায়েত’ (সংগঠন) গঠিত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, কর সংগ্রহ ও প্রশাসনকে সহায়তা ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের কাজে লাগানোর সুবিধার্থে ১৮৮৫ সালে সরকার ‘বেঙ্গল লোকাল সেল্ফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট’ নামে আইন তৈরি করে। এই আইনের অধীনে ইউনিয়ন কমিটি, স্থানীয় সরকার বোর্ড ও জেলা বোর্ড গঠিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালের ‘দ্য বেঙ্গল ভিলেজ সেল্ফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট’ আইনটি চৌকিদার পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ড গঠন করে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যক্রম ছিল আইনশৃঙ্খলা, সড়ক-সেতু রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, দাতব্য চিকিৎসালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, জেলা বোর্ডের পানি সরবরাহ এবং জেলা বোর্ডকে সহায়তা প্রদান। ইউনিয়ন বোর্ড ছোট ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারত। ইউনিয়নকে কর আরোপের অধিকার দেওয়া ছিল। ১৯৫৯ সালের মৌলিক গণতন্ত্রী অধ্যাদেশের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদকে বিদ্যমান চৌকিদারি তহবিলের পাশাপাশি নিজের তহবিল গড়ে তোলার জন্য সম্পত্তি ও অন্যান্য উৎসের ওপর কর আরোপের অনুমতি দেওয়া হয়। গ্রামীণ কর্মসূচি এবং ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান ছিল।
১৯৭২ সালের সংবিধানে এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও ইউনিয়ন কাউন্সিলের জন্য ৩৭টি কাজ দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কৃষি উন্নয়ন, পানি সরবরাহ, শিক্ষা, যোগাযোগ, সামাজিক কল্যাণ। ১৯৬১ সালের ‘মুসলিম ফ্যামিলি অ্যান্ড ম্যারেজ অর্ডিন্যান্স’ অনুসারে ইউনিয়ন কাউন্সিলকে সমঝোতা আদালত প্রতিষ্ঠা করা এবং সদস্যদের বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০-এ একটি স্থানীয় সরকারের রূপরেখা রয়েছে। এতে স্পষ্ট– তৃণমূলে উন্নয়নসহ সব কাজে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার বিষয়টি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের ভাবনায় ছিল, যদিও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
বিদ্যমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলবাজি একটি প্রধান সমস্যা। ব্যবস্থাটি হওয়ার কথা ছিল সংসদীয় সরকার কাঠামোর; হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কাঠামোর। চেয়ারম্যান বা মেয়র এখানে সর্বেসর্বা। উপরন্তু, তারা যদি বিএনপির হন, তবে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা গুরুত্ব পায় না। একই চিত্র আওয়ামী চেয়ারম্যান, মেয়রদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এ জন্য দলীয় প্রতীকে ও মনোনয়নে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া যেমন উচিত নয়, তেমনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ আইনত নিষিদ্ধ করতে হবে। এই নির্বাচনে ইউনিয়নে শুধু মেম্বার এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর নির্বাচন করা হোক। নির্বাচিত মেম্বার ও কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ মেম্বর-কাউন্সিলরদের ভোটে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হবেন। যাঁকে যে কোনো সময় সংশ্লিষ্ট মেম্বার ও কাউন্সিলররাই অপসারণ করতে পারবেন। জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান চাইলে এগুলোর গণতান্ত্রিকীকরণ জরুরি।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ওপর এমপিদের কর্তৃত্ব খর্ব করাও স্থানীয় সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। এমপি তথা আইনসভার সদস্যরা আইন তৈরি করবেন। স্থানীয় উন্নয়ন বা অন্য বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।
দেশের অতীত শাসকরা বুঝতেই পারেননি– তদবির কিংবা গায়ের জোরে নগরায়ণ হয় না। দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে এমপিদের পছন্দের এলাকাকে তারা পৌরসভা ঘোষণা করেছেন। এতে বাস্তব কারণে নগরায়ণ না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট গ্রামাঞ্চলে কর্তৃপক্ষের পক্ষে নাগরিক সেবাদান অসম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে শহুরে হারে কর দিতে হয় বলে জনগণের জন্য তা এক প্রকার বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ‘বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড’ নামে প্রতিষ্ঠানটি এ জাতীয় অনেক সংকট ইতোমধ্যে মোকাবিলা করছে। এসব পৌরসভা অবিলম্বে বাতিল ও বিলুপ্ত করতে হবে। এ ছাড়া এখনকার আধুনিক সময়ে স্থানীয় সরকারের সব ট্যাক্স ও ফি সংক্রান্ত লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে হওয়ার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনারও বিকল্প নেই। মাস্টার রোলে চাকরি চলবে না। সব কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আজকের ডিজিটাল যুগে মশক নিধন কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী; কারও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ নেই। নির্বাচন অবাধ ও গণতান্ত্রিক করার প্রথম শর্তই হলো, তাতে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অবারিত রাখা। যিনি ভোট দিতে পারবেন তিনি নির্বাচনে দাঁড়াতেও পারবেন; যদি তিনি ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি বা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি না হন। পাস করলে সেই চাকরি থেকে পদত্যাগ করলেই চলবে। এ ব্যবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষিত নেতৃত্বও সৃষ্টি হবে। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যৎমুখী করতে হলে শিক্ষিত নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।
জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা
বাংলাদেশে পুলিশে পেশাদারি মনোভাব গড়ে না ওঠার জন্য এই বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারকে দায়ী করছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেছেন, বিভাজিত সমাজে ‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’—এমন নানা তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি। যৌথভাবে এ বৈঠক আয়োজন করে প্রথম আলো ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি। বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। একটি প্রবন্ধ তুলে ধরেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (অবসরপ্রাপ্ত) ও বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি ইয়াসমিন গফুর।
নিজের পেশাজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, ‘আমি দুই সরকারপ্রধানের (সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গেই কাজ করেছি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে একটা ভদ্রতা, সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে হয়। দেখা করলে অনেক কথার পরও বা অল্প কথার পরও ‘এ কি আমাদের?’—এমন কথা শুনলে প্রথমেই বিব্রত বোধ করতে হয়।’
সরকারের পরিবর্তনে পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে প্রভাবিত হওয়ার উদাহরণ দিয়ে মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘বাড়ি ফরিদপুর যদি হয় বা ফরিদপুরের আশপাশে হয়, কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট হবে না। আবার আরেক সময় বগুড়ায় বাড়ি, ঝিনাইদহে বাড়ি, দিনাজপুরের বাড়ি, তাহলে চাকরিতে নেওয়া যাবে না বা ক্ষেত্রবিশেষে পদোন্নতি হবে না।’ এ ধরনের মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার বা পেশাদারি মনোভাব ফেরানো কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও আচরণের পরিবর্তন না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে নুরুল হুদা বলেন, ‘এক অদ্ভুত ব্যাপার। এখানে দুই হাজারের মতো লোক মারা গেল। অথচ বিহেভিয়ারে চেঞ্জ নেই।’
দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঠিকভাবে কাজ করতে না পারার অন্তরায় হিসেবে নিয়োগে দুর্নীতি এবং সমাজে বিভাজনকে চিহ্নিত করেন সাবেক এই পুলিশপ্রধান। তিনি বলেন, ‘এই যে প্রচুর সংখ্যার লোক পয়সা দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে বা এখানে হলে...অনেক পয়সা হয়, এই অ্যাটিচিউড (আচরণ) থাকলে তো ল এনফোর্সমেন্ট (আইনশৃঙ্লা নিয়ন্ত্রণ) মুশকিল। আর ল এনফোর্সমেন্টের আরেকটা বড় জিনিস হচ্ছে আমি যে সমাজে কাজ করতে যাচ্ছি, সেই সমাজ কতখানি বিভাজিত।’
সংস্কারের পটভূমিতে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের কর্মপদ্ধতি জানতে চেয়েছেন নুরুল হুদা। পুলিশ রিমান্ডের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এই গোলটেবিল বৈঠকে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতির সভাপতি এম আকবর আলী, মানবাধিকার কর্মী নূর খান বক্তব্য দেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, পুলিশের অতিরিক্ত আইজি কাজী মো. ফজলুল করীম বৈঠকে অংশ নেন।